নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও স্বাধীনতা

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা:

সমাজে আচরিত বিভিন্ন দর্শনে নারী-পুরুষের সামাজিক যে একত্রবাসের রীতি, তাতে নারীর জন্য বিদ্যমান অসম্মানগুলো অনুধাবনের বিষয়টি এত গৌণ কেন থাকে; তা সাধারণ্যের মাঝে সহসাই অনুধাবিত হয়ে ওঠা কঠিন। কারণ এই কঠিন হয়ে ওঠার পেছনে কার্যকর থাকে প্রতিটি সমাজের মধ্যস্থিত নানাবিধ পুরুষতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি ও আচরিত বিধিব্যবস্থার জটিল বাতাবরণ!

বিষয়টিকে সহজ করে উপস্থাপন করা যায় এভাবে, নারীর জন্য সমাজ যে নিয়ম বানিয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত নিয়ম বানিয়েছে পুরুষের জন্য। নারী এক পুরুষ ভিন্ন অন্য পুরুষে গমন করলে সমাজ দূষিত হয়। আর পুরুষ এক নারীতে কখনও সুখি হয় না। ধর্ম তাদের বহুগামী হওয়ার বৈধতা দিয়ে রেখেছে। ধর্মীয় বৈধতা ছাড়াও সে বহু নারীতে গমন করে।… এ এক অদ্ভুত স্বৈরাচারী সমাজে আমাদের বাস। যেখানে পুরুষ ইচ্ছেমতোন বিচরণ করতে পারে কিন্তু নারী নিজের সুখের কথাও বলতে পারবে না। তাকে প্রতিনিয়ত থাকতে হবে সততার আচ্ছাদনে, কিন্তু পুরুষ বহুগামী হবে নিয়মে ও নিয়মের বাইরে। (অনন্য আজাদ, ২০১৫: পৃষ্ঠা-১০৩)

নারী হোক কী পুরুষ, সবারই তার সঙ্গীর সাথে একত্রবাসের একটা ভদ্রসম্মত চুক্তি থাকাটা স্বাভাবিক ও সভ্যতার নির্ধারিত স্মারক। তবে যদি পাশ্চাত্যের উন্মুক্ত সম্পর্ক বা Open relationship এর আদলে কোনো সম্পর্কে কেউ কারোর সাথে জড়িত থাকে এবং তা স্বেচ্ছায়, তা নিয়ে কিছু বলার সেভাবে থাকে না। সেক্ষেত্রে উক্ত সম্পর্কে যুক্ত যেকোনো পক্ষই আলাদা আলাদা সম্পর্কে থেকেও একত্রবাস করতে পারে বলে জানা যায় এবং তাতে উভয়পক্ষই মুক্ত-স্বাধীন, কেউ কারোর নিজেদের ভিন্ন অপরাপর সম্পর্কের ব্যাপারে নাক গলাতে যায় না; সোজা কথায় সঙ্গীর পরকীয়া নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের আচরিত কোনো দর্শনেই কি সেরকম কিছু আছে? যদি থেকে থাকে এবং তাতে উভয়পক্ষের জন্যই সমান সুযোগ বিদ্যমান থাকে, তবে কিছু বলার নাই। কিন্তু যদি না থাকে, তবে অবশ্যই আপত্তি থাকার নানাবিধ কারণ থেকে যায়।

একইভাবে সম্পর্কছেদের ক্ষেত্রেও প্রসঙ্গটির যে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট, তা নিয়েও বলার অনেক সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বেগম রোকেয়ার একটি পর্যবেক্ষণ এখানে প্রণিধানযোগ্য, “বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা? অন্তত এইটে তো প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই দেখা যায়” [মিজান রহমান(সম্পা.), ২০১৩: পৃষ্ঠা- ২৭৫]। এধরনের বিভিন্ন প্রেক্ষিত বিবেচনাতেই বুঝি এখন সনাতন বহু আচরিত দর্শনগুলোকে বর্তমান দুনিয়া বাতিল করে দিয়েছে, অপরপক্ষে যেসব টিকে আছে তা নিয়েও উচ্ছ্বাস কমেছে বৈ বাড়েনি বলেই ধারণা করা যায়।

ভিন্ন আরেকটি বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে~ বর্তমানে জনপ্রিয়তায় প্রথম দিকে থাকা আচরিত দর্শনগুলোর কোনো কোনোটিতে দেখা যাচ্ছে অবারিত সঙ্গমের সুযোগকে নিয়ন্ত্রিত করে, পুরুষের পক্ষে বহুগামিতার কিছু সুযোগ রেখে তাকে নাম দেয়া হয়েছে তুলনামূলক সভ্য পন্থা এবং দাবি করা হচ্ছে এটাই সত্য ও ধ্রুব পন্থা। এ নিয়ে বিতর্কে না গিয়েও কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করা বর্তমান বাস্তবতায় অপ্রাসঙ্গিক নয় (যেহেতু বিতর্ক করার সুযোগ রাখা নেই অধিকাংশক্ষেত্রেই, তবুও বলার অবকাশ আছে) যে, সঙ্গী পুরুষের জন্য যখন নারীসঙ্গীর অজান্তে বহুগামিতায় লিপ্ত হওয়ার কিংবা অনুমতিসহ বা অনুমতি ব্যতীত বহুগামী সম্পর্কে জড়ানোর বিধান রয়েছে, তবে সঙ্গী নারীর ক্ষেত্রেও কেন সেরকম বিধি উন্মুক্ত থাকার বিধান অধিকাংশ দর্শনগত রীতিপদ্ধতিতেই রাখা হয়নি? তবে কি নারীর মন বহুগামী নয়, নাকি নারীর বহুগামী হওয়ার বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক (পুরুষতান্ত্রিক নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত) সমাজ সহ্য করতে অপারগ? অথচ বিজ্ঞান কিন্তু ইতোমধ্যেই বহুগামী হওয়ার ব্যাপারে লৈঙ্গিক যেকোনো বাধ্যবাধকতা থাকার বিষয়কে প্রামাণ্য যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করেছে। বিজ্ঞান একে ব্যাখ্যা করেছে এভাবে,
নারী ও পুরুষের মধ্যে মূলত কোনো শারীরিক পার্থক্য নেই, বিশেষ করে শরীরের অভ্যন্তরে যা ঘটে চলেছে তাতে নারী ও পুরুষ পৃথক নয়। এই তত্ত্ব অনুসারে যৌনপুলকের বিষয়টি রাসায়নিক; নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে একইধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটায়। যৌনতা ও নারী-পুরুষকে এখন আর পুরুষ/পৌরুষত্ব এবং নারী/নারীত্ব এরকমভাবে ভাগ করে দেখা যাবে না।(মাসুসুজ্জামান, ২০১৩: পৃষ্ঠা-১৮৮)

তাই উপরের সূত্র ধরে এই প্রশ্ন করাই যায়, নারীর যৌনতার বিষয়ে বা অপরাপর অন্যান্য অধিকারের বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকায় থাকা সমাজ বা সুনির্দিষ্টভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনুঘটকেরা আসলে কে? আর কেনইবা তারা অপারগ? উল্লেখ্য এরকম আরও বহুবিধ অপারগতার বিধিব্যবস্থা পুরুষতন্ত্রের রয়েছে, যা নারীর জন্য অবমাননাকর, অর্থাৎ নারীসংবেদী নয়। যার খানিকটা উল্লেখ করা যায় এভাবে,
হিন্দু আইন যদি কন্যাকে পূর্বপুরুষের সম্পত্তির সমান অংশ না দেয়-
মুসলমান আইন যদি নারীকে তালাক দেওয়ার অধিকার না দেয়-
খ্রিস্টান আইন যদি যৌন আচরণের ক্ষেত্রে দুমুখো নীতি বজায় রাখে-
সংবিধান নিরুপায়, রাষ্ট্র ঠুঁটো, কারণ ধর্মের স্বাধীনতায় তারা হাত দেবে না।
(মল্লিকা সেনগুপ্ত, ২০১৭: পৃষ্ঠা- ১০৩)

উপরি উল্লেখিত চর্চা ও বাস্তবতার ইতিহাস সৃষ্টির পেছনের প্রেষণা সম্পর্কে তাই ভার্জিনিয়া উলফের মন্তব্যটি এখানে উল্লেখ করা যায়, “নারীবিষয়ক জ্ঞানে পুরুষ নিছকই আংশিক ও সাংঘাতিকভাবে সীমাবদ্ধ”(আলম খোরশেদ, ২০১২: পৃষ্ঠা-৭৮)।

অন্যান্য বহুকিছু বাদ দিয়েও যদি কিছু নির্দিষ্টক্ষেত্রে এই প্রশ্ন তোলা যায়, যেমন নারীর বহুগামিতার ইস্যুতে যদি প্রশ্ন করা যায় যে~ পুরুষের কি এটা ভাবতে খারাপ লাগে যে তার সঙ্গিণী নারী বহুগামী? আর সেরকম ক্ষেত্রে কি তারা প্রতারিত বোধ করে নারী চাহিদার বহুগামিতায়? তো প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে যে, পুরুষের বোধেই কি কেবল খারাপ লাগার অনুভূতি কার্যকর? তাদের মাঝেই কি শুধু প্রতারিত বোধ করার অনুভূতি ক্রিয়াশীল? নারীর বুঝি সেসব অনুভূতি নেই বা শূণ্য? নারী কি এক্ষেত্রে প্রতারিত বোধ করে না? নারীর এসব অভিজ্ঞতায় কি খারাপ লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয় না? এমন প্রশ্নের উত্তর যদিও পাওয়া যায় না সংশ্লিষ্ট কোনো আচরিত ব্যবস্থাতেই, কিন্তু নারীর জন্য সুযোগ-সুবিধায় কৃচ্ছতাসাধনের পাশাপাশি দেয়া রয়েছে হরেকরকমের বাধানিষেধ ও দণ্ডের ছড়াছড়ি। এই বাস্তবতার নিরীক্ষে নারী জীবনাভিজ্ঞতাকে যেভাবে উঠে আসে, তা পূর্ণশশী দেবীর আত্মজীবনীতে খানিক আভাস পাওয়া যায়-
বিশ্বনাথের পূণ্যরাজ্যে ভণ্ডামি, প্রতারণা, ব্যভিচার পাপে কণ্টকিত আপাদমস্তক। বিশেষ করিয়া নারীর লাঞ্ছনা, অপমান ও নির্যাতন এখানে যেমন দেখিয়াছি তেমন আর কোথাও দেখি নাই, কত পতিতা ও স্বামী-পরিত্যক্তা নারী এখানে কত যে…বিশ্বনাথের আশ্রয়ে থাকিয়া কেহ পাপক্ষয় করিতেছে আবার কেহ পাপের ভরা বৃদ্ধি করিতেছে (জয়িতা দাস, ২০১৭: পৃষ্ঠা-২০৮)।

এমনতর বহু বাস্তবতার আলোকে বলতে হয়, নারীজন্মই যেন সামাজিক সমস্ত পাপের বোঝা বহন ও তার শাস্তি পাওয়ার জন্য বলিকৃত। কারণ সমাজের দন্ডমুন্ডের রায়ে নারীই যেকোনো দায়ে দন্ডিত, নিপীড়িত, নারীই পতিত, নারীই প্রতারিত। কিন্তু নারীকেই কেন বারংবার প্রতারণার শিকার হতে হয়? নারীকেই কেন মেনে নিতে হয় এই প্রতারণার শিকার হওয়াই তার নিয়তি, এমনকি প্রতারিত হওয়ার চূড়ান্ত নির্মম শাস্তিও ঘাড়ে এসে পড়ে নারীরই উপর এবং এসবই চূড়ান্ত ক্ষমতাদন্ডের বিধান! বিচারকের এই একপাক্ষিকতা কি তবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না?

