ভালবাসায় টানাপোড়েন

নুরজাহান আক্তার দিপ্তী:

ঘরে ঢুকেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।
ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে মিলি।
এই একই দৃশ্য প্রতিদিনিই দেখছি। অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিনই দেখি মিলি টিভির সামনে। কলিং বেলের শব্দে কোনোমতে দরজাটা খুলেই আবার বসে পড়ে টিভির সামনে। মিলিকে কিছু বলি না। মনে মনে খুব রাগ হলেও কিছু বলি না। ইদানিং মিলির সাহসটা বেড়েই চলেছে। যেন সে কোন কিছুকে পাত্তা দিচ্ছে না।
আমি অফিস থেকে ফিরেছি, আর মিলি টিভি দেখছে, এমনটা আগে ভাবাই যেত না। বরং টিভি চালু থাকলে ও কলিং বেলের শব্দে মিলি দ্রুত টিভি বন্ধ করে দিত। কারণ সে জানে যে এই সময়ে টিভি দেখাটা আমার মোটেই পছন্দ নয়।

ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সারাদিনের অফিস শেষে লোকাল বাসে উঠাই মুশকিল হয়ে পড়ে। যাও বা উঠতে পারি, ভীড়ে গরমে রীতিমতো হাঁসফাস অবস্থা। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাসায় ফিরি।
বাচ্চা দুটো খেলছে। না, দুজনেই খেলছে না। মেয়েটা একমনে ছবি আঁকছে। আমার এ পাঁচ বছর বয়সী মেয়েটা ভীষণ লক্ষ্মী। এই বয়সেই সে দারুণ দারুণ সব ছবি আঁকে। আমাকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। “বাবা—দেখো—” বলে তার ছবি আঁকার খাতার দিকে ইশারা করলো। আলতো হাতে আদর করে দিলাম ওকে। পাশের রুমে ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। কী সুন্দর আর নিষ্পাপ। দেখেই মন ভালো হয়ে যায়।

মিলি এখনও টিভি দেখছে।
সারাদিন টিভি দেখা। নয়তো মোবাইলে ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকা। না, মোবাইলে শুধু ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে তা নয়। কী করে? বাচ্চাদের মতো লুডু খেলে। এই বয়সী একজন মহিলা যদি টিনএজারদের মতো প্রতিদিন বসে বসে লুডু খেলে, কেমনটা লাগে? অসহ্য! কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না।
সে তো আবার আমাকে জব্দ করার ফন্দিটা ভালোই রপ্ত করেছে।

উফ্! আমার মতো সাধারণ একজন মানুষ যে বউয়ের কাছে কতটা অসহায়!
মিলির সাথে আমার বিয়েতে দুই পরিবারের কারোরই সম্মতি ছিল না। কেবল বড় আপা মিলিকে খুব পছন্দ করেছিলেন। বড় আপা আর দুলাভাই মিলে সবাইকে বুঝিয়ে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। বড় আপার স্নেহের সুযোগটাই মিলি পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছে। এখনও করে যাচ্ছে।

সেদিন ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে একটু বিছানায় গড়াগড়ি করছি। অপেক্ষা করছি মিলির জন্য। মিলির দেখা নাই। সে ড্রইং রুমে টিভি দেখছে। ছুটির দিনে কোথায় একটু একসাথে বসে গল্প করবো। না, তা নয়। সে চলে গেল কিনা টিভি দেখতে। নাহ্। এটা মেনে নেয়া যায় না। ভীষণ বিরক্ত হলাম। উঠে গিয়ে জানতে চাইলাম – “তুমি এখানে কী করছো”?
“একটা কুইজ প্রোগ্রাম দেখছি। খুব সুন্দর।” ইতস্তত হেসে উত্তর দিল মিলি।
ওর হাসিটা যেন গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল।
“কীহ্ ? দেখতে হবে না” সারাদিন শুধু টিভি দেখা! নয়তো মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা। এতোদিন দেখতে সিরিয়াল। আজ আবার নতুন জিনিস।
রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিলাম।

