সম্মতি থাকা আর না থাকায় খুব বেশিকিছু কি আসে যায়?

সুমু হক:

বাংলাদেশের প্রবল প্রতাপশালী ধনী একজন ব্যবসায়ীর একজন তরুণী প্রেমিকা সম্প্রতি তার প্রেমিকের প্ররোচনায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, বা খুন হয়েছে এবং যথারীতি এই ঘটনার পর সেই প্রেমিকের বিচার কিংবা ঘটনার তদন্তের প্রতিবেদনের পরিবর্তে অধিকাংশ মিডিয়া সেই মেয়েটির চরিত্রহনন (পড়ুন ধর্ষণ), যাকে বলা হয় ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ কিংবা গ্যাসলাইটিং, তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে আমার পরিচিত কাউকে কাউকে অত্যন্ত অবাক হতে দেখলেও আমি কিন্তু একটু অবাক হইনি।
কেন?
কারণ এখনকার বাংলাদেশে একজন নারীর শরীর, তার ইন্টেগ্রিটি ইত্যাদি সবচেয়ে সস্তা কমোডিটি, আর তাই সেটাকে নিয়ে যখন যা ইচ্ছে তাই করা যায় এবং করে পার পেয়ে যাওয়াও যায়। পার পেয়ে যাওয়া যায়, তার কারণ আমি, আপনি, আমরা সবাই এই নারীকে নিয়ে যাচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিটাকে বিনা বাধায় বাড়তে দেই। আর সেটা বাড়তে দেই কখনো উপেক্ষা করে, কখনো নীরবে মেনে নিয়ে, কখনো ভয় পেয়ে কিংবা কখনো আবার সমাজের সামনে নিজের নিজের পরিবারের আদর্শ মুখোশটাকে ধরে রাখবার ইচ্ছেতে।

কথা উঠছে যে সম্পর্কটি তো দুজনের সম্মতিতেই হয়েছিল এবং সেই সম্পর্কের সুবাদে যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতাও ভোগ করেছিল সেই তরুণীটি, তাহলে এখন কেন তার মৃত্যুর দায় তার সেই প্রাক্তন প্রেমিককে নিতে হবে?
এই সাড়ে চার অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ “সম্মতি”।
একে ঘিরেই যত গোলমাল।

আমাদের সংস্কৃতি সাধারণভাবেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এখানে ব্যক্তিগত বলেই কিছু নেই, আর নারী কিংবা শিশু তো পরিপূর্ণ মানুষ কিংবা ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হন না আমাদের সমাজে, তো তাদের আবার ব্যক্তি স্বাধীনতা বস্তুটি কী?

যে কোন সুস্থ, সহজ এবং স্বাভাবিক প্রেমের এবং শারীরিক সম্পর্কে “পারস্পরিক সম্মতি” বা “Consent” একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
আমাদের দেশটি যেহেতু এখনও সভ্য দেশের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি, তাই এখানকার কথা আলাদা, কিন্তু পৃথিবীর অন্য যেকোনো সভ্য দেশে এই “Consent” বিষয়টি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, যেকোনো যৌন সহিংসতার বিচারের ক্ষেত্রে সবার আগেই এই সম্মতি কিংবা কনসেন্টের বিষয়টি চলে আসে। অর্থাৎ যে যৌন সংসর্গ কিংবা সম্পর্কের ঘটনাটি বিচারের বিষয়বস্তু, তার পুরো সময়টিতে যে অত্যাচারিত এবং অভিযোগকারী, তার সম্মতি ছিল কিনা!

