ফাহমিদা জেবীন:
আজ বিশ্ব নারী দিবস। বিশ্বে একশত বছরের বেশি সময় ধরে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। যা শ্রম আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে একসময় জাতিসংঘেরও স্বীকৃতি পায়। ১৯০৮ সালে এর বীজ রোপিত হয়; যেখানে ১৫ হাজার নারী মজুরি বাড়ানো, কর্মঘণ্টা কমানো ও ভোটাধিকারের দাবিতে নিউইয়র্কের রাস্তায় বিক্ষোভ করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে পরের বছর আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রথম জাতীয় নারী দিবস ঘোষণা করে। আর একে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবার কাজটি করেছিলেন ক্লারা জেটকিন নামে একজন (জার্মান) নারী। ১৯১০ সালে তার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম উদযাপিত হয় ১৯১১ সালে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে আমরা পালন করছি এর ১১০ তম বার্ষিকী।
এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য Choose T0 Challenge বা বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত। আর এই সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে এবার নারী দিবসে দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘বৈশাখী’ প্রথম একজন ট্রান্সজেন্ডার (তাসনুভা আনান শিশির) সংবাদ পাঠক নিয়োগ প্রদান করে। যা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন উদ্যোগ। দেশের প্রায় সবকটি প্রচার মাধ্যম, খ্যাত-অখ্যাত নিউজ পোর্টাল মারফত আমরা ইতোমধ্যে এ সংবাদটি জানতে পেরেছি।
এর মধ্যে অন্যতম একটি পোর্টালের এ নিয়ে শিরোনাম ছিল-“দেশের প্রথম হিজড়া সংবাদ পাঠক তাসনুভা আনান শিশির”। শিরোনামের এই হিজড়া শব্দটি কি গালির মতো শোনাচ্ছে না? গালিপটু বাঙালির কাছে তখন প্রশ্ন থেকে যায় এখানে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত? আর যিনি এর এডিট করেছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা-ই বা কী, কতটুকু? এখানে বলা ভালো, আমার জানামতে বর্তমানে তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত নারী।
It’s very sorry to say, she acquired the post by dint to her merit and endless endeavours. So she needs proper respect. কিন্তু আমরা কি তা আদৌ শিখেছি? বরং এ কৌশল খুব করে রপ্ত করেছি কীভাবে সম্মানের জায়গায় বসিয়ে অসম্মান করতে হয়। তাইতো তাসনুভা সফল হয়েও উচ্চ মগজসম্পন্ন শিক্ষিত শ্রেণির বুলির শিকার হলেন।
দেশ এগিয়ে যাবে বহুদূর। এগুবো জাতি হিসেবে আমরাও। এই এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে ভাষা, শব্দচরণে এবং ভাষার সম্মান রক্ষার্থে আরো একবার সতর্ক হই। বিকৃত রূপ দিয়ে ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় ভাষা দিয়ে অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার নয়; বরং আমাদের আছে ভাষার জন্যে জীবন দেবার গৌরবময় ইতিহাস।
এবার আসি একজন নারী হয়ে আমার চোখে নারী দিবস প্রসঙ্গে। ঘুম থেকে উঠতেই এ দিবসকে ঘিরে পাচ্ছি প্রিয় মুখগুলোর ফোন, এসএম এস, পোস্ট আর স্ট্যাটাস। সুদূর প্রবাস থেকে একজন দাদা ইনবক্সে লিখেছেন, “আপনাদের দিবসের শুভেচ্ছা”। আর আমার পক্ষ থেকেও সবার জন্যে রইলো আমাদের দিবসের শুভেচ্ছা। কিন্তু আজকের এই একটি দিনকে ঘিরে র্যালি, বিজ্ঞাপন, টকশোতে নারীর প্রতি সীমাহীন সম্মান দেখে ভাবনায় কড়া নাড়লো কিছু প্রশ্ন- ১. আমাদের দিন কি শুধু এই ২৪ ঘণ্টাই? ২. বাকি ৩৬৪ দিন আমাদের সাথে কী কী হচ্ছে, তার খবর কে রাখছে? ৩. এদেশের একটা মেয়েও কি জোর গলায় বলতে পারবে যে, সে কোনদিন কোনভাবেই হ্যারাস হয়নি?
তবে আজ আমার গল্প বলি…… আমি ফাহমিদা জেবীন নিতু; সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছি। সমাজের নিত্য চিত্র তখনও আমার কাছে অস্পষ্ট। তেমনি একদিন পরিবারের বড় ২/১ জন আর ভাই-বোনেরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম বাণিজ্য মেলায়। অসম্ভব ভিড়, তাই লাইন ধরে ভেতরে ঢোকার পালা। লাইনে দাঁড়াতেই বুঝতে পারছি ভিড়ের অজুহাতে পুরুষের অবয়বে অসভ্য এক প্রাণীর হাত বারবার কারণে-অকারণে আপত্তিকরভাবে আমাকে স্পর্শ করেই চলেছে। ঘৃণায়, রাগে, দুঃখে মেলায় ঘুরবার ইচ্ছাকে দাফন করে লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর মেলায় যাওয়া হয়নি। আজও পাবলিক প্লেসের কোন ভিড় কিংবা লাইন দেখতেই ঐ আতঙ্ক আমায় তাড়া করে। আমার মতো অনেক নিতুদের না জানি এমন কত হাজার গল্প রয়েছে! যাদের প্রতিদিন পাবলিক বাস বা ভিড়ে রোজ এমন পরিস্থিতি ফেইস করতে হচ্ছে!
তবে আসল বাদ রেখে এই একটা দিনকে ঘিরে কেন এতো মাতামাতি? সমাজের সব নারীদের কাছে কী মানে রাখে ৩৬৪ দিনের নিরাপত্তাহীন এই একদিনের নারী দিবস, তা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আমি অন্তত একদিনের অজস্র সম্মানে ঘেরা “নারী দিবস” চাই না। বছরের ৩৬৫ দিনই নারীর জন্য চাই ……………”নিরাপত্তা দিবস”।