মিলি প্রথমে চুপ করে ছিল। তারপর হঠাৎই রেগে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ইদানিং তাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু বললে সে আগের মতো নীরবে শুনে যায় না। ফোঁস করে উঠে। সময় সময় রীতিমতো চিৎকার করে ঝগড়া করে।

“সমস্যা কী, তোমার? টিভিতে সিরিয়াল দেখলে তোমার রাগ উঠে। আমি সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। মুভি দেখলে তোমার আপত্তি। তুমি রেগেমেগে বাজে কথা শোনাতে থাকো। আমি তোমার ভয়ে মুভি দেখি না। এখন কুইজ প্রোগ্রাম দেখছি, এটাতেও তোমার আপত্তি! কেন ?

চুপ ! একদম চুপ। যত্তসব বাজে কাজ করবে, আবার গলা উঁচিয়ে কথাও বলবে।
“বাজে কাজ ! কী বাজে কাজ করেছি আমি ? তোমাকে আজ বলতে হবে।” মিলি আরও জোরে চিৎকার করছে।
আমি টিভি দেখলে দোষ, ফেসবুক চালালে দোষ, বারান্দায় বসে থাকলে দোষ, মোবাইলে লুডু খেললে দোষ। সব দোষ আর দোষ। সারাদিন সংসারের সব কাজ আমি একা হাতে করি। সেগুলো দোষের না ? কেবল গাধার মতো মুখ বুঁজে খেটে গেলেই সব ঠিক ? আমি যখনই আমার নিজের মত করে কিছু করি, তখনই তুমি রাগারাগি করো। কেন ? আমার কোনো রিফ্রেশমেন্টের প্রয়োজন নাই ?”

– মিলি সমানে চিৎকার করেই চলেছে। যেন অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ সে আজ উগলে দিচ্ছে।
মিলির চিৎকার শুনতে শুনতে আমার রাগ চরমে উঠে গেল। আর সহ্য করতে পারলাম না। ঠাস্ করে চড় মেরে বসলাম। ধাক্কা দিয়ে সোফায় ফেললাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম -“দূর হ আমার ঘর থেকে! এতো যদি নিজের ইচ্ছামতো চলতে চাস তাহলে আমার ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে যা ইচ্ছা তা কর।
সংসারের কাজ শুধু কি তুই একা করিস? এদেশের আর কেউ করে না? কী এমন গাধার মতো খেটে তুই উল্টাই ফেলেছিস? তোকে আমার লাগবে না তুই বের হয়ে যা আমার ঘর থেকে।”
রাগে যেন অন্ধ হয়ে গেলাম। গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।

কতক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। ভালো লাগছে না।
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম আসছে না। এলোমেলো নানা ভাবনায় পেয়ে বসলো। এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছি।

মিলির সাথে রাগারাগি করা, তুই তোকারি করা দু’এক বার হলেও এই প্রথম ওর গায়ে হাত তুললাম। নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। একবার মনে হলো গিয়ে ওকে শান্ত করি। স্যরি বলি। পরক্ষণেই মনে হলো – দরকার নাই। বেশি পাত্তা দিলে মাথায় চড়ে বসবে।

পরদিন সকালে প্রতিদিনের মতোই সে সব কিছু করলো। বাচ্চা দুটো তখনও ঘুমাচ্ছে। আমি অফিস যাবার জন্য রেডি হয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। তখনই মিলি এসে দাঁড়ালো। আস্তে করে বললো – “এখানে বাবুর খাবার রেডি করে রেখেছি। ঘুম থেকে উঠলে খাইয়ে দিও। ওদের সবকিছু আমি গুছিয়ে রেখেছি, সমস্যা হবে না। আমি গেলাম।”
চোখ বড় হয়ে গেল আমার। “কীহ্ ? গেলাম মানে? নাটক করো? কোথায় যাচ্ছো তুমি? আর বাবুকে আমি খাওয়াবো মানে? আমি অফিসে যাবো না?”
মিলি আমার কোন কথারই উত্তর দিল না। সোজা বের হয়ে গেল।
আমি থ হয়ে রইলাম। এটা কী হলো? সে কোথায় গেল? বাপের বাসায়? জাহান্নামে যাক।
মেয়েটার ঘুম ভেঙেছে আগেই। মাকে চলে যেতে দেখে গুটিগুটি পায়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। বললো – “ বাবা, মা কোথায় যাচ্ছে ?”
কী বলি আমি!

কোনো মা তার বাচ্চাদের ফেলে রেখে এভাবে চলে যেতে পারে তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। চিরকাল দেখে এসেছি মায়েরা সন্তানের জন্য রীতিমতো ফাইট করে। যত যাই হোক সন্তান নিজের কাছে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।
আর মিলি? সে কিনা বাচ্চাদের ফেলে রেখে চলে গেল? মিলি তো এতো কঠোর কখনও ছিল না! দু’ বছর বয়সী দুধের বাচ্চাটার জন্যও তার মায়া হলো না? এ কোন্ মিলি? আমি যেন মিলাতে পারছি না।
এখন আমি কী করবো? অফিসে যাবো কীভাবে বাচ্চাদেরকে রেখে?

সবকিছুর একটা সীমা থাকা দরকার। মেজাজ চরমে উঠে গেল। সেদিন আর অফিস যাওয়া হলো না। দু বছরের ছেলেটা ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই মায়ের জন্য কান্না শুরু করেছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। খুব চেষ্টা করেও তাকে কিছু খাওয়াতে পারছি না।
উফ্! কী যে করি ? আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য বাচ্চাদেরকে এভাবে কষ্ট দেওয়া? আমি তাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না। কী বোঝাতে চাইছে সে আমাকে? সে সংসারের জন্য কত কাজ করে, সেটা? তাকে ছাড়া আমি সংসার সামলাতে পারবো না? আরে বাবা, কেউ বাইরে চাকরি বাকরি করবে আর কেউ ঘরে সংসার সামলাবে এটাই তো নিয়ম। তুই তো আর স্পেশাল কিছু করছিস না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আবারও মেজাজ খারাপ হলো।

ফোন করলাম শাশুড়ীকে। আজ শাশুড়ীকে তাঁর মেয়ের এমন বেলেল্লাপনা নিয়ে দু’চার কথা না শোনালেই নয়। কোন্ সংসারে এমন স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয় না ? তাই বলে এই ছোট ছোট বাচ্চা ফেলে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠবে ?
ফোন পেয়ে শাশুড়ী তো খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। মিলি সেখানে যায়নি। কেন, কী হয়েছে, কোনো সমস্যা কিনা শাশুড়ী বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন। বললাম, “কোনো সমস্যা হয়নি, পরে জানাবো।”

মিলি বাবার বাসায় যায়নি। তাহলে সে গেল কোথায় ? কোনো বান্ধবীর বাসায় ? নাহ্। সে সম্ভাবনা নাই। মিলির এমন কোনো বান্ধবী নাই যার বাসায় গিয়ে মিলি থাকতে পারে।
পরদিনও অফিসে যেতে পারলাম না। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়লাম বাবুকে কী খাওয়াবো তা নিয়ে। মিলি ওর জন্য কীসব খাবার রান্না করে তাতো আমি জানি না। আমার লক্ষ্মী মেয়েটা খুব বড়দের মতো করে আমাকে বলে দিচ্ছিল তার মায়ের মতো করে কী কী করতে হবে। আমিও যেন বাধ্য ছেলের মতোই সব করে যাচ্ছি।
নিজের জন্য, বাচ্চাদের জন্য এক এক রকম খাবার কাটা-বাছা করা, রান্না করা, বাবুটার ডায়াপার চেঞ্জ করা, বাচ্চা দুটোকে গোসল করানো, বাবুকে খাইয়ে দেওয়া, সব ধোওয়া পালা করে রাখা ইত্যাদি যেন এক একটা অসাধ্য সাধন করে চলেছি। জান শেষ।
ঘর দরজা পরিপাটি করা, বেসিন-বাথরুম পরিষ্কার করা আরও কত কত কাজ সব পড়ে রইলো। পারছি না আর।

আমাকে জব্দ করার জন্য মিলি কি আর কোনো উপায় খুঁজে পেলো না? এভাবেই আমাকে জব্দ করতে হবে?
কিন্তু এভাবে আর কত? আমি কী রোজ এভাবে অফিসে না গিয়ে পারবো?
কোথায় গেল মিলি? বড় আপার ওখানে নয় তো?

