মা দিবসে সব নারীকে স্যালুট

সুপ্রীতি ধর:

নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস’। এবছর ৯ মে পড়েছে দিনটি। এই অতিমারির মাঝেও দিনটি উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে মা-ময়। যে সন্তান বছরের অন্য কোনদিন মাকে স্মরণ করে না, তারাও আজ মাকে নিয়ে লিখছে। এটাকে আমি ইতিবাচকই বলবো। অন্যদের দেখাদেখি হলেও তার মনে সুপ্ত থাকা একটা বোধ আজকের জন্য হলেও জাগ্রত হচ্ছে। আর এজন্যই দিবস পালনে আমার কোন অনীহা নেই। বরং বছরের প্রতিটা দিন এমন ইতিবাচকভাবেই বিভিন্ন দিবস পালন করার পক্ষপাতি আমি। নিজেকে ব্যস্ত রাখা কোন ভালো কাজে, এইটুকুই।

একজন লিখেছেন মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে মা দিবস পালন করছে কেউ কেউ। হতে পারে। এই কথাটাতে একটা শ্লেষ আছে। কারণ আমরা এখনও বৃদ্ধাশ্রম শব্দটার সাথে একীভূত হতে পারছি না। একে সদর্থকভাবে নিতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের সমাজে সম্পর্কগুলো এখনও আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, অন্যরকম মৌলিক ভিতের ওপর গড়ে উঠা এই সমাজে বৃদ্ধাশ্রমকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয় এখনও। আরও কারণ হচ্ছে উদাহরণযোগ্য কোন বৃদ্ধাশ্রম এখনও গড়ে উঠেনি দেশে, যা দেখে স্বপ্রণোদিত হয়েই বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা সেখানে যাবেন! কিন্তু ব্যক্তি আমি এই ধারণার সাথে একমত পোষণ করি। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর বাড়তি বোঝা হিসেবে না থেকে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে যদি জীবনটা যাপন করা যায়, মন্দ কী! সম্পর্কও ভালো থাকলো, নিজেও ভালো থাকলাম।

গত সপ্তাহেই আমার এক বন্ধু চলে গেছে করোনায়। তার ছেলের পোস্ট থেকে জানতে পারলাম। আজ থেকে থেকে বাচ্চাটার চেহারাটাই ভাসছে। ওর মনে আজ কী ভীষণ ঝড় বইছে, কে জানে! এরকম মা-হারানো সন্তানদের সংখ্যা অনেক, বিশেষ করে গত একবছরে চলে গেছেন অনেক-মা-বাবা, যাদের আরও অনেকদিন থাকার কথা ছিল পৃথিবীতে। এই যে স্বজন হারানোর ট্রমা তৈরি হচ্ছে একেকটা মনে, এ থেকে কে কবে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে পারবে, জানি না। আদৌ পারবে কিনা, সেই সন্দেহও তো থেকেই যাচ্ছে। নিজেকে দিয়েই তো বুঝি জীবনের কোন ধন যেমন ফেলনা নয়, তেমনি কোন ট্রমাই পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা যায় না। থেকে যায়। আলোড়িত করে রাখে বাদবাকি জীবন। সেই জীবনে কেউ কেউ শরীর ঝারা দিয়ে উঠতে সক্ষম হই, কেউ কেউ হই না। কাজেই যাদের হৃদয় আজ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে মাতৃশোকে, আমি তাদের প্রতি জানাই গভীর ভালবাসা। কোন সান্ত্বনা দিচ্ছি না। শুধু বলবো, সময়টাকে পার হতে দিন। সময়ই ঠিক করে দেয় অনেক ক্ষত।

মাতৃত্ব মহান কিছু না। কিন্তু আমাদের সমাজে একে মহান করে তোলার পাশাপাশি কোটি কোটি নারীর জীবন বিভীষিকাময় করে তোলা হয়। আমাদের দেশে মাতৃত্বের জন্য কোন প্রস্তুতি থাকে না, জ্ঞান থাকে না। সন্তান জন্মের পর নারী ধীরে ধীরে মা হয়ে উঠে। এটা যে কতটা ভুল, তা বলবে কে! যে নারী মা হয়েছে, সে যে শুধু প্রসব বেদনার মধ্য দিয়েই গেছে, তা নয়, মাতৃত্বের আনন্দের পাশাপাশি যে বেদনা আছে, সারা জীবন ধরে যা বয়ে যেতে হয় একজন নারীকে, সেই বেদনাকে সমাজ অস্বীকার করে। একজন মা যে আলাদা সত্ত্বা, তার নিজেরও যে সময় প্রয়োজন, সেই বোধটা কয়জনের থাকে? আবার দেখুন, যে মেয়েটি মা হতে পারলো না, তাকেও সমাজ নিস্তার দেয় না। আমৃত্যু তাকে এই যন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হয়। কিন্তু মা হওয়া এবং না হওয়ার মাঝেও যে ‘বিটুইন দ্য লাইন’ অনেকগুলো বিষয় থাকে, কথা থাকে, সেগুলো স্পষ্ট করে কেউ বলে না। ফলে একজন সন্তান জন্ম দেয়া মা যেমন আজীবন কষ্ট বুকে নিয়ে ঘুরে, তেমনি জন্ম না দেয়া মেয়েটিও কষ্টে ভুগে। দিনশেষে কষ্টটা নারীরই হয়।

থাক, আজ মা দিবসে অত জটিল কথা না বলি। শুধু বলবো, মাতৃত্ব একটা রাজনীতি। পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি। আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত। আমি কখন মা হবো, সেই সিদ্ধান্তটা আমারই হোক। আদৌ হবো কিনা মা, সেই সিদ্ধান্তও যেন আমিই নিতে পারি। যে মায়েরা তাদের সারাজীবন উৎসর্গ করে দেন সন্তানের জন্য, সন্তানের কল্যাণের জন্য শেষবিন্দুটুকু দিয়েও পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যান, সেই মায়েদের বন্দনা অবশ্যই করবো। কারণ তারা সেই উৎসর্গটুকু করেন বলেই সন্তান দুপায়ের ওপর দাঁড়ানো শেখে। কিন্তু কেবল এই আত্মত্যাগ দিয়েই যেন একজন নারীকে বিচার করা না হয়। কারণ একটি সন্তানের দায়িত্ব কেবলই নারীর বা সন্তানের বাবা-মায়ের না, পুরো পরিবারের, সমাজের, তথা রাষ্ট্রের। সুতরাং অন্য সেক্টরগুলো যদি ‘ফেইল’ করে, যদি দায়িত্ব নিতে অনীহা দেখায়, তখন নারীকেই কেন একা একা সব দায়িত্ব পালন করতে হবে? কেন তাকে একাই তার জীবন উৎসর্গ করতে হবে? যদি করে তবে কেনই বা এর প্রতিদান সে পাবে না?

তারপরও যে মেয়ে মা হয়েছেন বা হননি বা হবেন না কখনও, সবাইকেই মা দিবসের শুভেচ্ছা, ভালবাসা। একজন নারীর অফুরান শক্তিই মূলত মাতৃত্ব। এই শক্তির কারণেই সে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.