এই সম্মতির ক্ষেত্রে সেখানে কেবল বয়স কিংবা সম্পর্কই বিবেচ্য বিষয় নয়, আরো একটি বিষয় বিবেচ্য, তা হলো, কোনভাবে অর্থ, ক্ষমতা কিংবা অন্য কোন উপায়ে নির্যাতনকারী নির্যাতিত ব্যক্তির ওপর এমন কোন বিশেষ শক্তি কিংবা ক্ষমতা ধারণ করেন কিনা যাতে করে তার ইচ্ছের বিপরীতে গেলে ভবিষ্যতে নির্যাতিত ব্যক্তিটিকে তার প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে এবং কোনরকম আর্থিক, বৈষয়িক কিংবা অন্য কোনরকম ক্ষতির শিকার হতে হবে। এইসব ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কে জড়িত দুজন ব্যক্তিই প্রাপ্তবয়স্ক হলেও এবং আপাত দৃষ্টিতে সম্পর্কটি পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটলেও, এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিকে যৌনসহিংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হতে পারে এই কারণে যে তার সঙ্গীটি কোন না কোন কারণে তার ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে সেনাবাহিনীতে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগ কিংবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের তার শিক্ষার্থীর সাথে সম্পর্কের অভিযোগ, এক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্বিশেষে অভিযোগ নেমে আসবে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা এবং শিক্ষকটির ওপর, কেননা, প্রথমজন পদমর্যাদায় উঁচু বলে তার সঙ্গীর পদোন্নতি থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রে এমনকি তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষমতাও রাখেন, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে শিক্ষকটি ক্ষমতা রাখেন তার বিষয়ে কম কিংবা বেশি নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীটির ভবিষ্যতকে নিশ্চিহ্ন কিংবা উন্নত করার।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এর সাথে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, অর্থাৎ মুনিয়া এবং তার খুনের দায়ে অভিযুক্ত আনভীরের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে।
ধরলাম, পত্রিকার খবর অনুযায়ী মুনিয়া অত্যন্ত খারাপ একটি মেয়ে, তার কোন নৈতিকতার বোধ নেই, তারপরও কি আনভীর যা করেছে সেটা নীতিগতভাবে কিংবা আইনগতভাবে বৈধ হয়ে যায়?
কখনোই না।
ধরলাম, মুনিয়াকে আনভীরের চোখে পড়া সত্ত্বেও আনভীরের প্রস্তাবে সে সাড়া দিলো না, তাহলেও কি বাঁচতে পারতো মুনিয়া?
কখনোই পারতো না।
সেক্ষেত্রে আনভীরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যে সম্পর্কে সে জড়িয়েছে, সে সম্পর্কে তার সম্মতির প্রশ্নটা আসছে কোথা থেকে?
সম্মতির প্রশ্ন তখনই আসে, যখন দুটো মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং অন্যান্য সবরকম ক্ষমতায় পরস্পরের সাথে সমান অবস্থায় অবস্থান করে। মুনিয়া আর আনভীরের ক্ষেত্রে কি একথা কোনোভাবেই খাটে?
আর যদি তা নাই খাটে, তাহলে যে সম্পর্কে জড়াতে মুনিয়া বাধ্য হয়েছিল, সে সম্পর্কের দায় তাকে আমরা কি করে দেই?

এবার হয়তো আপনারা বলবেন তাহলে তার আগের প্রেমগুলোর কী হবে?
যে মেয়ে এতগুলো প্রেম করেছে, তার চরিত্র তো অবশ্যই খারাপ!

শুনুন, যে যুগে লাইলী মজনু, শিরী ফরহাদের গল্পগুলো লেখা হয়েছে, সেযুগে মেয়েদের অন্য কোন জগৎ ছিলো না, শৈশব কিংবা বড়জোর কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই প্রেম কিংবা বিয়ে ছাড়া অন্য কোন জীবনের কথা তাদের আর জানা ছিল না। তাই এক প্রেমেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যেত। আর এই কারণেই বোধহয় সাহিত্যের বেশিরভাগ বিখ্যাত প্রেমের গল্পই ট্র্যাজেডিতে শেষ হয়েছে। অর্থাৎ সংসারের যাঁতাকলে পরে যতদিনে সেই প্রেম ফিকে হতে শুরু করবার কথা, ততদিন পর্যন্ত কোন গল্পই টেনে নিয়ে যাবার সাহস কারো হয়নি।

তাই বাস্তবে কোন প্রেম টিকিয়ে রাখতে হলে আর অনেক অনেক পরীক্ষায় উৎরোতে হয়। আর কৈশোরে সেইসব বিচার করে দেখবার ক্ষমতা হয়তো কোন মেয়েরই থাকে না। তার পরও যারা সেই কৈশোরের প্রেমকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে সেই ভুলটাকেই স্থায়ী করে আজীবনের জন্যে সর্বস্বান্ত হয়, তার পেছনে অনেক বেশি থাকে পারিবারিক চাপ, প্রেমের তাড়না তখন প্রায়োরিটির নিচের দিকে চলে যায়। ভুল বুঝতে পেরেও অনেক মেয়েই সেই ভুলটাকেই আঁকড়ে ধরে দুটো কারণে, হয় এই সমাজ-সংস্কৃতি তাকে বুঝিয়েছে যে একবার যখন সে কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে, কারো সাথে মনের কিংবা শরীরের সম্পর্কে জড়িয়েছে, সারা জীবনের জন্যে সেই পুরুষটিকেই তার মাথায় তুলে রাখতে হবে, আর নয়তো তার পরিবার তাকে জানিয়ে দিয়েছে, যে তার আর ফেরার পথ নেই।

পরিবারের সাহচর্য, সহমর্মিতা, মা-বাবার বন্ধুত্ব থাকলে এই সমাজের সব কিশোরীই নিজের কৈশোরের ভুল পছন্দ বুঝতে পারলে সেখান থেকে সরে আসবার সাহস পেতো। আর পুরুষেরা? তারাও হয়তো এই সমাজের মেয়েদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখতো।
সমাজের প্রত্যেক স্তরে, কোন না কোনভাবে এই ধারণাগুলোই যুগের পর যুগ পার হয়ে এখনো রয়ে গেছে।
এমনকি যেইসব তথাকথিত অত্যন্ত আধুনিক পুরুষ বিছানাতে ভীষণরকম এডভেঞ্চার চায়, বিয়ের ক্ষেত্রে তারাও চায় সতীসাধ্বী, অপাপবিদ্ধা একটি নারী, তা সে নিজে যাই হোক না কেন।

লেখাটা অনেক লম্বা হয়ে গেলো, তবুও এই সমাজের তথাকথিত উদার পুরুষের সম্পর্কচর্চা বিষয়ে একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি।

একজন অতি বিদ্বান অত্যন্ত আধুনিক মনষ্ক পুরুষ, রীতিমতো উচ্চশিক্ষিত। তিনি সুদর্শন, মধ্য চল্লিশেও অবিবাহিত, নিয়মিত লেখালেখি করেন, নারীমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্লার্ট করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁরই একজন নারী বন্ধু, বয়স তাঁর চেয়ে সামান্য কম, তিনিও অবিবাহিতা, এবং মানসিকতায় আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের অনেকটাই মিল, অর্ধেক জীবনের বন্ধুত্বে তাঁরা একে অপরের আদ্যোপান্ত অনেকটাই জানতে পেরেছেন।

এই দীর্ঘ সময়ে দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন সম্পর্কের ভেতর দিয়ে গেছেন এবং প্রিয় বন্ধুর সাথে সেইসব সম্পর্কের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অনেক কিছুই ভাগ করে নিয়েছেন তাঁরা, যেমনটা লোকে করে আর কী খুব কাছের বন্ধুর সাথে। মধ্য তিরিশে এই ভদ্রলোকটি একবার জানালেন, এই নারীটির প্রতি তিনি শারীরিকভাবে আকৃষ্ট এবং এই সম্পর্কটাকে তিনি উদযাপন করতেও আগ্রহী। ইতিমধ্যে সেই নারীটিও নিজের অজান্তেই এই মানুষটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন। আর পুরুষটি শরীরের বাইরে কখনও ভালোবাসার কথা না বললেও অস্বীকারও করেননি। আর নারীটি এই সময় থেকেই স্পষ্ট করে গেছেন, তিনি ভয়ংকর ভালোবাসেন এই মানুষটাকে। যদিও পুরুষটির আগ্রহ কেবল সেক্সটিং কিংবা মাঝেমধ্যে ভিডিও চ্যাটেই সীমাবদ্ধ। আর এই সম্পূর্ণ সময়টাতেই তিনি মায়ের কথা রাখতে বিয়ের জন্যে নিয়মিতভাবে উপযুক্ত পাত্রীদের দেখে গেছেন এবং একের পর এক রিজেক্ট করেও গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এসে পুরুষটির আতঙ্ককে স্তিমিত করতেই এবার নারীটি জানালেন, ভালোবাসলেও পুরুষটিকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বৈবাহিক সম্পর্কে বাঁধার কোন ইচ্ছেই তাঁর নেই। তিনি দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়াতেই তৃপ্ত।

উত্তরে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে পুরুষটি এবার তাঁদের প্রায় কুড়ি বছরের বন্ধুত্বটি ভাঙলেন। ভাঙার আগে অবশ্য সেই কৈশোরে নিজের কৌমার্য হারানো এবং একাধিক নারীর সংসর্গে জড়ানো পুরুষটিও নারীটিকে তাঁর অতীতের একাধিক সম্পর্কের জন্যে অপমানিত করতে ছাড়লেন না। অবশেষে সম্পর্ক শেষ করলেন এই বলে, “কুড়ি বছর আগে যেহেতু এই নারীটি অন্য কারো প্রেমে পড়েছিলেন, এবং তাঁকে দেখামাত্রই প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রেমে পড়ে যাননি, তাঁর সাথে এই পুরুষের কোন সম্পর্ক হওয়াই অসম্ভব!”
থাকলোই বা কনসেন্ট! সেক্সটিং এর কনসেন্ট দিলেই প্রেমে পড়ে যাবে, এতো বড় স্পর্ধা!

আপনারাও নিশ্চয়ই এতক্ষণে এই নারীটিকে ভীষণ গালিগালাজ করছেন, তাই না!
কী ভয়ঙ্কর চরিত্রহীন একটা মেয়ে!
তার ওপর আবার এতো বড় সাহস এমন একজন ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে!
আমিও তাই করছি!
এই সমাজে মুনিয়ার মতো একজন মেয়ে বেঁচে থাকবে কোন স্পর্ধায়!
মরুক মুনিয়ারা! মুনিয়াদের মরে যাওয়াই উচিত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.