বড় আপাকে ফোন করলাম। মিলি আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই শুরু হয়ে গেল বড় আপার রীতিমতো গর্জন। “কী দরকার মিলিকে? তোর তো ওকে লাগবে না বলেছিস। ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিস। ও বের হয়ে গেছে। এখন আবার খুঁজছিস কেনো ?”
বড় আপা, প্লিজ। এমনিতেই আমি খুব যন্ত্রণায় আছি। বাচ্চারা ওদের মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছে। তিনদিন যাবত অফিসে যেতে পারছি না। প্রাইভেট ফার্মের চাকরি। এভাবে অফিস কামাই করলে চাকরিটা আর থাকবে না। বুঝতে পারছি ও তোমার ওখানে। ওকে বোঝাও, প্লিজ।

“ওকে, বোঝাবো? কী বোঝাবো? তুই নিজে বুঝেছিস তো? বাচ্চা সামলানো, সংসার সামলানো এতো সোজা? তুই যখন তখন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবি, গায়ে হাত তুলবি, আর ও মুখ বুঁজে তোর সংসার সামলাবে? আমিই ওকে বলেছি এখানে চলে আসতে। আর বলেছি ভুলেও যাতে বাচ্চাদেরকে না আনে। বাচ্চাদেরকে নিয়ে এলে তোর তো পোয়াবারো। বেচারি তোর বাচ্চা সামলাবে, আর তুই গায়ে হাওয়া লাগায়ে চলবি। বাহ্! মহাসুখ, না?
আর এ মেয়েটাও, এতো নরম মন! আসা অবধি শুধু কেঁদেই চলেছে বাচ্চাদের জন্য। তোদের মতো পুরুষরা কবে বুঝবে যে মিলিরা আছে বলেই তোদের সংসারটা এমন সুন্দরভাবে চলছে? আরে ও ওতো একটা মানুষ। ওর নিজের বলতে কি কোনো ইচ্ছা থাকতে পারে না?”

চুপচাপ বড় আপার কথাগুলো হজম করছিলাম। অসহায়ের মতো কাতর স্বরে বললাম – “বড় আপা, প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। ওর গায়ে হাত তোলাটা আমার ঠিক হয়নি।”
“সেটা আমাকে বলছিস কেনো? ওকে বল। তুই এসে ওকে বুঝায়ে নিয়ে যা।”

আর অপেক্ষা করলাম না। তখনই রেডি হয়ে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বড় আপার বাসায় গেলাম। বাচ্চাদেরকে দেখেই দৌড়ে আসলো মিলি। ওদেরকে জাপটে ধরে কান্না জুড়ে দিল।
বড় আপা আবারও শুরু করলেন। মাথা নিচু করে আর এক চোট বড় আপার বকাবকি সহ্য করলাম।

মিলিকে নিয়ে বাসায় আসলাম। মিলি এখন পর্যন্ত আমার সাথে একটি কথাও বলেনি। আমিও বলছি না। তার তো আমাকে দরকার নাই। পাষাণের মতো যে কিনা দুধের বাচ্চা ফেলে চলে যেতে পারে তার সাথে আমার কথা বলার দরকার নাই। ফিরে এসেছে, বাচ্চা সামলাচ্ছে, সংসার সামলাচ্ছে এটাই যথেষ্ট।
এখন মিলি তার ইচ্ছেমতো চলে। ইচ্ছা হলে টিভি দেখে, মোবাইলে গেম খেলে ইত্যাদি যা ইচ্ছা। যেন আমার সাথে কথাবার্তা না থাকায় তার সুুবিধাই হয়েছে। কেবল যতটুকু প্রয়োজন মুখ গম্ভীর করে ঠাণ্ডা স্থিরভাবে ততটুকু সে বলে। তার বেশি নয়।

