আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:
ভাইয়া…প্লিইজ… এই ফাইলটা আপনি একটু ঠিক করে দিন। অনেক ঝামেলা এই ফাইলে… বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে রিয়া। ওর এমন হাসি দেখে রাগ লাগে আইটি ফার্মে কাজ করা শান্তার। বিরক্তি ফুটে ওঠে মুখে। বলে ও, রিয়া প্রায় সময়ই ন্যাকামি করে ওর নানা কাজ এ ভাইয়া, সে ভাইয়াকে দিয়ে করায়। ওর আচরণে অন্য মেয়েরা বিব্রত হয়, বিরক্তও হয়।
সোনিয়া ওর অফিসে একেক কলিগকে দেখে একেক রকমের হাসি দেয়। কেন এরকম করো বলতেই বলে কাজ তো হয়। বসরা তো হাসি দেখে মুগ্ধ হয়। একটু ন্যাকামি করলে সমস্যা কী? আমি তো অফিসে সেফ।
নবনীতাকে এক ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলী করতেই কেঁদেকেটে একাকার। প্রতিদিন বসের সামনে যেয়ে চোখের পানি ফেলে। একদিন বসকে ‘বাবা’ বানিয়ে ফেলে। এরপর ন্যাকা ন্যাকা করে ‘ড্যাডি’ ‘ড্যাডি’ বলে ডেকে অস্থির। ড্যাডির জন্য বাসা থেকে খাবার আনে। ম্যাসেনজারে ড্যাডি দুপুরে খেয়েছে কিনা খোঁজখবর নেয়। ব্যস তার সমস্যার সমাধান।
সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের চারপাশে এরকম অসংখ্য রিয়া, সোনিয়া, নবনীতাকে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি। এরা কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সমাজের সব জায়গায় নিজের মেধা নয়, ন্যাকামি আর করুণা নিয়ে টিকে থাকতে চায়। এরা ভাবে, ন্যাকামি আচরণ আর চোখের পানি ফেললেই বসদের মন জয় করা যায়। এদের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয় অন্য নারীদের, যারা নিজের মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে লড়াই করে যায় কর্মক্ষেত্রে, সমাজে। তাদের চলার পথ ততটা তখন মসৃণ হয় না এসব মেয়েদের জন্য। কারণ পুরুষরা তখন সব মেয়েকে একইভাবে ভেবে বসেন। তারা তখন অনেক নারীদের আর শ্রদ্ধার জায়গায় রাখেন না।
অথচ প্রচুর মেয়ে আছে যারা এসব ন্যাকামি আচরণ করেন না। ন্যাকামি পছন্দও করেন না। অফিসে বা কাজের জায়গায় তাদের বাবা, ভাই, মামা, চাচা, দাদা বানাতে হয় না। তারা নিজের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতার উপর নির্ভর করে কাজ করেন। কাজ করে যোগ্য জায়গায় যেতে চান। যেতেও পারেন তারা। সাহসী আর আত্মবিশ্বাসে ভরা এসব নারীরা সমাজে কাজ করে যান দাপটের সাথে।
গণমাধ্যমে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিডিয়া কর্মী জানান, প্রায় অফিসেই এরকম একজন বা দুজন ন্যাকা ধরনের মেয়ে থাকে। এদের ভাইয়া ভাইয়া ডাকে আমরা অস্থির। এরা যখন উপরের পদে যায় তখন তার কাজটাও ভাইয়ারাই করে দেন। কারণ তারা তো অদক্ষ। এরা দক্ষ হতেও চায় না। আমরা তখন পড়ি বিপদে। আমাদের যোগ্যতা তখন তারা কাউন্টই করেন না। ভাবেন, সব মেয়েরাই মনে হয় এরকম। আসলে তো তা নয়। ন্যাকা ছেলে মেয়েদের আসলে মুখের ওপর বুঝিয়ে দেয়া দরকার তার সমস্যাটা কোথায়। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে নারীরা কত কঠিন কঠিন কাজ করছে। আমি অনেক কাজ নাই পারতে পারি, তাই বলে সারাক্ষণ অন্যের উপর ভর করে চলবো ?
কর্পোরেটে কাজ করা আফরিনের মতে, মেয়েদের আসলে পার্সোনালিটি সম্পন্ন হওয়া উচিত। তাতে শ্রদ্ধা সম্মান বাড়ে। নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি হয়। ন্যাকামি করে হয়তো সাময়িক চলা যায় তবে লংটাইম তা হয় না।
বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা রুনা বলেন, দয়া বা করুণা নয়, মেয়েরা আসলে যোগ্যতা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যায়। তাকে প্রতিদিনই প্রমাণ করতে হয় সে কাজে দক্ষ। এরকম পরিস্থিতিতে যখন সেই একই অফিসে অন্য কোনো নারী ন্যাকামি করেন তা আসলে সমস্যাই বয়ে নিয়ে আসে। সবাইকে তখন এক কাতারে ফেলে দেয়া হয়।
সাংস্কৃতিক কর্মী সুমনা বলেন, আসলে যে সব নারীদের যোগ্যতা কম, মেধার উপর ভরসা নেই তারাই মূলত এধরনের কাজগুলো করেন। একটু হাসি, ঢং করে কথা বলে ভাবেন পুরুষ সহকর্মী তার কাজটা করে দিবেন। এ ধরনের আচরণ করা আসলে অনুচিত। তিনি বলেন আপনি যদি কাজে দক্ষ হন, আপনার নিজের উপর যদি ভরসা থাকে আপনার ন্যাকামি আচরণ আসবেই না। আপনি তা করতেই পারবেন না।
আইটি কর্মকর্তা নুসরাতের মতে আমরা সবসময় পুরুষদের দোষ দেই, কিন্তু অনেক অফিসে এই কাজ না পারা অদক্ষ মেয়েরা আসলে কিছুটা পরিবেশ নষ্ট করে। তারা নানা ধরনের ন্যাকামি করায় সমস্যায় পরতে হয় দক্ষ মেয়েদের। অথচ দেখেন সমাজে প্রচুর নারীরা সুনামের সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে। সেখানে তারা পুরুষের পাশাপশি কাজ করছে সমানতালে । নেতৃত্ব দিচ্ছে সে বিভিন্ন টিমের। তখন কিন্তু সে নিজেকে একজন মেয়ে বা ছেলে বলে ভাবছে না, যোগ্য মানুষ বলেই মনে করছে। তার মতে প্রত্যেকটা মেয়ের প্রথমে আসলে নিজেকে শ্রদ্ধা করা দরকার। তার যোগ্যতা দক্ষতা আর সাহসের উপর ভরসা করা দরকার। দরকার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। এজন্য প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নেয়া যেতে পারে। তবুও ন্যাকামি করে নিজের গুরুত্ব নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
চাকরীজীবী ফারাহ বলেন, একটু খেয়াল করে দেখবেন কোথাও যদি বেড়াতে যান কিছু মেয়ে থাকে তারা সবসময় ঢং করে বলবে, ও গড, এই কাজ আমি কীভাবে করবো, তারা নৌকায় ওঠতে গেলে ঢং করে বলবে, যেতে পারবো না, পড়ে যাবো, পাহাড়ে ওঠতে গেলে ঢং করবে, এমনকি বাঁশের সাঁকো পার হতে গেলেও ন্যাকা গলায় বলবে, আমি পারবো না। দেখা যাবে সেসময় তার চেয়ে ছোট একটা ছেলে হয়তো তাকে হাত ধরে পার করে দিচ্ছে। এগুলো আমরা প্রতিনিয়ত দেখি। কেনো এতো ঢং করতে হবে ? এসব ন্যাকামি কি না করলে নয়?
বেসরকারি কর্মকর্তা নুসরাতের মতে, ছোটবেলাতেই আসলে একটা মেয়ে বা ছেলের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো দরকার। বাবা মা যদি ছোটবেলাতেই সন্তানকে বুঝিয়ে দেন তার দক্ষতা যোগ্যতা সম্পর্কে, তাহলে শিশুটির মনে গুণ আর সাহসটাই ফুটে ওঠবে আলোর মতো। তখন সে আর ন্যাকামি আচরণ করে বলবে না, ও গড এ কাজ আমি পারবো না।
তাই আর ন্যাকামি আচরণ নয়, নয় অন্যের উপর নির্ভরতা। আত্মবিশ্বাস প্রজ্ঞা, মেধা আর সাহসে ঝলমল করে ওঠুক নারীরা। অন্যের দয়া বা করুণায় নয়, নিজ যোগ্যতায় জায়গা করে নিক সে কর্মক্ষেত্রে, সমাজে, রাষ্ট্রে ।