নারীবাদ, রাজনীতি এবং বর্তমান বাস্তবতা

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

একুশ শতকের এই চ্যালেঞ্জিং বিশ্বেও নারীবাদ এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে উচ্চকিত কণ্ঠে কথা বলাটা খুব সহজতর ব্যপার নয়। আমাদের মতো দেশে তো নয়ই, বরং পৃথিবীর অনেক দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশই নারীর সম অধিকার, পুরুষের মতো সকল সুযোগ-সুবিধায় নারীর অভিগম্যতার বিষয়টিকে মনে-প্রাণে ধারণ করে না। উপরন্তু অনেক সমাজই নারীবাদী ধারণার সাথে সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধকে সাংঘর্ষিক মনে করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সত্য আরও সুদৃঢ়।

কেননা অনেকেই বিশ্বাস করেন, নারীবাদ মানেই পুরুষবিদ্বেষী। নারীবাদ নিয়ে যারা কথা বলেন প্রকারান্তরে তাঁরা সমাজের কিংবা পুরুষের শত্রু। অনেক আধুনিক, প্রগতিশীল পুরুষও তাই নারীবাদ বিষয়ক আলোচনা এড়িয়ে চলেন, যেন এই বিষয়ে কথা বললেই সংঘর্ষ হবে। আদতে নারীবাদের বিরোধিতা করলেও তাঁরা মানেন, নারী-পুরুষের সমতার কথায় যথেষ্ট জোরালো যুক্তি আছে। কিন্তু সেই যুক্তির সাথে একাত্ম হতে গেলে যে পরিমাণ ঔদার্য দেখাতে হয়, যতটুকু দায়িত্ব নিতে হয়, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তেমন শক্ত মেরুদণ্ডের পুরুষ আমাদের সমাজে অতি নগণ্য।

‘Forbes’ এ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক, বক্তা এবং নারী উন্নয়নমূলক গবেষক Kathy Caprino এর “Building a World That Works For All” শীর্ষক এক গবেষণায়, সারাবিশ্বে নারীর সমতা এবং নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেছেন,
১। পৃথিবীর মিলিয়ন মিলিয়ন লোক নারী-পুরুষের সম অধিকার এবং সমান সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি সমর্থনই করেন না।
২। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাবেন নারী-পুরুষ ইতোমধ্যেই সমতায় পৌঁছে গেছে, এ নিয়ে কোনো কাজ করার দরকার নেই।
৩। এখনও বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ ভাবেন, নারীবাদ বিষয়টি ধর্মীয়-সামাজিক বিশ্বাস, নীতিবোধ, এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক।

এই যখন সারাবিশ্বের বাস্তবতা তখন নারীবাদী কর্মকাণ্ডে সমাজ তথা পুরুষের অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত হবে না সেটাই স্বাভাবিক। মূলত, নারীবাদী মতবাদ কী চায় সেটা উপলব্ধির বিষয়, এবং যথাযথ যুক্তি দিয়ে, কোনোরকম আবেগ দিয়ে নয়।

নারীবাদের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক কী? কিংবা আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, The term ‘feminism’ itself is political. যেহেতু নারীবাদী মতবাদ সমাজের সকল ক্ষেত্রে; রাজনৈতিক, সামাজিক, লৈঙ্গিক, বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারী ও পুরুষের সম অংশগ্রহণ এবং সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, সেহেতু এই মতবাদ স্ববৈশিষ্ট্যেই রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঊনবিংশ শতকে নারীর ভোটাধিকার এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি উপস্থাপিত হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে নারীবাদী ১৯৬০-এর দশকে এক নতুন তাৎপর্য লাভ করে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত Betty Friedan এর The Feminist Mysteque বা ১৯৭০ সালে প্রকাশিত Kate Millett sexual Politics গ্রন্থে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে রাজনৈতিক প্রাধান্যের সম্পর্ক বলে অভিহিত করা হয়।

অতীতে রাজনীতি চর্চায় পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষয়গুলিকে রাজনীতির আওতার বাইরে রাখা হত। কিন্তু নারীবাদীদের মতে, যেহেতু এসব ক্ষেত্রগুলিতেও ক্ষমতার সম্পর্ক বিদ্যমান, এবং ‘পরিবারই’ নারীকে অধস্তন হিসেবে, বৈষম্য-শোষণের শিকার তৈরির সূতিকাগার, সেহেতু এগুলো অবশ্যই রাজনীতির আলোচনার বিষয়বস্তু। এ যাবতকাল বিদ্যমান সামাজিক ইতিহাস হলো শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস- পুরুষ কর্তৃক নারীকে শোষণের ইতিহাস। সুতরাং এই শোষণের উৎস সন্ধান, ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন, মতাদর্শের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়গুলি লিঙ্গ রাজনীতির এর মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

নারীবাদী প্রবক্তাগণ শ্রেণী, ধর্ম, গোত্র, ও নৃজাতি ইত্যাদির মত লিঙ্গকেও এক সামাজিক বর্গ হিসেবে দেখেন, এবং শ্রেণী রাজনীতির মত লিঙ্গ রাজনীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। প্রচলিত রাজনীতি চর্চা মূলত পুরুষের দ্বারা, পুরুষদের জন্য, পুরুষদের স্বার্থে পরিচালিত; নারীর অবস্থানের বিষয়টি সেখানে অনুপস্থিত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবারের কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের হাতে, তেমনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও পিতৃতান্ত্রিকতা লক্ষণীয়।

