নারী স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে কবে?

সুবাতা জান্নাত রিয়া:

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ২৬ এ মার্চ পালিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। শত ত্যাগ ও তিতীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি থেকে শুরু করে অর্থনীতি প্রতিক্ষেত্রে সফলতার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ পৌঁছালেও নারী স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অর্জন সীমিত। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে নিজগৃহ, প্রতিটি জায়গাতেই নারীকে সম্মুখীন হতে হয় নানা সীমাবদ্ধতার। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী দ্বারা যৌন নির্যাতন, গণপরিবহনে ধর্ষণ, গৃহে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠী ও শিক্ষক দ্বারা নির্যাতন এদেশের নারীদের জন্য নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। উত্তরণের জন্য নানাবিধ আইন থাকলেও বাস্তবে সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ খুবই সীমিত।

বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয়রকমের অর্থনীতিতেই নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ বেতন ভাতার ক্ষেত্রে নারীকে সর্বদা পুরুষের চেয়ে কম যোগ্য মনে করা হয়। বাংলাদেশে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে বর্তমানে ১৫ লক্ষ নারী শ্রমিক নিয়োজিত আছে। যারা দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। কিন্তু বাস্তবে এসকল নারীদের বেতন প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম এবং কারখানাগুলোর ভেতরে কাজ করার পরিবেশ নারীদের স্বাস্থ্য সহায়ক নয়। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে শুধুমাত্র তৈরি পোষাক কারখানাতে লিঙগ ভেদে ৮ শতাংশ বেতন বৈষম্য দেখা যায়। পাশাপাশি এসকল গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকেরা প্রচুর পরিমাণে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাদের পুরুষ সহকর্মী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা।

যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ নারীদের উন্নয়নের আরেকটি প্রধান বাধা। সময়ের সাথে সাথে এই প্রতিকূলতা আরো তীব্রতর হচ্ছে৷ ২০০১-২০২০ অর্থাৎ গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মোট ১৬২৫৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ৩১৬৮ জন গণধর্ষণ এবং ৯৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গণপরিবহনে ধর্ষণ নারীদের উন্নয়নের অন্যতম একটি বাধা। ঘরের বাইরের নিরাপত্তা সংকটের কারণেই নারীরা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারে না। একটি স্বাধীন দেশের জন্য যা খুবই লজ্জার এবং বেদনার।

গৃহে নারী নির্যাতন বাংলাদেশে নিত্তনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরে নারী অত্যন্ত সামান্য কারণে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। যৌতুক এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। ২০০১-২০২০ অর্থাৎ গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মোট ৬০৫৭ জন নারী যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়। এরমধ্যে ৩৮১০ জন নারীকে নির্যাতনের পরে হত্যা করা হয়, ২৪১০ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং ২৩৭ জন নারী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সংসদে যৌতুক নিরোধ আইন পাশ হয়েছে যেখানে বিয়ের সময় কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন তাহলে তাকে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এখনো বাংলাদেশের অসংখ্য নারী যৌতুকের কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনো তাদের জুন্য কোণ আশানুরুপ ফলাফল বয়ে আনতে পারছে না।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে নারীর বেকারত্বের হার পুরুষের চারগুণ। উচ্চশিক্ষিত নারীরা তাদের নিজেদের পছন্দ পেশা বেছে নিতে পারছে না বিভিন্ন পারিবারিক চাপে। তাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই মানসিকতার পরিবর্তন অতি প্রয়োজনীয়। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পুরো পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ের অবদানই অনস্বীকার্য। আর নারী স্বাধীনতা তখনই নিশ্চিত হবে যখন ঘরে ও বাইরে উভয়ক্ষেত্রেই নারী তার মতামতকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উপস্থাপন করতে পারবে এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারবে। নারী স্বাধীনতা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন আইনের পাশাপাশি ব্যক্তি সচেতনতাও বাড়বে। নারী পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

শেয়ার করুন: