সিনেমায় যখন ধর্ষণবিরোধী প্রচারণা

ইশরাত জাহান প্রমি:

নবাব এল.এল.বি: চ্যাপ্টার ১ ও চ্যাপ্টার ২

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায়: অনন্য মামুন

প্রযোজক: আজমত হোসেন

রান টাইম: চ্যাপ্টার এক- ১ ঘন্টা ৩২ মিনিট ও চ্যাপ্টার দুই- ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট

কলাকুশলী: সাকিব খান, মাহিয়া মাহী, অর্চিতা স্পর্শিয়া, সাহাদুজ্জামান সেলিম, সুষমা সরকার প্রমুখ

কাহিনী সংক্ষেপ

শুভ্রা একজন স্বাধীনচেতা নারী। মা ও ছোট বোন নিয়ে তার পরিবার। পেশায় সে একজন সফল রেডিও আরজে। আর মাত্র কয়েকদিন পরে তার বিয়ের দিন ঠিক করা করা হয়েছে। একদিন রাতের শো শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় অফিসের বস ও তার চার বন্ধু দ্বারা ধর্ষিত হয়। । এরপর তার উপর আসে পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপ। আইনি পদক্ষেপ নিতে গেলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপ আর অপমান সহ্য করতে না পেরে তার মায়ের মৃত্যু হয়। কিন্তু তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে শুভ্রা। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক এর ছোট ভাই নেওয়াজ বাশার ওরফে ধর্ষক বাশারকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আইনি লড়াই লড়ে যায় শুভ্রা। সমাজের একজন তথা কথিত ক্ষমতাশীল ও সুনাগরিকের মুখোশধারী রেপিস্টকে শাস্তি দিয়ে ধর্ষিতা সকল নারীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায় সে। অবশেষে শুভ্রা ধর্ষণকারীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে সিনেমা শেষ হয়। আর তার পক্ষে লড়াই করে সিনেমার প্রধান চরিত্র সাকিব খান ওরফে নবাব।

কাহিনী বিশ্লেষণ

মূলত বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রের মধ্যে এধরনের সামাজিক সচেতনতামূলক বার্তা প্রদানকারী সিনেমা বাংলাদেশে এই প্রথম। তাই বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি একটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। সিনেমাটি পূর্বের বাণিজ্যিক ঘরানার সব ধরনের স্টেরিওটাইপ চিত্রায়নকে ভেঙ্গে দিয়েছে। পূর্বে বাণিজ্যিক সিনেমায় ধর্ষণের চিত্রায়ন কেমন ছিল তা আমাদের সকলেরই জানা আছে। হিরোইনকে ভিলেন ধর্ষণ করবে। ভাগ্য ভালো থাকলে ঘটনাস্থলে হিরো আসবে এবং নানা শারীরিক কলাকৌশল দেখিয়ে বীরের মতো লড়াই করে নারীকে বাঁচাবে। কিন্তু ধর্ষিতা নারীর পরবর্তী পদক্ষেপ, তার চলার পথে যে তাকে রীতিমতো লড়াই করতে হয় তা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোতে কখনোই ধরা হয়নি।

সিনেমায় দুটি প্রেক্ষাপট থেকে নারী নির্যাতনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কর্মজীবী নারীর ঘরের বাইরে অনিরাপত্তা ও গৃহে অবস্থানকারী নারীর উপর ঘটে যাওয়া সহিংসতা। প্রথম প্রেক্ষাপটে শুভ্রা চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে (সিনেমার মূল চরিত্র) ও অপরটির প্রতিচ্ছবি হলো ধর্ষক নেওয়াজ বাসারের স্ত্রী রিতু বাশার। আমাদের দেশে যে নারী ঘরে এবং ঘরের বাইরে কোনো পরিসরেই নিরাপদ না তা এখানে এই দুটো রূপক চরিত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। প্রথমে শুভ্রার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা যাক। তার বাবা নেই। তাই পরিবারের কর্তার ভূমিকায় শুভ্রাই সব দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে আসছে। ধারণা করা হয় পরিবারে নাকি একজন পুরুষ মানুষ বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সবাইকে আগলে রাখে। কিন্তু শুভ্রার যেহেতু বাবা নেই, তাই আগে থেকেই সমাজ তার উপর একধরনের রক্তচক্ষু দৃষ্টি আরোপ করে রেখেছিল। কিন্তু এসব কোনো কিছুই আমলে না নিয়ে শুভ্রা তার নিজের মতো জীবনে এগিয়ে চলেছে। অতএব সেদিক থেকে যে শুভ্রা চরিত্রটি গতানুগতিক নারী চরিত্র থেকে আলাদা তা বোঝাই যাচ্ছে।

