আফসানা কিশোয়ার:
রাষ্ট্র বলতে আমরা কী বুঝি?- রাষ্ট্র হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত কয়েকটি পরিবার ও সমাজের সমষ্টি (এরিস্টটল)।
রাষ্ট্র হলো শ্রেণী শাসনের যন্ত্র, রাষ্ট্রের মাধ্যমে এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে শোষণ করে (লেনিন)।
ধর্ম অর্থ কী? – ধর্ম হলো একধরনের বিশ্বাস,যা প্রচলিত অর্থে মানুষের নীতিবোধকে উন্নত করে।
নারীবাদ কী? – নারীবাদ হলো নারীদের সমানাধিকার ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলন, যা পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। নারীবাদ সমাজে সমতার কথা বলে।
পিতৃতন্ত্র কী? – পিতৃতন্ত্র হচ্ছে একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে পুরুষেরা প্রাথমিক ক্ষমতা ধারণ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক সুবিধা ও সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপন করে,পরিবারের ক্ষেত্রে পিতা ও পিতৃতুল্যগণ নারী ও শিশুর উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। কিছু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একই সাথে পিতৃগোত্রজ হয়, যার অর্থ হচ্ছে এইসব সমাজে সম্পত্তি ও পদবী পুরুষের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হয়।
এই যে সংজ্ঞা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, মতবাদের সেখানে নারীর অবস্থান কী? কেন আলাদা করে নারীর জন্য নানা তরিকা ভাবতে হয়? এ ধরনের ভাবনার বিস্তারের পাশেই রচিত হয় ব্যক্তির অভিজ্ঞতা। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ঋণাত্মক হয় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে,যখন জাতিগত দমন নীপিড়ন হত্যাযজ্ঞ চলে। এমন ই এক জাতিসত্তা রোহিঙ্গা। যারা ২০১৭ সালে মিয়ানমার আর্মি,পুলিশ ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর এক অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে গণবাস্তুচ্যুতির সম্মুখে পড়ে এবং শরণার্থী হিসেবে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই বিপুল শরণার্থীদের ক্যাম্পে কাজ করার জন্য দেশি-বিদেশি অনেক সংস্থা কক্সবাজার, টেকনাফ এ আসে। কুতুপালং হয় এই গ্রহের সবচাইতে বড় শরণার্থী শিবিরের একটি।
এসব ক্যাম্পে কাজ করার সময় নারী ও শিশু বিষয়ক নানা অভিজ্ঞতাকে উপজীব্য করে সত্যকে আশ্রয় করে নিজের ওয়ার্কলগকে ফিকশনের আকার দিয়েছেন লেখক ফাহমি ইলা তার প্রথম বই “মাইয়াফোয়া’র কহন” এ।
তেরো বছরের কিশোরী,পাঁচ বছরের ভাইসহ ডোবায় ডুবে বসে আছে আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে লুকাতে, যে বাহিনী দেশের প্রতিরক্ষা করবে সেই বাহিনী নিজের দেশের নাগরিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা যেন সেই দেশে না থাকে তা নিশ্চিত করতে। যেকোনো নির্যাতনে সফল হতে হলে নির্যাতন করো সেই জনগোষ্ঠির নারী ও শিশুদের, নারীদের বয়স নির্বিশেষে ধর্ষণ হলো সেই অস্ত্র। আমাদের রুকাইয়া দেখে বাবা-মা-চাচী সবাইকে বার্মিজ আর্মির গুলিতে মারা যেতে। চাচীকে যৌন নির্যাতনের পর মেরে উলঙ্গ ফেলে রাখতে। ভাগ্যক্রমে তার চাচা বেঁচে গেলে চাচার হাত ধরে সে পাড়ি দেয় সীমান্ত, আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে, ক্যাম্পে কি তার শান্তি মেলে? আসে ক্যাম্পের প্রধান করিম মাঝির গা গুলানো কর্মকাণ্ড। পঞ্চান্নের করিম মাঝির পনেরোর রুকাইয়াকে পাওয়ার দারুণ শখ। সে শখ মেটাতে গিয়ে করিম মাঝি গায়েব হয়ে যায়। এই যে একই জাতিগত দমনের কারণে নিজের দেশ ছেড়ে আসা তাতে পুরুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তার চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী, কারণ এই স্বদেশী পুরুষ তার উপর যৌন নিগ্রহের হাতটি বাড়িয়ে দিতে পিছপা হয় না। এখানেই যুদ্ধ বিগ্রহ গণবাস্তুচ্যুতির সময় ভঙ্গুর অবস্থার সবচাইতে প্রান্তিক সীমায় থাকে নারী। রুকাইয়াকে ক্যাম্পের এনজিওকর্মী লাইলি ভালো ব্যবহারে সাময়িক উপশম দিলেও নিরাপত্তা দেয়া হয়ে উঠে না।
নিরাপত্তা কি কেউ কাউকে কোথাও দিতে পারে? সাড়ে ছয় বছরের করিমা, যে শুধু বাসায় ফেরত যেতে চায়, তাকে ছাড়ে না তার স্বদেশী ষাটোর্ধ্ব দূর সম্পর্কীয় দাদা। মাত্র ‘দশজনের’ ধর্ষণের শিকার শরিফাকে কোনভাবে বাঁচিয়ে সাড়ে চার বছরের মেয়ে করিমাসহ আমিন এসে উঠে বাংলাদেশের ক্যাম্পে। শরীফা একটি এনজিওতে ভলান্টিয়ারের কাজ করে। একদিন জরুরি একটি কেইস এলে সে করিমাকে পাশের বাসায় রেখে কাজে যায়। সেই ফাঁকে দূরসম্পর্কীয় দাদা নাতনিরও চাইতে কমবয়সী শিশুতে উপগত হবার ভীষণ চেষ্টা চালায়। শিশুর দেহ বাগে আনতে না পেরে তাকে নানাধরনের জখম করে। এ নিয়ে বিচার আচার চাইতে গেলে রোহিঙ্গাদের বলশালী গ্রুপের কাছে গুম হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয় আমিন শরিফা ও করিমার। তারা রাতের আঁধারে যেমন করে মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে এসেছিলো, তেমনি আরেক রাতে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র তাদের এক চাচার কাছে গিয়ে উঠে। শরীফা শুধু নিজেকে জিজ্ঞেস করে,পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা আসলেই আছে কিনা, যেখানে শরীফার মেয়ে করিমা নিরাপদ!
ক্যাম্পে থাকলে কি প্রেম যৌনতা থেমে থাকবে? থাকবে না। বয়সের উচ্ছ্বলতায় তাই আয়েশা প্রেমে পড়ে। বোন কলিমার সাহায্যে সেই প্রেম যখন পরিণতি পেলেও পেতে পারে অবস্থা, তখন আয়েশার দূর সম্পর্কের চাচা অন্য চাল চালে। প্রেমিককে খুঁজে পাওয়া যায় না। মোবাইলে বিয়ে হয় দূর দেশে। আসে এক কিশোরীর আত্মহত্যার সংবাদ। ক্যাম্পের কাছে একের পর এক চেকপোস্ট, আর্মি, বিজিবির, পুলিশের। অথচ মানব পাচার, আদতে নারী পাচারের মতো আদিম ব্যবসা থামে না। কোন বিনিয়োগ ছাড়া দারুণ মুনাফার ব্যবসা চলে রমরমা করে। এই যে দুরবস্থা, দেশ ছাড়া, গৃহহারা, স্বজন মৃত, এসব কোনকিছুই অনেকেকে ছোঁয় না, তারা নারীর প্রতি সেই বীভৎস দাস কেনাবেচার দৃষ্টিতেই সব অনুভবের ঊর্ধ্বে বিরাজ করে। কোন এনজিও বা সংস্থার কোথায় সাধ্যি সেই আদি ব্যবসা বন্ধ করে!
মানুষের বাচ্চা তার জন্ম কোন দুর্ঘটনায় হলে সে দায় সমাজ পরিবার রাষ্ট্র কার উপর চাপায়? আর কার উপর! নারীর উপর চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়ানো পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের জন্য অনেক সহজ। তেরো বছরের কলিমা বার্মিজ আর্মি দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে যে গর্ভবতী হয় এবং তার বৃদ্ধা দাদী নাতনির আগামীতে বিয়ে হবে না এ আশঙ্কায় যা প্রকাশ করেন না,সে দায় কার উপর বর্তায়? একটি শিশুর জন্ম হলে যে নাবালিকা কিশোরীকে মৃত্যুর চেহারা দেখে নিতে হয়, এর জন্য দোষী কে?যে সিস্টেম পিতৃপরিচয়কে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে চিত্রায়িত করে,যে সিস্টেম ধর্ষণের মতো একটি অস্ত্রকে যে কোন কাজে ব্যবহার করে, এমনকি সুশৃংখল সেনাও যা কাজে লাগাতে দ্বিধা করে না, সেই সিস্টেমই দোষী জারজ শব্দটি উদ্ভবের জন্য।
এরকম ছ’টি ঘটনা বা গল্প অথবা সত্যকথন নিয়ে ‘মাইয়াফোয়ার কহন’ এগিয়ে যায়। যেখানে নির্যাতিত নারী, যেখানে নির্যাতনের শিকারদের নানা সেবা দিচ্ছে নারী। তাই গল্পের ভেতর গল্প থাকে। আমাদের সংবিধানগুলোতে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার,আবার আমাদের বিভিন্ন দেশের সংবিধানের পাশেই সমান্তরালে চলে ধর্মীয় আইন। এই যে সাংঘর্ষিক অবস্থান রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো পরিচালনার ছকের মধ্যেই এর প্রভাব পড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা নারী এনজিও কর্মীদের পেশাগত জীবনে।

শায়লা, নীলা, লাইলি,মিতা এমন এনজিও কর্মীদের গল্পও থাকে। জেন্ডার ইকুয়ালিটির ট্রেনিং নিয়েও ইয়াসিন মিতাকে অনবরত জেন্ডার ইনসেন্সিটিভ কথা বলে যায়, সেই গল্পও লাইন বিটুইন লাইনস হালকাভাবে বুঝে যাই। টেকনাফের রক্ষণশীল পরিবেশ, কোন নারী বোরখা ছাড়া চলে না, অথচ সে স্থান আবার ড্রাগ বিজনেসের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। সেখানে এনজিও কর্মীর বোরখা না পরা অনেকের চোখে পড়ে। আমরা বুঝি চলমান কোন প্রক্রিয়াকে তার অসাড়তা বোঝাতে সবসময় চিৎকার করলেই হয় না, নিজেকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমি এই দৃশ্যমান অন্যায়টা রুখতে চাই কিনা! সে সিদ্ধান্তেই বোরখা-হিজাব না পরেও এনজিও নারীরা কাজ করে যান। সিআইসির (ক্যাম্প ইন চার্জ – সরকারি কর্মকর্তা, অনেকগুলো ক্যাম্পের রিপোর্টিং মূল পয়েন্ট, যেখানে দেশি-বিদেশি সব এনজিও রিপোর্ট করতে হয়) মতো গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে থেকে বাল্যবিবাহের এডভোকেসি যখন কেউ করে, তখন আমরা এটা পরিষ্কার দেখতে পাই ধর্মীয় বাতাবরণের আড়ালে কীভাবে কেউ কেউ পদ ও পদবী ব্যবহার করে নারীকে গহীনে ঠেলে দিচ্ছে সুকৌশলে; এর কারণ দেশে বিরাজমান ধর্মীয় আইন। আবার আরিফুলের মতো সিআইসি সব বাঁধা অতিক্রম করে নারী ভিক্টিমকে বাঁচাতেও কাজ করেন।
লেখকের এটি প্রথম বই। পাঠকের কাছে তা মনে হবে না। কারণ এর করুণরস। প্রতিটি ঘটনার সাথে যে বেদনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, কারুণ্য আমরা পাই তাতে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের গড়পড়তা মনোভাব বদলে যাবে। এনজিও কর্মীদের দুঃসহ মানসিক যাতনা,পদে পদে অন্যায়ের দুষ্টচক্র একসময় পাঠককে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তুলবে। মনে হবে কেন যুদ্ধ? কেন জাতিগত দমন, নির্মূল উদ্যোগ? কেন জরুরি পিতৃপরিচয়? কেন সেনা সদস্য হয়েও ধর্ষণে লিপ্ত হওয়া? কেন মানুষকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা? রাষ্ট্র, ধর্ম, চলমান নিয়ম, পুরুষতান্ত্রিকতা, সহিংসতা, আন্তর্জাতিক কূটচক্র এসবকে চ্যালেঞ্জ না করে কি নারীর আদৌ মুক্তি আছে?
‘গ্রন্থিক’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতব্য বইটির বিক্রয়মূল্য ২৮০ টাকা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এমন বই আমার ধারণা এটিই প্রথম।
এই বই হয়তো অনেক পাঠককে বিষণ্ণ করবে বারবার। অভিজ্ঞ পাঠক এর ভেতরের বারুদটুকু বুঝে নিবে আপন প্রাণের উত্তাপে।
ফাহমি ইলাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা এমন একটি বই আমাদের উপহার দেবার জন্য।