স্মৃতির পাতায় ৭১

জাহান সৈয়দ মিনা:

ছায়াছবির পর্দার মতো স্মৃতির পাতায় জীবনের হারিয়ে যাওয়া নানা রকম ঘটনার ছবি প্রায়ই ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়, চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারি না। আবার হারিয়ে যাই দৈনন্দিন জীবনের কাজের ভীড়ে। কিন্তু একাত্তরের সেই ভয়াবহ স্মৃতির বেদনা যেন মাঝে মাঝেই আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই আজ তারই কিছু কথা আমি লিখতে চাই। লিখতে চাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকালীন আমার স্বচক্ষে দেখা সেইসব কিছু কথা, যা আজও আমার লেখা হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে আমার আগামী প্রজন্মের জন্য আমি রেখে যেতে চাই আমার ব্যক্তিগত জীবনে প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষী হয়ে থাকা উনিশশো একাত্তুরের কিছু কথা।

১৯৭১ সাল। সেদিনও ছিল এমনই মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। তারিখটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান (সম্মান) বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ঢাকায় তখন প্রচণ্ড গরম, সেইসাথে বইছিলো রাজনীতিরও গরম হাওয়া। মিছিল আর শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ যেন হয়েছিল এক অচেনা যুদ্ধক্ষেত্র, আর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বন্ধ। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে সেই সময় বাসায় বসে শুধু খবর শোনা, মায়ের ঘর সংসারে একটু আধটু সাহায্য করা, খবরের কাগজ ও বই পড়া ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই ছিল না করার। ছেলেবেলা থেকেই আমার রান্নাবান্না, সেলাই ফোঁড়াই, ক্রুশকাঁটার কাজ, উলের সোয়েটার বোনা ইত্যাদিতে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল বলে এই ঘরে বসে থাকার সুযোগটা আমি পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাই।

আমার বাবা ছিলেন তৎকালীন একজন ব্যাঙ্কার। কিছুদিন আগেই সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে রাজশাহীতে তার বদলী। আমরা তখনও ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের বাসায় বসবাস করছি। এমনি এক পড়ন্ত বিকেলে বন্ধু শেখ কামাল এলো। ওরা থাকতো ৩২ নম্বরে। বড় রাস্তা না ধরে সে ভেতরের রাস্তা দিয়ে এলো। এসেই আমাকে বললো, “মিনা, রাজনৈতিক আবহাওয়া এবং শহরের অবস্থা ভালো নয়, এই সময়ে তোমাদের এই বাড়িতে খালুজানকে ছাড়া থাকাটা ঠিক হবে না”। বলেই আর দেরি না করে চলে গেল। আমি সাথে সাথে আব্বাকে ফোন করলাম। পরদিনই আব্বা ঢাকা চলে এলেন আমাদের রাজশাহী নিয়ে যেতে। বন্ধুবর শেখ কামালের সেই বন্ধুসুলভ হুঁশিয়ারি বার্তা বয়ে আনার ছবি আজও আমার মনের পর্দায় অম্লান হয়ে আছে। সেই অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথা ভেবে আজো হৃদয় আমার আপ্লুত। সেদিন যদি আমরা তাঁর কথামতো জায়গা বদল না করতাম, তাহলে সে যাত্রা আমরা সবাই বেঁচে যেতাম কিনা সন্দেহ ছিল। পরবর্তীতে সেই পড়ন্ত বিকেলের জন্য আমি ওকে পর্যাপ্ত ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম কিনা আজ আর তা মনে নেই। তাই আজ আমার এই সামান্য লেখাতে প্রথমেই জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু শেখ কামাল! যেখানেই থাকো ভালো থেকো বন্ধু।

আমরা পাঁচ বোন এক ভাই। আমাদের ভাই সবার বড়। কথা ছিল আমরা বড় তিন ভাইবোন ইউনিভার্সিটি ও কলেজে পড়ুয়া বলে ঢাকাতেই থাকবো, আর আম্মা ছোট তিনজনকে নিয়ে আব্বার সাথে আব্বার কর্মস্থল রাজশাহী যাবেন। আর সেইজন্য ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে ধানমন্ডিতে আমাদের একটা ফ্ল্যাটও খালি করা হয়েছিল। কিন্তু বন্ধু কামালের সতর্কবাণীর পর সমস্ত পরিকল্পনা বদলে গেল। আমরা সবাই আব্বার সাথে রাজশাহী রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাজশাহীতে ব্যাংক থেকে বরাদ্দ আমাদের বাড়িটা ছিল বেশ বড় এবং খুব সুন্দর। একতলা এই বাড়িটির পেছন দিকটার গঠন চওড়া বারান্দাসহ ছিল কিছুটা ইংরেজি অক্ষর “এল” এর মতো। সেখানে রান্নাঘর তার পাশেই ছিল চাল ডাল নুন তেল আলু পেঁয়াজ মশলা ইত্যাদি মাসের বাজার রাখার জন্য বেশ বড় একটা ভাঁড়ার ঘর, ইংরেজিতে যাকে বলে ষ্টোর রূম। বারান্দা থেকে নামলেই ছিল বিরাট একটা মাটির উঠোন। সামনে ছিল বেশ বড়সড় একটা ফুলের বাগান আর সেই বাগান পেরোলেই সুন্দর একটা লোহার গেইট। সম্পূর্ণ রুচিসম্মত আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো বাড়িটিতে ঢুকেই আমাদের সবার মন আনন্দে ভরে উঠলো। ফেলে আসা ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোন চাঞ্চল্য অনুভব হলো না। যদিও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সবাই বিশেষ করে আব্বা বেশ উৎকণ্ঠায় ছিলেন, তবুও ঠিক যেন ছুটি কাটানোর মতো করে এই নতুন শহরে নতুন বাড়িতে ভালোই কাটছিলো আমাদের দিন। আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রেটার রোডের উপর। এই গ্রেটার রোড একদিকে যেখানে শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেখনে ছিল পদ্মা নদীর বিরাট এক বাঁধ। আমরা প্রায়ই গাড়ি করে সেখানে যেতাম বেড়াতে।

এমন সময় এক বিকেলে তারিখটা ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব ২৬ অথবা ২৭ মার্চ। আমাদের বাড়ির রাস্তার উল্টো দিকের প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেব আর আব্বা দুজনেই দুজনার বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলেন, মাঝখানে ছিল বড় রাস্তা “গ্রেটার রোড”। হঠাৎ কয়েকজন তরুণ ছেলে গেইটের কাছে এসে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলো, “আঙ্কেল এখানে কোন ওয়্যারলেসওয়ালা জীপ গাড়ি দেখেছেন”? আচমকা ডাক্তার সাহেব আব্বাকে সম্বোধন করে বললেন, “কাজী সাহেব, তাড়াতাড়ি ভেতরে যান, ওই দেখেন ওয়্যারলেসওয়ালা জীপ”। সত্যিই তাই রাস্তায় বেশকিছু দূরে একটা জীপ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের, না পাক সেনাদের, তা বোঝার উপায় ছিল না। সাথে সাথে ছেলেগুলো বন্ধ গেইট টপকে আমাদের বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়লো। ছেলেরা আব্বাকে বললো, “আঙ্কেল তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিন”। ডাক্তার সাহেব আর আব্বা দুজনেই তৎক্ষণাৎ যার যার বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আব্বা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে সবাইকে নিয়ে ভারী ভারী আসবাবপত্র দিয়ে দরোজাটাকে আরও সুনিশ্চিতভাবে বন্ধ করে দিলেন। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আব্বা কাউকে কোন বাতি জ্বালাতে দিলেন না।

আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে পেছনের ভাঁড়ার ঘরে পৌঁছালাম। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেল মেশিনগানে অনবরত গুলিবর্ষণ, মর্টার আর শেলিং এর আওয়াজ। কোন একটা জানালা খোলা থাকার কারণে বাতাসে ভেসে আসছিল তীব্র বারুদের গন্ধ। আমরা সবাই ভাঁড়ার ঘরের সেই পাকা মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটির বয়স তখন মাত্র চার বছর। আমি ওকে আমার বুকের নিচে নিয়ে উপুর হয়ে কতক্ষণ ছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। এদিকে আম্মা আর আমাদের কাজের বুয়া “ঝরুর মা” সমানে দোয়া দরুদ পড়ে যাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হলো। আব্বার নির্দেশে আমরা তখনও সবাই নিশ্চুপ। কেউ কোন কথা বলছি না। হঠাৎ দরজায় ভীষণ জোরে জোরে করাঘাত অথবা পদাঘাতের শব্দ। যেন দরজা ভেঙ্গে ফেলবে এবং সেটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চললো। অনেকক্ষণ পর এক সময় আব্বা উঠে যেতে চাইলেন দরজা খুলতে, তাঁর ধারণা ছিল হয়তোবা মুক্তিবাহিনীর সেই ছেলেরা। এই সময় আমি আব্বাকে সজোরে জাপটে ধরে রেখে বলেছিলাম, “আব্বা, প্লিজ যাবেন না, আমরা তো জানি না এরা কারা, যদি পাকসেনা হয়”?

আমার বাধা দেয়াতে আব্বা আর গেলেন না। তারপর আরও অনেকক্ষণ ধরে আমরা সেই ঘরেই বসে রইলাম। আমার সঠিক মনে নেই তবে ওই পরিস্থিতির পর আমাদের সে রাতে খাবার জুটেছিল কি? হয়তোবা ফ্রিজে রাখা কিছু ফল, মিষ্টি আর বিস্কুট চানাচুর দিয়ে আমরা সে রাতে ক্ষুধা মিটিয়েছিলাম। সেই লোমহর্ষক বিভীষিকাময় রাতের কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে দেখা গেল ডাক্তার সাহেবের পাশের বাড়িটি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, এখানে সেখানে কিছু বুলেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর বোমার আঘাতে ঘরের দেয়ালের এক বিশাল অংশ ভেঙ্গে গর্তের মতো দেখাচ্ছে। খবর নিয়ে জানা গেল বাড়িটিতে কেউ ছিল না। হয়তো সেই বাড়ির বাসিন্দারা আগে থেকেই সতর্ক হয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন।

আব্বা সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখানে আর থাকা যাবে না। কী বিপদ! তিনি নিজেই তো মাত্র একমাস হলো এই নতুন শহরে এসেছেন, কিছুই তো এখানে ভালো করে চেনা জানা নেই। এতো বড় পরিবার নিয়ে দিশেহারা! কোথায় যাবেন, কী করবেন যখন ভেবে পাচ্ছিলেন না, তখন কোন এক সুহৃদের পরামর্শে ঠিক করলেন নাটোরের রাজবাড়ীতে আশ্রয় নেবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। মোটামুটি যতটুকু সম্ভব অতি প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র মানে খাবার-দাবার, কাপড়-চোপর এক কথায় গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে আমরা সবাই নাটোরের রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আব্বা ড্রাইভার ছেড়ে দিলেন, আর তাই আমাদের একমাত্র ভাই যাকে আমরা দাদা বলে ডাকি সে গাড়ি চালাচ্ছিল। আব্বা আম্মাসহ আমরা আটজন সেদিন সেই গাড়িতে করে কোন অনিশ্চয়তার পানে ধেয়ে যাচ্ছিলাম তা আমরা কেউ তখন জানি না।

নাটোরের রাজবাড়ীটি ছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তাই তার আশেপাশে ছিল এর শিক্ষক ও কর্মচারিদের বসবাস। আমরা সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদের যে ঘরটিতে থাকার জন্য প্রস্তাব দেয়া হলো দেখা গেল সেটা বহুদিন পড়ে থাকা অত্যন্ত ধুলো ময়লা বোঝাই একটি ঘর। আমাদের আব্বা যিনি জীবনে কোনদিন ঝাঁটা হাতে নেননি, তিনি কোত্থেকে এক ঝাঁটা জোগাড় করে সেই ধুলো ঝাড় দিতে লাগলেন। সেই দৃশ্য দেখে আমার মা আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। ইতিমধ্যে এক কর্মচারি এসে খবর দিলেন রাজবাড়ীর প্রধান প্রাসাদে এক পরিবার রয়েছেন, আমরা যদি চাই তাহলে সেখানে তাদের সাথে থাকতে পারি। শুনে আমার মায়ের চোখ মোছা বন্ধ হলো, আর আব্বাও কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। সেখানে গিয়ে দেখি ওরা আমাদেরই মতো আরেকটি পরিবার। আম্মার বয়সী এক ভদ্রমহিলা আর তাঁর পাঁচ সন্তান। চার ছেলে এক মেয়ে। উনার স্বামী সরকারের কৃষি বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (Deputy Director of Agriculture) তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের এক সম্মেলনে যোগ দিতে সেই সময় তিনি ঢাকায় ছিলেন। উনাদের আরও একটি মেয়ে আছে, যার স্বামী তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে মেজর পদে নিয়োজিত ছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন।
আশ্রিত এই দুই পরিবারের মাঝে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। খুব তাড়াতাড়িই ভদ্রমহিলা আমাদের খালাম্মা হয়ে উঠেন, আর তাঁর সন্তানেরা আমাদের খালাতো ভাইবোন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও আমাদের এই সম্পর্ক বহুদিন অটুট ছিল। আব্বাই ছিলেন সেখানে আমাদের সবার একমাত্র অভিভাবক। আমার একমাত্র ভাই দাদাসহ চারজন জোয়ান ছেলে আর আমরা তিন বোন আর খালাম্মার এক মেয়ে যথাক্রমে তরুণী ও কিশোরী। এই আটজনকে নিয়ে আমাদের বাবা-মায়েদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই আন্দাজ করা যেতে পারে। তবুও দিন চলে যাচ্ছিল। আমার মা ছিলেন অত্যন্ত নরম স্বভাবের খুবই সহজ মনের সাদা সিধে মানুষ। সংসারের যে কোনরকম পেরেশানি ও সংকটে তিনি দ্রুত ঘাবড়ে যেতেন। অপরদিকে আব্বা ছিলেন অসীম সাহসী করিৎকর্মা এবং বন্ধুবৎসল। ছয় ফুট উচ্চতার গৌরবর্ণ এই সুদর্শন সু-পুরুষটি প্রকৃত অর্থে ছিলেন সবদিক দিয়ে দক্ষ একজন চৌকস পুরুষ।

আম্মাকে ও খালাম্মাকে কিছুটা আরাম ও চিন্তামুক্ত রাখতে রান্নাবান্নার দায়িত্বটা আমিই নিয়েছিলাম। আব্বা ব্যবস্থা করতেন রান্নার উপকরণের। তখন অতটা চিন্তা করিনি, কিন্তু আজ ভাবতে বসলে অবাক হতে হয় কেমন করে লোকজন দিয়ে তিনি আমাদের দুই পরিবারের চৌদ্দজনের খাবারের রসদ যোগান দিতেন। সেখানে ফ্রিজ ছিল না, তাই প্রতিদিনই রান্না করতে হতো।

এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর হঠাৎ খবর এলো “মিলিটারি আসছে, ওরা রাজবাড়ীতে ঢুকে যাচ্ছে”। আবার পালানোর পালা। এবার যাবো কোথায়? আব্বা আম্মা আর খালাম্মা দিশেহারা। সেই মুহূর্তে চিন্তা ভাবনার কোন সুযোগ ছিল না। সবাই দেখি ছুটছে, সেই দেখাদেখি আমরাও ছুটছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না। কেউ কেউ বলছে গ্রামের দিকে। আমরা সবাই ছুটছি প্রাণের ভয়ে হন্যে হয়ে। প্রধান ফটক ছাড়া রাজবাড়ীর চারদিকে ছিল দীঘি, তাই প্রথমে আমাদের নৌকা করে সেই দীঘি পার হয়ে ছুটতে হয়েছিল। নৌকা চড়তে গিয়ে আমরা দুই পরিবার দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ি। কেমন করে যে আমি আমার আব্বা-আম্মাকে ফেলে খালাম্মার সাথে ওদের নৌকায় চলে গিয়েছিলাম, আজ আর মনে নেই। নৌকা থেকে নেমে আমরা আবার ছুটছি, বাড়িঘর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু বিস্তীর্ণ জমি আর সবুজ ধানের ক্ষেত। ছুটতে ছুটতে বেশ কিছুদূর পর একটা গ্রাম চোখে পড়লো, সবাই আমরা সেইদিকে ছুটতে লাগলাম। এখানে একটা কথা না বলে পারছি না। আমার মা পান খাওয়াতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাই তাঁর পানের বাটাটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেখানেই যেতেন এই পানের বাটা যেত তাঁর সাথে। সেদিন সেই আতঙ্ক আর পালানোর ডামাডোলে আম্মা পানের বাটা সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমার আব্বা ভোলেননি। তিনি সেই পানের বাটা হাতে করে পুরোটা পথ ছুটেছেন। সেই দৃশ্য মনে পড়লে আজও আমি শ্রদ্ধায় আর আবেগে আপ্লুত হই। আমার মায়ের প্রতি আমার বাবার যে কতটা ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও যত্ন ছিল তা আমার ছেলেবেলা থেকে সেই তরুণী বয়স পর্যন্ত আমি বহুবার দেখেছি, কিন্তু সেদিনের সেই প্রাণ বাঁচানোর সংকটময় সময়ে আরেকটিবার দেখে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম।

ছুটতে ছুটতে এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম একটি গ্রামে। গ্রামটির নাম আজ আর মনে করতে পারছি না। সেখানে গিয়ে দেখি সবাই একটা মোটামুটি বড় বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকছে। দেখাদেখি আমরাও ঢুকলাম। বাড়িঘর দেখে মনে হলো বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়ি। উঠোনে পা দিতেই দেখি বিরাট বিরাট হাঁড়িতে ডাল-ভাত রান্না হচ্ছে। মনে হয় এই গৃহস্থের কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছিল যে রাজবাড়ী পাকসেনাদের দখলে, আর সেই এলাকার সবাই আশ্রয় নিতে গ্রামের দিকে ছুটছে, তাই তাঁর এই আয়োজন। বিরাট বিরাট থালা আর বড় বড় গামলায় গ্রামের ছেলেরা সেই ডাল ভাত মাটির পাত্রে পরিবেশন করছে।
সে এক হৃদয় নাড়া দেয়া দৃশ্য! আমরাও সেই খাবারে শরীক হলাম। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম উনার নাম চান মিয়া। উনি বার বার করে বলছিলেন, “আমার বাড়ি আজ আপনাদেরও বাড়ি। আপনারা সবাই নিঃসঙ্কোচে এখানে থাকেন, আমি যা খাবো, আপনারাও তাই খাবেন, একটুও চিন্তা করবেন না”।

সেই দরাজ দিল গৃহস্থ চান মিয়ার সেদিনের সেই ডাল ভাতের ঋণের বোঝা আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর হৃদয়ের দুয়ার আর গৃহের দুয়ার খুলে দিয়ে তিনি সেদিন যে মানবতা ও দেশপ্রেমের নজির রেখেছিলেন তার তুলনা নেই। সারা বাংলাদেশে তাঁর মতো আরো কত শত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এবং তাঁদের অনেকেই হয়তো আজো বেঁচে আছেন সে হিসাব আজ আর কারও কাছে নেই। সেদিনের কথা মনে করে আমি শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে এবং তাঁরই মতো হৃদয় উজাড় করে দেয়া আরো শত শত অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে।

আমাদের মতো আরও লক্ষ হাজারও মানুষের বিড়ম্বিত জীবনের কাহিনী, মা বোনদের ত্যাগ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে সেদিন পেয়েছিলাম আমরা স্বাধীনতা আজ থেকে সেই পঞ্চাশ বছর আগে।

ওকভীল, অন্টারিও, কানাডা

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.