কাঠগড়ায় নারী: যোগ্যতা-অযোগ্যতার দ্বন্দ্ব

হুমায়রা নাজিব নদী:

একজন নারীকে তাঁর জীবদ্দশায় ঠিক কতোবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, সে হিসাব হয়তো তাঁর নিজেরও জানা নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেতে হয় সেই জন্মলগ্ন থেকেই। একটি শিশুকন্যা যখন অনুজ্জ্বল গায়ের রং নিয়ে জন্মায়, তখন কেউ না কেউ ঠিকই বসে থাকবে এই নিয়ে একটা নেতিবাচক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়ার জন্য। এই কেউ একজনটা হতে পারে ওই শিশুকন্যার পরিবারের কেউ। আবার হতে পারে পরিবারের বাইরে কিছু কথিত শুভাকাঙ্ক্ষী পাড়া প্রতিবেশি।

আহা! মেয়ে মানুষ বলে কথা, গায়ের রংটা যদি আরেকটু…যে সময়টাতে সবেমাত্র জন্ম নেয়া ছোট্ট একটা পরীর প্রতি এরকম ক্রুয়েল একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া হয়, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সূচনালগ্ন। অথচ ওইটুকু বয়সে সে দুনিয়াদারির কোনো রুড কিংবা হার্স ফেইসের সাথে অপরিচিত একটা ছোট্ট প্রাণ, যাকে কোনো অসুন্দর বা পাপ স্পর্শ করে নাই। তাঁর কাছে চারিপার্শ্বিক সবকিছুই সুন্দর, শোভন। তার গায়ের রং নিয়ে যে অযাচিত মন্তব্য তাকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, এসবের কিছুই তার এখন পর্যন্ত বোধগম্য না।

এরপর যখন ধীরে ধীরে শিশুকন্যাটি বেড়ে ওঠে, সে আবিস্কার করতে থাকে, যে সুন্দর আর মায়ার দৃষ্টিতে সে পৃথিবীকে দেখতো, পৃথিবীটা ঠিক অতটা মায়ায় তাকে দেখেনা, যে সরলমনে সে আশেপাশের মানুষ গুলোকে অনুভব করতো, মানুষ গুলো অতটা কাইন্ড হার্ট না। সময়ে অসময়ে তারা নিজেদের রং বদলিয়ে তাঁর ছোট্ট হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে বিভিন্ন আক্রমনাত্বক মন্তব্য বা আচরনের মধ্যে দিয়ে। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে টের পেতে আরাম্ভ করে আশপাশের মানুষগুলো এমনকি কখনো কখনো নিজের পরিবারের একান্ত কাছের মানুষগুলোও এ্যাপ্রিসিয়েশান দেয়ার বদলে তাকে জাজ করায় ব্যস্ত। জীবনের ওই সময়কাল থেকেই শুরু হয় তার বাস্তবতার রুঢ় চেহারাটা দেখা। ধীরে ধীরে সে বড় হয় আর বুঝতে শিখে পথচলার প্রতিটা স্টেপে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে আসামির কাঠগড়ায়। তাও আবার এমন একটা ব্যাপারে যেখানে তার কোনো হাত নেই। গায়ের রংএর জন্য কিংবা দৈহিক গঠনের জন্য মানুষ তাকে জাজ করে, যদিও এখানে শারীরিক গঠন বা রং রুপ, কোনোটাই নিজের পছন্দে বেছে নেয়ার অপশন তার ছিলো না। তারপরেও প্রতি পায়ে তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়, তুমি মেয়ে..তোমার একমাত্র যোগ্যতা ফিজিক্যাল বিউটি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, যে বা যারা এইভাবে মেয়েটাকে গায়ের রং বা দৈহিক গঠন-এর জন্য হেয় করে, তাদের বেশিরভাগই নারী। পাড়াতো আন্টি কিংবা কাকিদের এইক্ষেত্রে বেশ জোরসোর ভুমিকা লক্ষ্যণীয়। এরপর ওই মেয়েশিশুটির বালিকা বেলাও যায় এই কথা শুনে যে সে কালো বা স্থুলকায় কিংবা অতিরিক্ত রোগা। সব রং আর পোষাক তার জন্য মানানসই নয়। কাজেকর্মে কিংবা এ্যাকাডেমিক পারফরমেন্সে সে যতোই যোগ্যতার পরিচয় রাখুক না কেনো, সব যোগ্যতা অসাড় এবং মূল্যহীন। এভাবে চলার পথে প্রতিটা অধ্যায়ে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরা হয়।

এরপর তার জীবনে আসে আরেক অধ্যায়।

কৈশোরের সোনালী আলো তাঁর সেই ছোট্ট শরীরকে ছুঁয়ে খেলা করে যায়। বালিকা মনে এখন ‘আবেগ’ নামের দুর্দান্ত বৈশাখী ঝড়োহাওয়া উথাল পাথাল। সদ্য কৈশোরে পৌঁছানো মন খুব বেশি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। অল্পতেই কান্না পেয়ে যায়, একটু আঘাতেই দুচোখ বেয়ে গঙ্গা যমুনা। এই সময়টা যে মেয়েটার হাসি আনন্দে আর স্বপ্ন দেখে পার করে দেয়ার কথা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মেয়ের এই সময়টা কাটে প্রচণ্ড ইনসিকিউরিটি আর ফ্রাস্ট্রেশনে। একটা কালো কিংবা শ্যাম বর্ণের কিশোরীকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে ‘তোমার স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই’; এমনকি যে মেয়েটার কমপ্লেকশন ফেয়ার, অর্থাৎ আমাদের কথিত যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারকদের কাছে যে কিশোরীটি সুন্দরী বলে স্বীকৃত, তাকেও কৈশোরে অন্যদিক থেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। এখানে যাওয়া বারণ, ওই কাজে বাধা, ছেলে সহপাঠীর সাথে কথা বলা যাবে না, এরকম বহু ক্ষেত্রে তাঁর হাতপা বেঁধে দেয় আমাদের সমাজ। সুন্দরী হওয়ার কারণে অল্প বয়সে বিয়ের প্রপোজাল এলে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মা খুব অপরিণত বয়সে পাত্রস্থ করে দেন।

বর্তমানে অল্প বয়সে স্বল্প শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার হার অনেকটা কমে গেলেও এমন নজির এখনও কিছু পরিবারে দেখা যায়। যার ফলে হয়তো একটা সম্ভাবনাময় উদীয়মান নক্ষত্রের পতন ঘটে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠার আগেই। মেধাবী অনেক ছাত্রী অংকুরে বিসর্জন দেয় তার স্বপ্নকে। অথচ পশ্চিমা দেশগুলোতে কিশোরবেলা কাটে হাসি আর আনন্দে। এই সময় থেকেই একটা মেয়ে নিজেকে জানতে শুরু করে। বুঝতে শুরু করে সে একজন সুন্দরী মেয়ে। তার কনফিডেন্স ভেঙে দেয়ার জন্য কেউ ওঁৎ পেতে বসে থাকে না। কালো বা মোটা এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে বুলিং সাধারণত এশিয়ান কমিউনিটিতেই হয়ে থাকে।

তারপর যৌবনের দ্বারকোঠায় যখন তাঁর শুভযাত্রা শুরু, ওই সময়ে ফিজিকাল বিউটি হয়ে ওঠে যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি। বিয়ের বাজারে বরপক্ষের প্রথম প্রশ্ন মেয়ে দেখতে কেমন। পাত্রীর গায়ের রং সাদা হলে ঘটক পান চিবুতে চিবুতে দাঁত কেলিয়ে হেসে উত্তর দিবে, ‘পাত্রী মহা সুন্দরী’। আর যদি কালোবরণ কন্যা হয়, তাহলে একটু ইতস্তত করে বলবে ‘কন্যা দেখতে খুবই মায়াবী। ইয়ে মানে গায়ের রংটা খানিকটা…’। আফসোস এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এরকম অনেক পরিবার পাবেন, যারা গায়ের রং এর কারণে পিছিয়ে যাবে। অথবা এমনও অনেক পরিবার দেখেছি, যারা পাত্রীর গায়ের রং এর কমতির সুযোগে একটা ন্যাস্টি গেম খেলে উঁচু অংকের যৌতুক আদায় করবে। আবার কখনও কখনও পাত্রীর পরিবারকেও দেখা যায় মেয়ের পড়ালেখায় পয়সা খরচ না করে উঁচু অংকের যৌতুক দিয়ে এইসব নরপিশাচের ক্ষুধা মিটিয়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করে দায়মুক্ত হতে। কিছুদিন পর খবরের কাগজে মোটা মোটা অক্ষরে হেডলাইন আসে ‘টাকার জন্য চাপ দিয়ে না পেয়ে গৃহবধুকে পুড়িয়ে হত্যা’!

আহারে নারী জীবন! সেখানেই একটি স্বপ্নের মৃত্যু, সেখানেই সমাধি রচনা।

এই গেলো বিয়ের বাজারে নারীর মূল্যায়ন বা মাপকাঠি। এবার আসি নারীর ক্যারিয়ার জীবনে।

একটা মেয়ে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রশংসা পায়, বা তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা গুণে ক্যারিয়ার জীবনে স্টেপ আপ করতে থাকে, তখন তা নিজের পারদর্শিতা দিয়েই অর্জন করে থাকে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অনেকে তা জানলেও মানতে নারাজ। কেবলমাত্র নারী হওয়ার কারণে তাঁর সমস্ত যোগ্যতা কিংবা কর্মদক্ষতাকে আন্ডারএস্টিমেট করে বলে দেয়া হয় যে সে কেবল সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি ব্যবহার করে ওই পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটু খেয়াল করে দেখবেন যে, যারা সত্যিকারের যোগ্য লোক, তারা অপরের যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়, সম্মান জানায়। আর যারা ওই নারীর থেকে পিছিয়ে, নারীর যোগ্যতাকে স্বীকার করতে আপত্তিটা তাদেরই। ইনফ্যাক্ট এটা তাদেরও জানা যে নারী সহকর্মিটি তাদের চেয়ে ঢের বেশি যোগ্য। শুধুমাত্র ইনসিকিউরিটি থেকে নিজের কম যোগ্যতাকে ঢাকতে এরা এই ধরনের হীনমন্যতা শো করে থাকে।

তবে এমন মেয়েও আছে যারা শুধুমাত্র ‘ওম্যান’ আইডেন্টিটি ব্যবহার করে এক্সট্রা সুবিধা ভোগের পক্ষপাতি। এইসব মেয়েদের কোনরকম অপমান না করেই বলছি, এরা কেবলমাত্র সুবিধাই ভোগ করে যাবে সারাজীবন। কোন দায়িত্বপূর্ণ পদ এদেরকে কখনই অফার করা হয় না। যদি কালেভদ্রে হয়ও, তখন সেটা কাজেই প্রমাণ হয়ে যায় যে সে আসলেই যোগ্য কিনা! তবে কোন প্রতিষ্ঠান কোন মেয়েকে যদি দায়িত্ব দিয়ে থাকে, বুঝতে হবে ওই মেয়েটি সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা প্রমাণ করেই প্রতিষ্ঠানের আস্থা অর্জন করেছে, চেহারা দেখিয়ে নয়, কিংবা সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি ব্যবহার করে নয়। সমাজের কথিত স্বীকৃত সাদা চামড়ার সুন্দরী মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রচারণা তীব্রতর হয়ে থাকে। এখানেও নারীর যোগ্যতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়।

এভাবে নারীজীবন চক্রের প্রতিটা স্তর বিবেচনা করলে দেখা যায় অধিকাংশ সময়ই তার কাটে এটা ভেবে যে মানুষ কী বলবে, মানুষ কী ভাববে। জীবনের প্রতিটা অধ্যায় তাকে এই রিয়েলাইজেশান দিয়েছে যে পুরো পৃথিবীটাই তার জন্য বিচারক, আর সে হচ্ছে একমাত্র কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামী। যার কিনা প্রতিটা কাজের জন্যে নিজেকে সমাজের আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করা আবশ্যক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.