সারওয়ার-ই আলম:
এদেশে কী এক জীবন নারীর! নিজের শরীরটাই যেন তার নিজের কাছে এক অভিশাপ। কখনও ধর্ষকের হিংস্র থাবা থেকে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হয়। কখনও গৃহশিক্ষকের কুনজর সহ্য করতে হয়। কখনো মাদ্রাসার হুজুরের বদ আবদার হজম করতে হয়। কখনো সহকর্মী কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কুপ্রস্তাব শোনেও না শোনার ভান করতে হয়। আবার কখনও মামা,চাচা, খালু স্তনে, নিতম্বে হাত বসিয়ে দেয় অথচ চাইলেই এসব লোকের উরুসন্ধি বরাবার সাঁই করে একটা লাথ্থি বসিয়ে দিতে পারে না সে।
পারে না, কারণ তার সে সাহস থাকে না। এই সমাজ তাকে সেই সাহস দেয়নি। আমরা পুরুষেরা সেই সাহস দিই না তাকে। আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখি নারীকে। যেমন খুশী তেমন নাচাতে চাই। নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াক এটা আমরা চাই না। আর চাই না বলেই ধর্ষণের অপবাদ বুকে নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অসংখ্য নারী। এই সমাজ তাকে চরিত্রহীন বলবে – এই ভয়ে শ্লীলতাহানীর বিচার চাওয়ার সাহস পর্যন্ত থাকে না তার।
মামা, চাচা, খালু কর্তৃক যৌন নিপীড়ন — এসবতো শুনতে শুনতে আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। কখনো কখনো শুনি নারী তার আপন পিতার দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। নিজের কন্যার দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠে। আয়নায় নিজেকে দেখি। হ্যাঁ এই আমি, আমিও তো একজন পিতা। নিজেকে প্রশ্ন করি, একজন জন্মদাতা পিতা কীভাবে পারে তার কন্যার গায়ে হাত দিতে? এতোটুকু হিতাহিত জ্ঞান কি তার অবশিষ্ট থাকে না? ভুক্তভোগী কন্যার কথা ভাবি। সে কন্যাও কেন পারে না শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিতার যৌনাঙ্গ বরাবর শক্ত একটা লাথ্থি বসিয়ে চিরতরে অকেজো করে দিতে! কেন নিজেকে আপন পিতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না নারী? তার সাহস থাকে না কেন?
একজন শিক্ষক যখন কুপ্রস্তাব দেয়, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অন্যায় স্পর্শ করে তখন নারী কেন প্রতিবাদে ফেটে পড়তে পারে না? কেন সে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে পারে না? কেন তাকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে সবাই জেনে গেলে এই সমাজ তাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে আখ্যা দিবে? দুশ্চরিত্রার এই অপবাদকে তোয়াক্কা না করে কেন একজন নারী পারে না কুপ্রস্তাব দেয়া শিক্ষকের চোয়ালে কষে একটা থাপ্পড় বসাতে? কেন নারীর সেই সাহস থাকে না?
মানুষের বাড়িতে বাড়িতে অমানবিক খাটুনি খেটে যে নারী পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয় তার প্রতি গৃহকর্তার বদনজরের কথা, যৌন নিপীড়নের কথা প্রায়শ খবরের কাগজে ছাপা হয়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে, সেটাও একজন নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। লালসার নগ্ন হাত সর্বত্র তার দিকে তাক করা থাকে। তীব্র সাহসে সে যে সে হাত ভেঙ্গে দিবে সে সাহস আমাদের নারীদের থাকে না। থাকে না কারণ সে সাহস তাকে আমরা দিইনি।
ঘরে বাইরে কোথায় নারী নিরাপদ? বাসে উঠবে সেখানেও তাকে আতংকে থাকতে হয় কখন কে গায়ে হাত বসিয়ে দেয়। ভিড়ের মধ্যে শরীরে আপত্তিকর স্পর্শের অভিজ্ঞতা হয়নি এমন নারী বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমাদের নারীরা পারেনা ঘুষি মেরে স্পর্শকারীর নাক ফাটিয়ে দিতে। তারা পারেনা পুরুষের কলার ধরে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বলতে— জারজ, কুলাঙ্গার! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! আমাদের নারীদের সেই সাহস থাকেনা কেন?
শুধু কি বাস! ঢাকায় বিভিন্ন ব্যস্ত বিপনি বিতানে কেনাকাটা করতে যাওয়া নারীদের অভিজ্ঞতাও কি খুব একটা সুখকর! গাউসিয়া, নিউমার্কেটে ভিড়ের মধ্যে জীবনে একবারও গায়ে হাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি রাজধানীতে এমন কি কেউ আছেন! মনে হয়না! সেখানেও আমাদের নারীরা অসহায়। তারা পারেনা স্পর্শকারীর ওষ্ঠ ফাটিয়ে দিতে। পারে না কারণ তাদের সাহস থাকে না। এই সাহসটুকু তাদেরকে আমরা দিইনি। আমরা তাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছি, বিশ্বসভার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বুলি আওড়াচ্ছি, কিন্তু যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, তাহলো— নারীর সাহসায়ন। নারীরা সাহসী হচ্ছে না। আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে না। তাই আসুন নারীকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত করি। সাহসী করি। পুরো সমাজকে হয়তো পারবো না! অন্তত প্রত্যেকে নিজের কন্যা সন্তানটিকে সাহসী করে গড়ে তুলি। কণ্ঠ উঁচিয়ে বলি —ক্ষমতায়নের পাশাপাশি চাই নারীর সাহসায়ন।
লেখক: লন্ডনপ্রবাসী কবি ও সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]