প্রতিদিনের একই রুটিন। আমি অফিস থেকে ফিরে গোসলে ঢুকলে মিলি নাস্তা এনে রাখে টেবিলে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি টেবিলে নাস্তা দেওয়া। মিলি রান্নাঘরে চা করছে। নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই চা এনে দিবে। একটি কথাও বলবে না।
ভালো লাগছে না। এভাবে আর কতদিন? কেউ কারও সাথে কোনো সম্পর্কই যেন নেই। মিলি যেন কেবল তার রুটিন ওয়ার্ক করে যাচ্ছে। দিন দিন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। এভাবে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা ঠিক হচ্ছে না। বাচ্চা দুটোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সন্দেহ নাই।
একটা সময় মিলি আমাকে এতোটাই ভালবাসতো যে আমি কী চাই, কী পছন্দ করি আর না করি সেটাই তার কাছে প্রাধান্য পেত। মন – প্রাণ ঢেলে সে কেবল আমাকে খুশি করার জন্যই সবকিছু করতো। প্রাণ খুলে হাসতো, ভালবাসত মন উজাড় করে।

ধীরে ধীরে আমি কখন এতোটা রুক্ষ হয়ে গেলাম যে মিলি একটা সময়ে এসে আমাকে যতটা না ভালবাসতো, তার চাইতে ভয় পেতে শুরু করলো বেশি। আর সে ভয়টাই এখন যেন পরিণত হয়েছে ঘৃণার আর তাচ্ছিল্যে। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয় বা হওয়া উচিত নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমি তো মিলিকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। সে ভালবাসার ছিটেফোঁটাও কি অবশিষ্ট নেই? নিজের মনেই প্রশ্ন করি।
যে মেয়েটা আমাকে ভালবেসে সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছিল তাকে এতোটা অবহেলা ভাবতে গিয়েই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। যে আমার জন্য, আমার সংসারটাকে আগলে রাখার জন্য দিনরাত এতোকিছু করে চলেছে, তাকে কি আমি একটু আদর ভালবাসা দিতে পারি না ? ঠিক আগের মতো করে ? সংসারের জন্য, বাচ্চা দুটোর জন্য, সর্বোপরি নিজের শান্তির জন্য মিলিকে ভাল রাখা, ভালবাসা খুব জরুরি। নিজের মেজাজটাকে ঠান্ডা রেখে শান্তির সুবাতাস বয়ে আনার চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।

বেসরকারি অফিসের জন্য খাটতে খাটতে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে বউকে ভালবাসা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি। নিজের চারপাশে যেন মিথ্যে অহংবোধের এক দেয়াল তুলে দিয়েছি। মিথ্যে অহংবোধ নিয়ে চলার চাইতে মিলিকে স্যরি বললে, কাছে টেনে নিলে কী এমন ক্ষতি।
মিলি চা রেখে চলে যাচ্ছিল। ওর হাতটা ধরলাম। নরম সুরে বললাম – “ এভাবে আর কত দূরে সরে যাবে বলো? আমার ভুল হয়েছে। আমার উচিত হয়নি এমন করা। আমি বুঝতে পারছি। খুব খারাপ লাগছে আমার। আর এমন হবে না কথা দিচ্ছি। স্বাভাবিক হয়ে যাও প্লিজ।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো মিলি। দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে অশ্রুকণা। ওকে কাছে টানলাম। অঝোরে কাঁদছে সে।
বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল আমার। এ তো সে যাকে পাওয়ার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আহ্ কী করেছি আমি? আমি ফিরে পেতে চাই সেই দিনগুলো। ভালবাসা চাই আর ভালবাসতে চাই পুরনো সেই দিনগুলোর মতো করে।
কাছে টেনে বহুদিন পরে পরম মমতা আর ভালবাসায় জড়িয়ে ধরলাম তাকে, আমার মিলিকে।

শেয়ার করুন: