প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে …

সুপ্রীতি ধর:

আজ কদিন ধরেই এই গানটা বার বার অনুরণিত হচ্ছে মনে…

সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে-
চাঁদের আলোর দেশে গেছে
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে-

…গানটা শুনছি আর অঝোরধারায় গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে কান্নার জল। এ কেমন কাল এলো, যখন প্রতিরাতে ঘুমাতে যাই এক অমোঘ বেদনা নিয়ে, শংকা নিয়ে, এই বুঝি কোন তারা খসে গেল নক্ষত্রপুঞ্জি হতে! সকালে ঘুম ভাঙে আরও এক আশংকা নিয়ে। ভয়ে ভয়ে ফেসবুকে চোখ রাখি। দ্রুত চলে যাই নিউজফিড থেকে, যেন আমার চোখ সরে গেলেই সব শংকা মিথ্যা হয়ে যাবে! যেন সব ভালো খবর একযোগে এসে ধরা দেবে মোবাইল স্ক্রিনে।

না, তা হয় না। বুকের পাশ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বন্ধু, স্বজন, স্ত্রী, স্বামী, সন্তানকে। মুহূর্তেই বিছানা খালি হয়ে যাচ্ছে, পাশে রাখা বালিশটা গুছিয়ে তোলার আগেই শূন্য হয়ে যাচ্ছে। হয়তো টেবিলে তখনও আ-ধোয়া প্লেটটা ওভাবেই পড়ে আছে, কিন্তু মানুষটা যে হাসপাতালে গেল নিজে থেকে, আর ফিরতে পারলো না, সেখান থেকে চলে গেল অজানা ঠিকানায়। আলমারিতে, হ্যাঙ্গারে ঝুলানো কাপড়গুলো ঠিকই থাকছে, শুধু সেই কাপড়ের মালিকেরা নাই হয়ে যাচ্ছে। এই যে একটা ভয়াবহ ট্রমা গ্রাস করছে পুরো জনপদ, বিশ্বকে, সমাজ-রাষ্ট্রকে, এই ট্রমার শেষ কোথায়? কীভাবেই বা হবে এর চিকিৎসা? কী ভয়াবহ, ধারণা করা যায় একবারও?

সময়টা আমাদের অনুকূলে নেই একেবারেই। প্রতিদিন কারও না কারও প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় ভারাক্রান্ত ফেসবুক। অথবা অসুস্থতার খবর আসে, করোনা পজিটিভ হয়ে দিশেহারা লোকজন আইসিইউ খোঁজে। এক সন্তান তার মায়ের মৃত্যুশয্যায় নিজের জীবনের আয়ু থেকে ৪০টি বছর মাকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কী আকুতি সন্তানের! এক কবি তার মায়ের জন্য কোথাও হাসপাতালের বেড না পেয়ে ফেসবুকে লিখেন, ‘আমার মাকে কি আমি বাঁচাতে পারবো না? আমার জীবনের বিনিময়ে আমার মাকে কি কেউ একটা আইসিইউ বেড দিতে পারেন?’ হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় এসব লেখা পড়ে। একটা বেড খুঁজতে থাকে সবাই, এমন সময়ই খবর আসে, আর লাগবে না মায়ের জন্য বেড। মা সবাইকে দায়মুক্ত করে গেছেন। সেই সন্তানের মুখটি আমার একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

আমার এক সাবেক সহকর্মির স্ত্রীও একটি টিভি চ্যানেলের প্রযোজক। কোভিড আক্রান্ত হয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হেরে গেছে। রেখে গেছে সদ্যজাত কন্যা ছাড়াও আরও দুজন তিন বছর বয়সী যমজ ছেলে। সাবেক সহকর্মিটিও পজিটিভ, সেইসাথে তার মা-ও পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে। সেই পরিবারটির কথা ভাবতেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।

এক সাংবাদিক সহকর্মি মায়ের সাথে আইসিইউতে রাত জাগে। সেখানে সে প্রতিদিন অসংখ্য আর্তের করুণ মুখ দেখে একটি বেডের আশায় অপেক্ষারত। তারা তীর্থের কাকের মতোন অপেক্ষা করে একটি বেড ‘যেকোনোভাবেই’ খালি হলে নিজের মা অথবা বাবাকে সেখানে ভর্তি করাতে পারবে। সেই যেকোনোভাবে খালি হওয়া বেডের রোগীটি ততক্ষণে লাশ হয়ে গেছে, আর তার স্বজনরা আরও কুঞ্চিত, আরও অসহায় হয়ে হাসপাতালের ভয়াবহ অংকের বিল গুনছে। বেড খোঁজার সময় স্বজনের সুস্থতাটাই যখন মুখ্য ছিল, টাকার কথা কেউ ভাবেইনি, কিন্তু স্বজনের মৃত্যুতে সেই ‘হাসপাতাল বিল’ তখন জীবনের সবচেয়ে ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সেই বেডে নতুন রোগী উঠানো হয়ে গেছে। কে জানে, সেই রোগী সশরীরে ফিরবে বাসায়, নাকি আগের রোগীর মতোই তার পরিণতি হবে!

এমন সব কষ্টকর গল্পগুলো আমরা প্রতিদিন পড়ি এই ফেসবুকেই। আর নিজেদের প্রিয়জনদের মুখগুলো ভাসে চোখের সামনে। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলানো গেলেও এই তরঙ্গে হাল ধরে রাখা যাবে তো? প্রচণ্ড অসহায় আমরা এখন। কানাডার টরেন্টোর হাসপাতালেও শুনেছি ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা। করোনা টেস্টের লম্বা লাইন। সেই লাইন ভেদ করা সবার সাধ্যে নেই। সেখানেও আইসিইউ, ভেন্টিলেশনের অভাব। একটুখানি শ্বাস নেয়ার জন্য মানুষ এখন ছুটছে। ব্রাজিলে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজারও মানুষ।

পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন ধ্বংস করার কতরকমের পাঁয়তারা চলছে, বনাঞ্চলগুলো বিশ্বজুড়ে ধ্বংস করে সেখানে সভ্যতার নামে কংক্রিটের জঞ্জাল গড়ে তোলা হয়েছে। মানুষেরই হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবেশ এখন ষোল আনা পুষিয়ে নিচ্ছে। কৃত্রিম অক্সিজেন নিতে মানুষ এখন মরীয়া।

হায় সভ্যতা! মানুষের লোভের কাছে মানুষই আজ বড় জিম্মি।

এর মাঝেই গত এক সপ্তাহে আমরা মানে বাঙালীরা হারিয়ে ফেলেছি বেশ কজনকে, যাদের আরও অনেক বছর বেঁচে থাকাটা জরুরি ছিল। প্রথমে গেলেন শুদ্ধ সংস্কৃতি ও শুদ্ধ গানের মানুষ, রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী মিতা হক, আর গতকাল শুক্রবার গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তীতুল্য অভিনেত্রী কবরী। মিষ্টি হাসির জন্য বিখ্যাত সেই মিষ্টি মেয়ে কবরী। পেশাগত কারণেই এই দুজনের সাথে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, এমনকি সখ্যতাও হয়েছে। প্রতিদিনের অসংখ্য মৃত্যুর ভিড়েও এই দুটি মৃত্যু আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। এলোমেলো হয়ে গেছে আমার বিদেশ জীবনও। পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারছি না। দুজনের মৃত্যুই বাংলা ও বাঙালীর জন্য এক ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেল। মিতা হক এদেশে রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছিলেন। আর অভিনেত্রী কবরী তার নিজস্ব অভিনয় দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে মুমূর্ষুপ্রায় চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে যখন অশ্লীলতা ভর করলো, তখন তার সোচ্চার ভূমিকা ছিল। রাজনীতিতে বেশিদিন না থাকলেও মনেপ্রাণে তিনি একজন রাজনীতি সচেতন ছিলেন। এসবই আমাদের জানা।

কিন্তু যে কবরী একসময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন, এদেশে সুস্থ চলচ্চিত্রের ধারা বজায় রেখেছিলেন নিপূণ অভিনয় দক্ষতা দিয়ে, সেই মানুষটি ভিতরে ভিতরে কতটা ‘একলা মানুষ’ ছিলেন, সেটা জেনে আমরাও ভেঙে পড়ি। নিজেকে এক লহমায় তার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখতে পাই সেই একাকিত্বকে। যখন তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমার একটা দু:খ রয়ে গেল, জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না, ভালো স্বামী পেলাম না….সঙ্গ দেয়ার মতো একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি’…আমি যেন নিজেকেই দেখতে পাই। শুধু আমি নই, হাজারও মেয়ের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেন তিনি। অথচ এই কবরীকেই আমরা দেখেছি নারায়ণগঞ্জের ত্রাস শামীম ওসমানের মতোন মানুষের সাথে রাজনীতির নামে টেক্কা দিতে, মনোনয়ন পাওয়ার কারণে যখন খ্যাতিমান অথচ প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের পক্ষ থেকে ডিভোর্স লেটার পান, সেটা তাকে টলাতে পারেনি নিজ সিদ্ধান্ত থেকে, বরং তিনি তা মেনে নিয়ে নিজের কাজটুকু অক্ষুন্ন রাখেন। এখানেই কবরী অনন্য হয়ে উঠেন অন্য আর দশজনের চাইতে।
তাইতো তাদের বিয়োগব্যথায় প্রচণ্ড কাতর হই।

সেইসাথে এই কামনাটুকুই অব্যাহত রাখি, পৃথিবীর এই অসুখ সেরে যাক যত দ্রুত সম্ভব। পৃথিবী শান্ত হোক। এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হোক শিগগিরই। আর নেয়া যাচ্ছে না এর বোঝা। ধারণাও করতে পারছি না কোভিড পরবর্তি বাংলাদেশে কারা টিকে থাকবে!

সবাই সাবধানে থাকবেন। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সচেতন হোন, বেঁচে থাকুন। আর কাউকে হারাতে চাই না। যারা বেঁচে থাকে, তাদেরকে এই শাস্তিটুকু না দিলেই কি নয়?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.