ধর্ষণের ঘটনার পর শুভ্রা সিদ্ধান্ত নেয় সে থেমে থাকবে না। সে আবারও পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে চায়। তাই মামলা করে ও আইনি সহায়তার দিকে যায়। পরিবার, সমাজ, আত্মীয় স্বজন থেকে বাধা আসা সত্ত্বেও সে থেমে থাকেনি।

শুভ্রার স্টেরিওটাইপ কিছু আচরণকে চ্যালেঞ্জ করা কাজ ও সংলাপ

Ø শুভ্রা নিজেই তার বিয়ের কার্ড প্রতিবেশিদের বিতরণ করে। তখন তার হবু শাশুড়ির সংলাপ, “আমাদের পরিবারের একটা ঐতিহ্য আছে। তুমি কীভাবে নিজের বিয়ের কার্ড নিজে বিলি করে আমাদের মতো পরিবারের বউ হওয়ার কথা ভাবছো?” শুভ্রার জবাব, “আন্টি, আমি তো এখানে অনৈতিক কিছু দেখছি না। আপনি তো জানেনই আমাদের পরিবারে কোনো ছেলে মানুষ নেই। তাই বাড়ির সব কাজ তো আমিই করি। আর এখন সামান্য বিয়ের কার্ড বিতরণ করতে পারবো না?”

Ø ধর্ষণের পর মামলা করতে গেলে পুলিশ তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ হয়ে যেতে বলে। কিন্তু শুভ্রা পিছু হটেনি। এজাহারভুক্ত করার সময় তাকে যেই পুরুষ পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞাসাবাদ করে সেখানেও সে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাকে পুলিশ নানানরকম আপত্তিকর ভাষায় প্রশ্ন করে। কিন্তু সেখানেও শুভ্রা বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।

এবার দ্বিতীয় নারী চরিত্র রিতু বাশারের চরিত্র বিশ্লেণ করা যাক। রিতু বাশার ধর্ষক নেওয়াজ বাশারের স্ত্রী। পরিবারে তার কোনো ভূমিকাই নেই। দাসীর মতো তাকে দেখা হয়। তার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তার স্বামী। এমনকি তার স্বামীর বড় ভাই তাকে নিজ গৃহে ধর্ষণ করতো। এখান থেকে আমাদের সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারীই নিজের পরিবারে থেকে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তার একটি রূপক চরিত্র ছিল এই রিতু বাশার। পুরো সিনেমায় তার নিরব ভূমিকা দেখা যায়। তার প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে শুরুতে সে কোনো প্রতিবাদ করেনি। তবে সিনেমার সবচেয়ে ট্রিগারড চরিত্রটি ছিল তারই। কেননা সিনেমার শেষ দৃশ্যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার দেওয়া বয়ানের কারণেই বিচারক শুভ্রার পক্ষে রায় দেয়।

সামাজিক সচেতনতা প্রচারে সিনেমাটি

সিনেমাটি প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ও আমাদের বাস্তবতার চরম চিত্র তুলে ধরেছে। মামলার শুভ্রার পক্ষের আইনজীবির কিছু সংলাপের অংশ:

“আমাদের সমাজে ছেলে সন্তানকে বলা হয় বংশের প্রদীপ। ছোটবেলা থেকেই এই সমাজ তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য বেশি দেয়।। কিছু প্রদীপের আগুন লেলিহান শিখা হয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এই সমাজকে।