সাধারণজ্ঞান কী বলে? বিচারকের তো একপাক্ষিক হওয়ার কথা নয়, তাহলে কি বিচারকের বিচার যাঁরা ব্যাখ্যা করছেন ওনারা তাঁকে ভুলভাল ব্যাখ্যা করছেন? তবে কি তারা একপাক্ষিক এবং পুরুষের পক্ষের? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে কি সাধারণ্যে এই সমস্ত চর্চা যে এত জনপ্রিয়; এই জনপ্রিয়তার মূল থেকেই কি উৎসারিত এধরণের বিচারিক দন্ড নির্ধারণের প্রেষণা? তবে কি সমাজটাই এরকম একপাক্ষিক, একচোখা? যাদের বলা যায় লৈঙ্গিক অসংবেদী সমাজ, সহজ কথায় পুরুষতান্ত্রিক? এই বাস্তবতাকে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “তার প্রজাতির শিকার সে। পুরুষটি প্রেম করে চলে গেছে অন্য কোনো রূপসীর কাছে, আর ওর উপর ভার পড়েছে প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখার(হুমায়ুন আজাদ, ২০১৪: পৃষ্ঠা-৩০)”।

অন্যদিকে উল্লেখ্য, সমাজনির্ধারিত বিধি-ব্যবস্থায় ভুলের যে নির্মাণ এবং সেটি লঙ্ঘিত হওয়ার যে শাস্তি নারীর জন্য সংরক্ষিত, সেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে, “ঈশ্বর ক্ষমা করেন কী না জানা নাই! তবে সমাজ এই মেয়েদের ভুল কখনও ক্ষমা করেনি”(জয়িতা দাস, ২০১৭: পৃষ্ঠা-২০৮)। এমতবস্থায় নারীর পক্ষ থেকে কোনো দ্রোহ উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমাজ হয়ে যায় প্রধান বাধা এবং এটি সেই সমাজ, যে সমাজ পুরুষের পক্ষের সমাজ। আর স্বাভাবিকভাবেই সমাজ তো ভীষণ শক্তিশালী এক প্রতিষ্ঠান, তাই একক কোনো শক্তির পক্ষে এই সমাজকে সরাসরি আঘাত করা কোনো বিদ্রোহী বক্তব্যই টিকিয়ে রাখা যায় না যে~ ‘মানলাম না এই বিধি-ব্যবস্থা! মানি এই সমাজের ধারা-উপধারা!’

কিন্তু যে একক শক্তি তা পারে বা পেরেছে কিংবা পারবে, সেই একক শক্তিই হয়েছে বা পেরেছে কিংবা পারবে সভ্যতাকে বিনির্মাণ করতে এবং সময় সবসময়ই এই বিনির্মাণের পথেই হেঁটেছে। প্রগতি একেই বলে এবং প্রগতির পথে যেকোনো বাঁধাকেই প্রগতি ভেঙ্গে-চুড়ে-দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েই এগিয়েছে। তাকে রোধ করার সাধ্য আজতক কারোর বা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সম্ভব হয়নি, হচ্ছে না এবং হবেও না। সাময়িক বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়া অসম্ভব। কারণ প্রগতি পথে বাধা হয় কেবল অন্ধ সংস্কার, আর অন্ধত্ব একটা ব্যাধি; তার কোনো সক্ষমতা নেই আলোকে রোধে। আলোর বৈশিষ্ট্যই এই যে, অনেক বড় অন্ধকার গুহার কোনো এক ছোট্ট ফুটো দিয়ে যদি আলো প্রবেশ করে, তবে সেই আলোই ম্লান করে দেয় গুমোট অন্ধকারকে; সঞ্চারিত করে আলোর পথের যাত্রাকে।

তবে এই যাত্রা অবশ্যই হতে হবে সবার জন্য সংবেদনশীল, যেটিকে কোলরিজ উল্লেখ করেছিলেন এভাবে যে; “সব উন্নত মনই উভলিঙ্গ”(আলম খোরশেদ, ২০১২: পৃষ্ঠা-৯০)। অর্থাৎ সমতার বিশ্ব গড়তে হলে, লৈঙ্গিক বৈষম্যসহ যেকোনো বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে নারী ও পুরুষ সত্তার মাঝে থাকতে হবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সমঝোতা; কোনোভাবেই তাতে তাদের কোনো অংশের লৈঙ্গিক পরিচয়ের দম্ভে কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়াটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর তা হলে সেই সমাজব্যবস্থাকে সভ্য ও সংবেদনশীল বলার কোনো সুযোগ থাকে না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.