সঙ্গীতা ইয়াসমিন:
‘মুনিয়া’ পাখির নামে নাম। শুনলেই ছোট্ট, চঞ্চল, ছটফটানি একটি পাখির অবয়বই ভেসে আসে চোখের সামনে। যার স্বপ্ন ছিল দু’চোখ ভরা। ধনীর ঘরের বউ হওয়ার। মাতৃপিতৃহীন মেয়েটি নিজের সুন্দর জীবন, স্বাধীন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নষ্ট এক পুরুষের হাত ধরেছিল। জীবনাভিজ্ঞতার অভাবে সে বুঝতে পারেনি সে একটি ফাঁদে পা দিয়েছিল। সেই ফাঁদই যে হবে তার মৃত্যু ফাঁদ, সে কথা কে জানতো! সায়েম অর্থ-বৈভবে আবৃত এ সমাজের রাঘব বোয়াল। মুনিয়ার মতো চুনোপুঁটিরা রাঘব বোয়ালদের টোপে পড়ে আত্মাহুতি দেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই তো হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
প্রেম না করেও যে সমাজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে হয়েছিল নুসরাতকে, পর্দার ভেতরে নিজের সৌন্দর্য আড়াল করেও পচেছিল তনুর তন্বীলতার মত দেহ। আমরা খাদিজার কথা জানি, জানি পাঁচ বছরের শিশু কন্যা পূজার কথা, এই তালিকায় আছে পুতুল মেয়ে সায়মাও। আমরা ভুলিনি আদিবাসী কন্যা কৃত্তিকার কথাও। তবে, আমরা ভুলে গেছি সেইসব জঘন্য হত্যার সাথে জড়িত নিকৃষ্ট নরপশুদের কথা। কেননা আমরা বিশ্বাস করেছি এমন মৃত্যুর দায় নির্যাতিতের।
একটু স্বার্থপরতার সাথেই জিজ্ঞেস করছি, পাঠক দয়া করে বলবেন, ওপরের কোন মৃত্যুটি মুনিয়ার থেকে বেশি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল? কোন মৃত্যুটি দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি রাখে না? কোন মৃত্যুর দায় কেবল নির্যাতিতের ঘাড়েই বর্তায়? কিন্তু আমরা কি কোনোরূপ সাজা হতে দেখেছি? প্রতিটি ঘটনায় আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একটি বড় অংশ ভিক্টিমকে দোষারোপ করেছি। আর সেটাই আমাদের সমাজের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি। ভিক্টিম ব্লেম করে অপরাধীকে দায় থেকে মুক্তি দিয়ে দিই আমরা নিজেদের অবচেতনেই। এতে অপরাধীর কৃত অপরাধ সমাজ ও আইনের চোখে লঘু হয়ে যায়। অন্য সব অপরাধীরাও এ জাতীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে উৎসাহিত বোধ করে। বর্তমান বাংলাদেশে নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার চিত্র একথাই বলে।
সমাজ চিরকাল পুরুষের লাম্পট্যকে প্রশ্রয় দিয়েছে, দেয়নি নারীকে লাম্পট্যের বৈধ অধিকার।
ভিকটিম ব্লেমিংয়ের দায় চিরকাল দুর্বলের ওপরেই বর্তায়। মুনিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়, একটা মধ্যবয়সী পুরুষের ‘রক্ষিতা’ হয়ে লাখ টাকার ভাড়া বাসায় মুনিয়া কেন ছিল, কেন সে লোভ করেছিল? কেন যসে সম্পর্কে জড়িয়েছিল? এ জাতীয় প্রশ্ন আজ আমাদের সকলের। আমরা কেউ সায়েমের কৃত অপরাধকে আমলেই নিচ্ছি না। একটা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি হয়ে কীভাবে ‘রক্ষিতা’ রাখে, কেনই বা তাকে রক্ষিতা রাখতে হয়, কিংবা এখানে আদতেই তাঁর পরিবারের (স্ত্রী, বাবা-মা) কোনো ভূমিকার কথা উঠে আসছে না। এমনকি মিডিয়াও এ বিষয়ে ভাসুরের নাম মুখে না নেবার পণ করেছে। অপরপক্ষে মৃত মেয়েটির চরিত্রই নয় কেবল, তাঁর চৌদ্দ গোষ্ঠীর চরিত্র নিয়ে আমরা এই সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই নানাবিধ গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছি অনায়াসে। কেননা সে নারী, সে অসহায়, সে দুর্ভাগ্যের শিকার।
সমাজে নারীর অধস্তনতা, বৈষম্য, এবং সামাজিক ও আইনী ব্যবস্থার দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামোই এ অবস্থাকে নির্দেশ করে। যে সমাজ নারীকে মানুষের মর্যদা দেয়, সেই সমাজে মৃত্যু তো দূরের বিষয়, নারীর যেকোনোরূপ অসম্মানকেই বিরাট অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবং সামাজিক ঘৃণার প্রতিষ্ঠিত কৌশলও জারি থাকে। সেক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তিটি সমাজের যে স্তরেই অবস্থান করুক, আইনের চোখে সকলেই সমান।
যারা মুনিয়াকে ব্লেইম করছেন তাঁদেরকে কিছু প্রশ্ন করি, এমন একজন ধনীর দুলাল মুনিয়াকে বিয়ের প্রলোভনে ফেলে, বাসা ভাড়া করে স্বামী-স্ত্রীর মতো সংসার পাতলে মুনিয়া সেই প্রলোভন ফেরাবে কেন? এটি যদি আপনার বোন, মেয়ে কিংবা কোনো আত্মীয় হতো, তখনও কি আপনি একই কথা বলতেন? যখন এই মেয়েটির বাবা-মা, ভাই-বোন মাথার ওপরে কেউই ছিল না, তখন কি আপনি আমি কিংবা সমাজের আর কেউ তাঁর পড়াশোনা কিংবা ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলাম? কে আদতে মুনিয়ার অভিভাবক? সে যদি একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে তবে কি খুব ভুল করেছিল? সে তো ভালোই বেসেছিল! সেটাই তার অপরাধ? জানি, আপনাদের কাছে এর কোনো সঠিক জবাব নেই।
টেলিফোন আলাপে সায়েম মুনিয়াকে যে ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে এবং দোষারোপ করছে, একই শব্দচয়ন সমাজের যেকোনো পুরুষই করবে। যখন নারীটির সাথে আনন্দ করা শেষ হয়ে যায়, তাকে আর ভালো লাগে না, কিংবা সেই নারীটির কারণে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবার আশঙ্কা থাকে, তখনই পুরুষ তার আসল চেহারায় আবির্ভূত হয়। আদতে পুরুষের শরীরের কোথাও ‘হৃদয়’ বলে কোনো পদার্থ নেই। পুরুষের দু’পায়ের মাঝের কয়েক ইঞ্চি দণ্ডের অহংকারেই পুরুষ পৃথিবীকে নিজের ক্ষমতার তলে শাসন করে। যে পুরুষের দণ্ডের সাথে টাকা থাকে, সে দ্বিগুণ ক্ষমতাবান। যে পুরুষের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, সে তিনগুণ ক্ষমতাবান। অপরপক্ষে নারীর দু’পায়ের মাঝে কোনো দণ্ড নেই যা নিয়ে সে দম্ভ প্রকাশ করতে পারে।
সেখানে মুনিয়ার মতো আর্থসামাজিক অবস্থার একটা বাচ্চা মেয়েকে মাগী, খানকি বলে গালাগাল দিয়ে সায়েম কোনো ভুল করেননি, বরং সায়েমদের কাছে প্রত্যাশিত আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সে।
নারীকে অসম্মান করে কথা বলায় আনন্দ যেমন নিহিত থাকে, তেমনি শক্তি ও দম্ভের প্রকাশও যথাযথ হয়। বাঙালি সমাজে অনেক রুচিশীল (দৃশ্যত) শিক্ষিত পুরুষও সঙ্গমের সময়ে খিস্তি করে, কী অদ্ভুত! বাঙালির আনন্দ আর ক্রোধ দুই বিপরীত আবেগ প্রকাশের ভাষা একই। কেননা দুই ক্ষেত্রেই লক্ষ্যবস্তু নারী। নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবা এবং ক্ষমতাহীন ভাবনা থেকেই এই খিস্তি করে পৈশাচিক আনন্দ পায় পুরুষ নামের মনুষ্যত্বহীন ইতরেরা।
যদিও এরা আদতে কতটা পুরুষ সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যে নিজেকে পুরুষ মনে করে, সে দায়িত্ব নেয় ভালোবাসার, সে সম্মান করে নারীকে। যার পৌরুষ আছে, সে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে না। দুর্বলকে প্রলোভনে ফেলে, কৌশল করে, ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে না আস্তাকুঁড়ে। আদতেই যে পুরুষ সে প্রেম দিয়ে জিতে নেয় নারীমন। কাপুরুষেরাই মাতে অবদমনের খেলায়। এ খেলায় অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, রাজনীতির সাথে পিছিয়ে নেই ধর্মের খোলসও। সেই হিসেবে সায়েম আর মামুনুলের পার্থক্য ইতরবিশেষ। একজন ধর্মের বর্মকে ব্যবহার করছে, অন্যজন টাকার থলে।
মুনিয়ার মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটি প্রমাণ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এদেশে সায়েমদের একগাছি চুলও ছেঁড়া যাবে না। মূলত পারলেও সেই চেষ্টা কেউই করবে না। এসব ঘটনা অন্যান্য সব গল্পের মত দু’দিন পরেই আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। অন্য কোনো মুনিয়া পত্রিকার শিরোনাম হবে। আবার আমরা বসে যাবো চুলচেরা বিশ্লেষণে। কোনোকিছুই বদলাবে না এতে।
আইনের শাসনহীনতা, বিচারহীনতা এবং সমাজে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন না হলে এমন অপঘাতে মৃত্যু, ধর্ষণ, খুন, নির্যাতন বন্ধ হবে না। বস্তুত, পুরুষতন্ত্র, ক্ষমতার বৈভব, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় আইনী ব্যবস্থার ঘেরাটোপে বন্দী নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী। এ অবস্থার পরিবর্তন খুব সহজে সম্ভব নয় আজকের হেফাজতীয় বাংলাদেশে। পুরুষতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ধর্ম একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে এক্ষেত্রে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দিতে অরুচিকর, অসম্মানজনক বক্তব্য সংবলিত ওয়াজে সয়লাভ ইউটিউব, ফেজবুক। অথচ, এসব বিষয় দেখভালের জন্য সরকারি কোনো মহল আদতেই দায়িত্বে আছেন বলে মনে হয় না। কেননা রাষ্ট্রও প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষতন্ত্রকেই প্রমোট করছে।
একইভাবে মিডিয়ারও কিছু সামাজিক দায় থাকে। জনগণকে ইনফরমেশন দেওয়া, সচেতন করা, নীরব অ্যাডভোকেসি করা, জনমত গঠন করা। মিডিয়া তার দায়িত্বের জায়গা থেকে সরে এসে বাণিজ্যকেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এখানেও সেই একই কথা, মিডিয়াও তো রাষ্ট্র কাঠামোর একটি অংশ। সুতরাং একটি মেল শোভিনিস্ট সমাজে এমন মুনিয়াদের মৃত্যু এবং সায়েমদের লাম্পট্য ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক ইমেজের খুব বড় একটা ক্ষতি করতে পারে না। সেখানে মিডিয়া কর্পোরেটের হয়েই কাজ করে।
‘দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার’ শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সেই শ্রেণী বিপ্লবে ‘নারী’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সংযোজিত হলেও ইতিহাস বলে নারীকে তাঁর নিজের লড়াইটা লড়তে হয়েছে একাই। আজকের নারীদেরকে তাই বলি, নিজের পায়ে দাঁড়াও। তৈরি করে নাও, নিজের পায়ের তলার শক্ত মাটি। মৃত্যুই শেষ কথা নয়, প্রেম করো, বিছানায় যাও; বিশ্বাস করো এতে দোষের কিছু নেই। সায়েমরা যেমন খেলা ভাবে, তোমরাও খেলে যাও। তবে নিজেকে আর খেলনা হতে দিও না এভাবে।
মনে রেখো, শরীর কখনও নষ্ট হয় না। হলে তা পুরুষেরও সমান নষ্ট হয়। নারীর এই দৈহিক পবিত্রতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে নারীকেই। নইলে বদলাবে না কিছুই। বিচার চাই না সায়েমদের, চাই সায়েমদের ভোগদাসীরা দলবেঁধে দলা দলা থু থু ছিটিয়ে যাক ওদের মুখের ওপর। টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নামাক একদিন। দিনের আলোতে নিজেই নিজের মুখ দেখে চমকে উঠুক কলির এই কেষ্টরা। ততদিন, নারী, মেয়ে, যুবতী কইন্যা, তৈরি করো নিজেকে, তুমি নিজেই জানো না কী অমিত তেজ আছে তোমার ভেতরে!
সঙ্গীতা ইয়াসমিন
লেখক, টরন্টো, কানাডা।