কেন আমি একজন নারীবাদী মানুষ?

আহমাদ মুসা ধ্রুব:

(১)
চিন্তায়, মেধায় ও মননে আমি একজন নারীবাদী মানুষ। নারীবাদী বলতে বুঝাচ্ছি, আমি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতার পক্ষের মানুষ। নারীবাদটা আসলে ঠিক কী? সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকারের সমতার দর্শনই হলো সোজা বাংলায় নারীবাদ বা ফেমিনিজম। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বা ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্যই নারীবাদ প্রয়োজন।

(২)
আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রের বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত। এতোটাই গভীরে যে, মোটা দাগে বললে বলতে হবে এদেশের নারীদেরও সিংহভাগই আবার এই পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র বা প্যাট্রিয়ার্কির সমর্থক। অর্থ্যাৎ সিংহভাগ নারীরা নিজেরাই একরকম সেক্সিস্ট। মানে হলো, তারা নিজেদেরকে ঠিক পুরুষদের সমকক্ষ বলে মনে করে না। নিজেদেরকে তারা দুর্বল-অবলা, পুরুষদের অধীন বলে ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। একজন আদর্শ গৃহিণী হওয়াটাই সমাজের সিংহভাগ নারীর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই এখানে অধিকার সচেতন বা আত্মমর্যাদা নিয়ে সচেতন নারীরা হলো অনেকটা ঐ ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো। এই পঁচে যাওয়া পুরুষবাদী সমাজের পুরুষেরা এবং পুরুষতন্ত্রের সমর্থক নারীরা উঠেপড়ে লাগে ঐসকল নারীদেরকে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করতে, তাদেরকে নানাবিধ বিশেষণে বিশেষায়িত করতে। যদিও তাতে এইসকল প্রগতিশীল নারীদের কিছুই যায় আসে না। এসব গায়ে মাখলে তারা এতদূর আসতেই পারতো না।

(৩)
আমাদের সমাজে পুরুষরা হলো আক্ষরিক অর্থেই হাঁস। হাঁসের শরীরে যেমন পানি লাগে না, গড়িয়ে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজের দেবালোকে বাস করা পুরুষদের শরীরেও কোনো কাদা (দোষত্রুটি) লাগে না। আর ঠিক তার উলটো ব্যাপারটা দেখা যায় নারীদের ক্ষেত্রে। পুরুষতন্ত্র আমাদের সমাজে এতোটাই প্রকট যে, একজন নারী যদি নির্যাতিতও হয়, তাহলেও দেখা যাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একসময় ওই নারীটির ঘাড়েই দোষ চাপানো হবে। যেমন একজন নারী নিপীড়ন বা যৌন নিগ্রহের শিকার হলো, সাথে সাথেই দেখবেন আপনার আশেপাশের অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে নাঁকি সুরে বলবে, যেটা হয়েছে সেটা মোটেই ঠিক হয়নি। কিন্তু ঐ মেয়ের নিজেরও দোষ আছে, মেয়ের পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো ছিলো না, পর্দা করতো না, অনেক ছেলেপেলের সাথে মেলামেশা ছিলো, চলাফেরাতে সমস্যা; হ্যানত্যান আরো নানান সব বদমায়েশি কথাবার্তা।

অর্থাৎ একরকম সুকৌশলে নিপীড়নকারী পুরুষটির অপরাধ লঘু করে দেখানো এবং দোষটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই নির্যাতিত নারীটির ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া। অর্থ্যাৎ ভিক্টিমও সে আবার অপরাধীও সেইই। ইংরেজিতে এই শয়তানিটাকে বলে “ভিক্টিম ব্লেইমিং”। “স্লাট শেইমিং” ব্যাপারটা তো আরো অনেক বেশি কমন। পুরুষবাদী বা সেক্সিস্ট সমাজে এগুলো হলো একেবারে বহুল চর্চিত ব্যাপার।

আমাদের সমাজে মেয়েরা জন্মানোর একেবারে সাথে সাথে তাদের হাতে-পায়ে বিধিনিষেধের কঠিন এক শৃঙ্খল পরিয়ে দেওয়া হয়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাইরে যেতে পারবে না, মেয়েমানুষ উঁচু গলায় কথা বলতে পারবে না, স্বামীর কথাই শেষ কথা, শরীরতো অবশ্যই ঢেকেঢুকে রাখতে হবে, কেউ ভুলেও যেনো দেখে ফেলতে না পারে। তাদের শরীরটাই যেনো আপাদমস্তক এক ভয়ংকর পাপ! এটা হলো সরাসরি নারীর শরীরের “সেক্সুয়াল অব্জেক্টিফিকেশন”। যার মানে, ঐসমস্ত লোকের কাছে নারী নিছক ভোগ্যবস্তু আর বাচ্চা দেয়ার মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়। নারী তাদের কাছে ঠিক মানুষ নয়। নারীর মন থাকতে পারে না, কাম থাকতে পারে না, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, অনুভূতি কিছুই থাকতে পারে না। অথচ একজন পুরুষকে কিন্তু কেউ কখনো বলে দেয় না যে, সে কী পোশাক পরবে, কীভাবে চলাফেরা করবে! আর ঋতুস্রাবের বিষয়টা তো এখনও ভয়ংকর এক ট্যাবু। জনসম্মুখে বললেও একরকম ব্লাসফেমি হয়ে যায় আরকি। জন্ম থেকে এগুলোর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে একসময় মেয়েদের আর স্বাধীন ইচ্ছা বা চিন্তাশক্তি বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তারা হয়ে পড়ে জড় পদার্থের মতো ইচ্ছাশক্তিহীন, বধির ও অজ্ঞ।

(৪)
পশ্চিমে মানবতাবাদ একটা লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসেছে। তারা যখন নানারকম পুনর্জাগরণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আমরা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা শোষিত হয়েছি। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই আমাদেরকে সামলাতে হয়েছে দেশভাগের ধাক্কা। স্বাধীন হওয়ার পরেও আবার যুদ্ধ করতে হয়েছে স্বাধীনতার জন্যে। তাই পশ্চীমে যেখানে ফোর্থ ওয়েভ ফেমিনিজমের ছোঁয়া লেগেছে, সেখানে আমাদের দেশের নারীরা তাদের ন্যুনতম অধিকার আদায়ের জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে প্রতিটা ক্ষেত্রে। ন্যুনতম মজুরির জন্যে, সম্পত্তির অধিকারের জন্যে, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকারের জন্যে, নিজের পছন্দে বিয়ে করার জন্যে এমনকি নিজের পরিবারেই নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের সংগ্রাম।

(৫)
তারপরেও আমি বিশ্বাস করি, আমাদের নারীরা পারবে। সতীদাহ প্রথা রদ করে আর বিধবা বিবাহ আইন চালু করে রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলে যে কুঠারাঘাত করেছিলেন, তা পূর্ণতা পাবে এই নারীদের হাতেই। তারা সহস্রাধিক বছর ধরে চলা বৈষম্যময় এই পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে৷ অবলা বলে নারীদের হেঁশেলে ঠেলে দেবার দিন ফুরিয়ে আসবে। বাঁধার পাহাড় কেঁটে একদিন তারা নিজেরাই নিজেদের মুক্তির পথ তৈরি করবে। তাদেরকে করতে হবে।

আমার আশেপাশের সকল নারীরা, যারা প্রতিনিয়ত বৈষম্যময় এই সমাজে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, নিজের অধিকারের জন্যে লড়াই করে পুরুষবাদী এই সমাজকে বৃদ্ধাংগুলি দেখাচ্ছে, তাদের সকলকে “বিশ্ব নারী দিবস” এর শুভেচ্ছা। আপনারা পারবেন। আপনাদের পারতেই হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.