একটা মেয়ে কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরা মানেই হচ্ছে তার চরিত্র খারাপ? তাহলে এই দেশের প্রত্যেকটা কর্মজীবী মেয়েদের চরিত্রই খারাপ।

আমি হেরে গেলে এই দেশের মেয়েরা কখনো প্রতিবাদ করতে সাহস পাবে না। আর রেপিস্টরা পেয়ে যাবে ধর্ষণ লাইসেন্স”।

“এখন থেকে সব নারী নির্যাতনের মামলা আমি বিনামূল্যে লড়বো। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির বিবেককে নাড়া দিতে হবে। তবেই সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব”।

এছাড়া সিনেমায় আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, তা হলো বিচারকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন একজন নারী। সাধারণত নারীকে এরকম পজিশনে দেখা যায় না আমাদের দেশে। তাই সেদিক থেকে সিনেমাটি পূর্বের স্টেরিওটাইপ ধারণার বাইরে।

এছাড়াও সারা দেশে শুভ্রার ধর্ষণের ঘটনাটির ফলে গণজাগরণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে শুভ্রার পক্ষে স্লোগান দিয়েছে। যা এই সিনেমায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত প্রতিরোধের বিষয়গুলোর প্রতিচ্ছবি।

ইশরাত জাহান প্রমি

এই সিনেমায় জেন্ডার অসংবেদনশীল কিছু অংশ:

Ø সিনেমায় নায়িকার (মাহিয়া মাহী) চরিত্রটির উপস্থিতি এখানে অপ্রয়োজনীয়। পুরো সিনেমায় তার খুবই সামান্য উপস্থিতি ও সংলাপ ছিল। হিরোর সাথে তার প্রেম ও কিছু রোমান্টিক গান দেখিয়ে সিনেমাটিকে রঙ্গিন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

Ø সিনেমায় ব্যবহৃত গানগুলো যথেষ্ট জেন্ডার অসংবেদনশীল। নায়িকার পোশাক ছিল বেশ খোলামেলা। লরা মালভির মেইল গেজ তত্ত্বটি এখানে একদম যুৎসই।

Ø সিনেমায় অহেতুক অকথ্য ও নোংরা গালির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

Ø সিনেমায় নারী বিচারক দেখানো হলেও উপস্থাপনটা ছিল গতানুগতিক। যখনই নবাব আবেগী কোনো সংলাপ দেয়, তখন তার জবাব ছিল এরকম, “নবাব সাহেব, এতো আবেগী কথা বলবেন না। বিচারক হলেও আমি তো একজন মেয়েই না কি?” অর্থাৎ নারী কেবলই আবেগী ও নরম মনের অধিকারী, এমন একটা বার্তা দেয়া হয়েছে।

Ø শুভ্রার বয়ফ্রেন্ডের ব্যক্তিত্ত্ব এখানে তথাকথিত পুরুষ ঘরানার নয়। অর্থাৎ মিডিয়া প্রেক্ষাপটে সো কল্ড আসল পুরুষ যেটাকে আমরা বলি। তার চরিত্রটি ছিল বেশ বোকাসোকা ধরনের, চোখে চশমা পরা, পুরুষালি কোনো আচরণ ছিল না। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এটাই বোঝানো হয়েছে যে ছেলেটা সহজ সরল বা বোকা বলেই হয়তো মেয়েটাকে ধর্ষণের পরেও গ্রহণ করেছে।

পরিশেষে বলা যায় যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন আদালত নাট্য এই প্রথম এবং ইউনিক। সমাজের অসঙ্গতিগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে ভিকটিম ব্লেমিং এর মতো ইস্যুগুলোকে প্রতিরোধ করতে সিনেমাটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এই সিনেমাটির মধ্য দিয়ে নারীর উপর সহিংসতা বিষয়ে আমাদের সমাজের চরম বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

 

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.