আনা নাসরীন:
গত ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান (মুনিয়া) নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কমন প্রশ্ন লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন –
১. মেয়েটি জেনে শুনে কেন বিত্তবান পুরুষের প্রেমে পড়েছে?
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও সে কেন ঢাকায় অবস্থান করছিলো?
৩. মেয়েটি কি জানতো না যে আনভীর বিবাহিত ছিলো?
৪. মেয়েটির পরিবারের প্রশ্রয় ছিলো কিনা?
৫. মেয়েটি কি আনভীরের প্রেমিকা ছিলো, নাকি রক্ষিতা?
মূলত যার কাছ থেকে এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিলো তার অনুপস্থিতিতে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে আমরা কেউ যেহেতু সক্ষম নই, তাই কারো পক্ষে সম্ভব না এই প্রশ্নগুলোর সেই উত্তর খুঁজে বের করা যা ভিকটিমের বাস্তবিক অবস্থানকে নিরূপণ করতে পারে। তবুও নৈতিকতার ভিত্তিতে আমরা কেবলমাত্র এক ধরণের একাডেমিক পর্যালোচনার চেষ্টা করতে পারি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও সে কেন ঢাকায় অবস্থান করছিলো?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বন্ধ থাকার পরও সমগ্র ঢাকায় যে মুনিয়া একাই অবস্থান করছিলো তা কিন্তু নয়। আমরা জানি আরো লক্ষ লক্ষ মনুষ তার কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও ঢাকায় অবস্থান করছিলো ও করেই চলেছে। সুতরাং শুধুমাত্র মুনিয়ার জন্য বিশেষভাবে এরকম প্রশ্ন নিতান্ত অবাঞ্ছিত, তাই আমরা এই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর নাই যাই।
মেয়েটি কি জানতো না যে আনভীর বিবাহিত ছিলো?
আনভীর নিজেই যদি না জেনে থাকে যে সে বিবাহিত, তাহলে মুনিয়া কী করে জানবে যে আনভীর বিবাহিত! আর আনভীর যদি জেনে থাকে যে সে নিজে বিবাহিত তাহলে তো মুনিয়ার সেটা না জানলে বা না ভাবলেও চলে। তার মানে আমি অবশ্যই এই সন্দেহ পোষণ করছি না যে নিজের বিয়ে সম্পর্কে আনভীর আক্ষরিক অর্থেই অবগত ছিলো না, তারা দুজনেই জানতেন তা আমরা সবাই নিশ্চিত। আমি শুধু বলতে চাইছি যে জেনে শুনে একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে একটি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে আনভীর, মেয়েটি কিন্তু বিবাহিত নয়। আইনত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অপরাধ কেবলমাত্র বিবাহিত ব্যক্তিটির, যেহেতু তিনি বৈবাহিক চুক্তি ভঙ্গ করে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তবে তিনি এক্ষেত্রে প্রকৃতই কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন, নাকি সঙ্গীর সাথে সমঝোতার ভিত্তিতেই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন করেছেন – তা একমাত্র তার সঙ্গীই (স্ত্রী) বলতে পারেন, কেননা অন্য কেউ জানেন না তাদের দাম্পত্য জীবন কিরকম চুক্তির ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছিলো। যে কারণে এডাল্টারি কেইসগুলোর ক্ষেত্রে একমাত্র স্পাউস ব্যতীত আর কেউ অভিযোগের অধিকার রাখে না, এমনকি নিজের সন্তানও চাইলে পিতা/মাতার বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের প্রসঙ্গে এডাল্টারির মামলা দায়ের করতে পারেন না।
অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে এখনো পর্যন্ত ধর্মত ও আইনত পুরুষের পক্ষে একই সাথে দুজন স্ত্রী রাখাও বৈধ, যদি কিনা তা প্রথম স্ত্রীর মতের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে এটাও বলতে পারি না যে আনভীরের সাথে মেয়েটির বিয়ের পরিকল্পনা ছিলো না। স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষেও একই সাথে দুটি বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা থাকার অর্থই হচ্ছে সমাজে বহুগামীতার স্বীকৃতি থাকা। সমাজে বহুগামীতা চর্চার বিরোধিতা করতে চাইলে উক্ত আইনের পরিবর্তন চাওয়া উচিত। অথচ মুলগত দিক নিয়ে কথা না বলে বহুগামী আনভীর তার স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে কাকে বিয়ে করলো, বা কার সাথে প্রেম করলো – তার গুষ্টি উদ্ধার করে আসলে সমাজ থেকে বহুগামীতা বিলুপ্ত করা যাবে না। সুতরাং আনভীর ও মুনিয়ার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কটি এক্ষেত্রে আলোচ্য হওয়া উচিৎ নয়, আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ মেয়েটির মৃত্যু রহস্য।
আবার অনেকেই অভিযুক্ত করছেন মেয়েটির পরিবারকে! প্রশ্ন উঠতে দেখা যাচ্ছে – মেয়েটির পরিবারের প্রশ্রয় ছিলো কিনা?
সদ্যই কৈশোরের কোঠা পার করা মাত্র ২১ বছরের ছোট্ট মেয়ে মুনিয়ার অপরিণত মনের কোমল আবেগীয় অবস্থাটা কিন্তু ওইসব প্রশ্নকর্তাদের মনে কোনোরকম বিবেচনার জায়গা রাখে না। তাদের নিন্দুক মন ঘৃণায় এতোটাই ভরপুর যে তারা এমন প্রশ্নও মনে আনেন না যে একটি ২১ বছরের সদ্যগত কিশোরী হৃদয়ের আবেগীয় জায়গাটা কেমন হতে পারে। সন্দেহ আসে না যে তাকে নিয়ে আনভীর কর্তৃক খেলা হতে পারে কিনা। সেক্ষেত্রে দেখা যায় তারা একটি মেয়ের কাছে আঠারো উত্তীর্ণ হয়ে উঠবার দায়ে রাতারাতি পূর্ণ ম্যাচুরিটি দাবি করে বসেন! আবার মেয়েটির পরিবারকে দায়ী করবার ক্ষেত্রে সেটা ভুলে যান যে মেয়েটি আঠারো উত্তীর্ণ!
একজন আঠারো উত্তীর্ণ ব্যক্তি (নারী পুরুষ নির্বিশেষ) নিজের যৌন জীবন পরিচালনায় পরিবারের সম্মতি নিতে বাধ্য – এরকম ধারণা পোষণ সমাজের পক্ষে অন্যায়। অথবা বলা যায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের যৌন জীবনে হস্তক্ষেপ পরিবারের পক্ষে অশোভন। একটি সভ্য সমাজ দাবি করে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে সেইসব স্বাধীনতা পূর্ণভাবে চর্চা করতে পারবে যা কোনো প্রকার অপরাধকে সংগঠিত করে না। এক্ষেত্রে মুনিয়ার বাবা, মা আদৌ জীবিত কি মৃত সে প্রশ্নের উত্থাপন বাতুলতা।
মেয়েটি জেনেশুনে কেন বিত্তবান পুরুষের প্রেমে পড়েছে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রূপেই দেখা যায়!
আমি জানি না ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠাকে প্রশ্নকর্তারা কোনোভাবে বেআইনি বলে ধারণা পেয়েছেন কিনা! যদি তারা সেটাকে সংবিধানে নিষিদ্ধ বলেও জেনে থাকেন তবু কিন্তু সেটাকে নীতিগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে। অথচ সেটা না করে এমন সব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যা বস্তুত বেআইনিও নয়। ভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন আইনত বা ধর্মত অপরাধ তো নয়ই, বরং এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্য দূরিকরণে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। একটি সমাজের শ্রেণি বৈষম্য দূর হোক, রাষ্ট্রের সম্পদের সুষম বণ্টন হোক সেটাই তো সাধারণ মানুষের স্বপ্ন হবার কথা! রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন যখন প্রায় মৃত, তখন সম্পদের সুষম বণ্টনে অনেকটাই চমৎকার সহায়ক হতে পারতো এই সিস্টেম যদি কার্যকর হতো যে প্রতিটি উচ্চবিত্ত পুরুষ ও নিম্নবিত্ত নারী এবং প্রতিটি উচ্চবিত্ত নারী ও নিম্নবিত্ত পুরুষের মধ্যে প্রেম/বিবাহ ভিত্তিক সম্পর্কের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। যখন প্রেম বা বিবাহের ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য থেকে যায় তখন মূলত সামাজিক বৈষম্যেই বহাল থাকে। এই বৈষম্য যত বেশি ভেঙে পড়বে সেটাকে ততটা ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত হবে। সুতরাং আনভীর ও মুনিয়ার আর্থসামাজিক অবস্থানের ব্যবধানকে এক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কোনও সুযোগ নেই।
আরো একটি জনপ্রিয় প্রশ্ন হলো – মেয়েটি কি আনভীরের ‘রক্ষিতা ‘ছিলো কিনা?
মুনিয়া ও আনভীরের মধ্যে শুধুমাত্র বৈষয়িক চুক্তির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ আবেগ বিবর্জিত নিছক একটি যৌনতাভিত্তিক সম্পর্কই ছিলো কিনা তা মূলত তারা বলে দেয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কারোই সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ বা অধিকার নেই। তবে মেয়েটির আত্মহত্যা প্রমাণ করে যে তাদের মধ্যে আবেগ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই ছিলো। তবে যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয় যে মেয়েটি অনভীরের রক্ষিতাই ছিলো (অর্থাৎ কেবলমাত্র আর্থিক চুক্তির ভিত্তিতে যে যৌন সম্পর্ক), সে ক্ষেত্রেও মেয়েটি অপরাধী নয়। শুধু মেয়ে বলে নয়, যে কোনও পুরুষও যদি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে যৌনতা বিক্রি করতে চায় তা একটি নিরপরাধ উপার্জন। তবে হ্যাঁ, একজন যৌনকর্মীও যদি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষিকভাবে প্রতারিত হয় বা প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে, অপরাধ হলো সেটা।
সবার প্রথমে আমাদের স্পষ্টভাবে জানা দরকার যে ঠিক কোন কোন কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও অপরাধ। কিছু ভুল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসব ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে থাকি। এভাবে আমরা আসলে অনেক সময়ই ঘটনার মূল থেকে সরে গিয়ে এমন সব বিষয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি যা কোনোভাবেই আলোচনার মূল বিষয় হতে পারে না। অথচ আলোচনার বিষয় হওয়ার কথা ছিলো – ঘটনাটি কি হত্যা, নাকি আত্মহত্যা? প্ররোচনা নাকি ষড়যন্ত্র? দাবি আসা উচিত ছিলো একটি সুস্থ তদন্তের। অথচ এসব জরুরি কথা ফেলে রেখে আমরা এমন সব অযৌক্তিক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেই যা আমাদের শিক্ষা, বিবেচনা ও বোধ শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মধ্যযুগে নিয়ে দাঁড় করায়!