ষাটের দশকে নারীবাদের উদ্ভব ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, নারীর শ্রম, শিক্ষা, বেতন, এবং ভোটাধিকার প্রতিটি বিষয়ে আজকের অবস্থানে আসতে নারীকেই লড়াই করতে হয়েছে প্রচলিত আইন ও সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে। যেহেতু আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই নারীবাদী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। সুতরাং, সমাজে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সরাসরি রাষ্ট্র তথা শাসক গোষ্ঠীর রাজনীতির ঘেরাটোপে বন্দী।

বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনের মূল বিষয়গুলো ছিল- নারীর রাজনৈতিক আন্দোলন, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, জনসাধারণের নীতিমালা, ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন সংস্কার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এখানে সহজাত নারীবাদের উদ্ভব হয়েছে, যা পাশ্চাত্যের নারীবাদ থেকে ভিন্ন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মনে করতেন নারী সামাজিক জীব; নারীকে নিজের কথা নিজেকে সমস্বরে বলতে হবে, অন্য কেউ নারীর হয়ে বলবে না। তিনি তাঁর সুলতানার স্বপ্ন (১৯২৪) গ্রন্থে নারী পরিচালিত বৈচিত্র্যপূর্ণ, সমতাভিত্তিক কাল্পনিক নারীবিশ্বের চিত্র তুলে ধরেছেন, যা হবে শোষণ থেকে মুক্ত। রোকেয়া তার লেখনীর মধ্য দিয়ে সমাজের কুসংস্কার, অবরোধ প্রথার অতিরিক্ত প্রভাব, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, নারী শিক্ষা, নারীর প্রতি সামাজিক অবমাননা, নারীর অধিকার এবং নারী জাগরণের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে নারীবাদী কর্মকাণ্ডের সমর্থনে, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক চুক্তি (Convention on the Elimination of All forms of Discrimination against Women) ‘সিডও’ সনদে স্বাক্ষর করলেও অদ্যাবধি সিডও সনদের ২ নম্বর ধারা সহ ১৬(১)(গ) সংরক্ষিত রয়েছে। দুই নম্বর ধারার মূল নির্যাস হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতার নীতি রাষ্ট্রের সংবিধানে অথবা অন্য কোনো আইনে অন্তর্ভুক্ত না থাকলে তার অন্তর্ভুক্তি এবং আইনের মাধ্যমে এই নীতির বাস্তবায়ন। প্রচলিত যেসব আইন, বিধি, প্রথা ও আচরণ নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, তা বাতিল বা পরিবর্তন করা এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন। অর্থাৎ সমতার আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা এবং আইনানুগ উপায়ে তা কার্যকর করা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ১০, ১৯, ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুযায়ী সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারে সমতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, এবং নারীর অনগ্রসরতা দূর করতে বিশেষ সহায়ক বিধান করার কথা বর্ণিত রয়েছে। যা সিডও সনদের ২ নম্বর ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং, এই ধারা সংরক্ষিত রাখা সংবিধানের মৌলিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সরকারের অনীহা তথা রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সিডও সনদের নির্দিষ্ট ধারাকে সংরক্ষিত করে রেখেছে ৩৬ বছর ধরে।
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া নারী মানুষ হিসেবেই পরিগণিত হয় না। এখানে নারী বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ছাড়াও স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারে (শারীরিক নিরাপত্তার অভাব) বৈষম্যের শিকার, যা নারীর মানবাধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করছে।

নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে ২০১৮ ও ২০১৯ এই দুই বছরে নারী-যুবতী-শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যার ভয়াবহ উর্ধগতিকে চিহ্নিত করা যায় (সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০)। যদিও, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারিত করে রাষ্ট্র খানিকটা দায় এড়াতে চাইছে। তবে, সেখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি! বিচারহীনতা কিংবা ন্যায়বিচারের অভাব, আইনের অপপ্রয়োগ, এবং সর্বোপরি ধর্ষণ বন্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছাকেই দায়ী করা যায় সরাসরি।
নারীবাদী ধারার নতুন সংযোজন হিসেবে I- feminism এর কথা বলা হয়েছে। Ifeminists believe that freedom and diversity benefit women, whether or not the choices that particular women make are politically correct. They respect all sexual choices, from motherhood to porn. As the cost of freedom, ifeminists accept personal responsibility for their own lives. They do not look to government for privileges any more than they would accept government abuse. Ifeminists want legal equality, and they offer the same respect to men. In short, ifeminism calls for freedom, choice, and personal responsibility.

এই ধারা সোশ্যাল ফেমিনিজমের বিপরীত, যদিও দুটো ধারায়ই নারীর সমাজে পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার, সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত বলে বিশ্বাস করে। তবে, সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারি-পুরুষ ‘সমতার’ ধারনায় নারীবাদীদের মতের ভিন্নতা রয়েছে। মূলত, ‘equality’ এবং ‘sameness’ এই দুটো শব্দের পারিভাষিক অর্থ অনুধাবন এবং এর প্রয়োগই নারীর সামাজিক সমতা অর্জনের পথে অন্তরায় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

নারীর ক্ষমতায়নের কথা অনেক বলা হয়েছে। ক্ষমতায়িত হবার জন্য আগে সমতা নিশ্চিত করা দরকার। Equality is a process to reach towards women empowerment.
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আসুন নারীবাদ নিয়ে আর তর্কযুদ্ধ নয়, আমরা সমতাবাদী হই। নারীকে ব্যক্তি মর্যদা দেবার জন্যে নিজেদের মানসচক্ষু উন্মোচন করি। নারীকে সহযোদ্ধা করে এগিয়ে যাই একুশ শতকের প্রগতির পথে।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন।
লেখক, টরন্টো, কানাডা

(তথ্য সূত্রঃ Building a world that works for All- Kathy Caprino in Forbes,www.ifeminist.net, www.mowca.bd.org, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া এবং প্রথম আলো ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০।)

শেয়ার করুন: