মাঠপর্যায়ে নারীবাদী আন্দোলন এবং বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা

উপমা মাহবুব:

মাঠ পর্যায়ে নারীবাদী আন্দোলনকে বোঝা বা বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন একটা কাজ। কারণ আমরা যে সমাজ কাঠামোয় বসবাস করি সেখানে গ্রামাঞ্চলে বা তৃণমূল স্তরে নারীবাদ বা নারী এবং পুরুষের সমতা ও সমঅধিকার, নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার ইত্যাদি নিয়ে যে কাজগুলো হচ্ছে, যে পরিবর্তন আসছে সেগুলো ঘটছে নিরবে, নিভৃতে। এগুলোর গতিপ্রকৃতি শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের মাধ্যমে পরিচালিত মূলধারার নারীবাদী আন্দোলনের মতো দৃশ্যমান ও প্রতিবাদী চরিত্রের নয়।

নারীবাদ শব্দটা শুনলেই একটি সম্মিলিত আন্দোলনের কথা মনে হয়। যেখানে নারীর সমঅধিকারের পক্ষে মানুষ কথা বলছে; বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আইন বা নীতির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলছে; মিটিং, মিছিল, সভা-সেমিনার করছে; সরকার বা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে এ্যাডভোকেসি বা লবিং করছে ইত্যাদি। এ ধরনের নারীবাদী কার্যক্রম বা উদ্যোগ গ্রামাঞ্চলে বা প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে এখনও তেমন দেখা যায় না।

আমরা অনেকেই হয়তো দক্ষিণ ভারতের নিম্নবর্ণের নারী নাঙ্গালীর কথা জানি। প্রায় ২০০ বছর আগে ভারতের কিছু অঙ্গরাজ্যে স্তন কর বলে এক ধরণের কর প্রচলিত ছিল। সেখানে নিয়ম ছিল ব্রাক্ষণ বাদে অন্য হিন্দু নারীরা স্তন ঢাকতে পারবে না। কেউ ঢাকতে চাইলে তাকে তার জন্য স্তন কর দিতে হবে। নাঙ্গালী এই নিয়মের বিরোধীতা করে বস্ত্রখণ্ড দিয়ে তাঁর স্তন ঢাকেন এবং স্তন কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। কর আদায়ের জন্য তাঁর বাড়িতে রাজার ট্যাক্স কালেকটর হাজির হন। নাঙ্গালী তখন ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের দুটো স্তন কেটে সেগুলো ট্যাক্স কালেকটরের হাতে তুলে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ক্ষতস্থান থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয় স্তন কর প্রথা।
তবে কর বন্ধ হলেও স্তন আবৃত করার জন্য ঐ অঞ্চলের নারীদের বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করার মতো এত সাহস, জেদ বা সচেতনতা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মাঠ পর্যায়ে এখনও অনুপস্থিত বললেই চলে। অবশ্য এটাও ঠিক যে নাঙ্গালীর মতো নারীরা তৃণমূল, নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্ণের পরিবারে বহু যুগ পরপর জন্মায়।

আসলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যে গোঁড়া গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা সেখানে তৃণমূলের কেউ নারীবাদী হবেন বা পুরুষ ও নারীর সমঅধিকার বা সমতার জন্য স্বশরীরে মাঠে নেমে কাজ করবেন এটা এখনও প্রায় অসম্ভব। নারীকে অধস্তন মনে করা; বাড়ির বউকে নির্যাতন করা; বাল্যবিয়ে দেয়া; যৌতুক নেয়া; নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না দেয়া; ঘরের কাজ, সন্তান জন্মদান এবং সন্তান লালন-পালনকে তাদের প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করা; ইত্যাদি অসংখ্য বৈষম্য এবং নিপীড়নমূলক ধারণা এবং প্রথা বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনাচারকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সেগুলোর শেকড় এতো গভীর যে মানসিকতা এবং সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হওয়ার পরও এসব ধারণা বা প্রথার মধ্যে ভুল, অন্যায় বা অনৈতিকতা কোথায়, সেটা স্থানীয় জনগোষ্ঠী এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে সচেতনতাই যেখানে পুরোপুরি তৈরি হয়নি, সেখানে তৃণমূল মানুষের স্বউদ্যোগে নারীবাদী আন্দোলন হবে কোথা থেকে?

তাই বলা যায় যে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর সমঅধিকার অর্জনের কার্যক্রম ধীর গতিতে অগ্রসরমান। এখনও তাদেরকে নিজের অধিকার, যোগ্যতা, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করার এবং সেগুলো দাবি করার জন্য প্রস্তুত করার কাজটি চলমান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা এই কাজগুলো পরিচালনা করছে। তারা প্রান্তিক নারীদের অবস্থার পরিবর্তন করতে, তাদের মূলধারার উন্নয়ন কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া; তাদের অনুদান দেয়া বা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা; সমাজে জেন্ডার সচেতনতা তৈরি; বাল্য বিয়ে ও যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন; নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধে নানামুখি উদ্যোগ ইত্যাদি। এছাড়াও বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি পরিচালনা, বাল্য বিয়ে, নারী নির্যাতন রোধ ইত্যাদি কার্যক্রম তৃণমূল নারীদের ক্ষমতায়িত হতে, বিশেষ করে তাদের পরিবারে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে একদিকে প্রান্তিক নারীরা আস্তে আস্তে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত হচ্ছেন। একই সাথে যেন একটা সময় প্রান্তিক নারীরা নিজেদের অধিকার নিজেরাই দাবি করতে পারেন, তারা যেন বৈষম্যমূলক গ্রামীণ সমাজকাঠামোর বিপক্ষে দাঁড়াতে পারেন সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় ডোনারদের সহায়তা রয়েছে। পাশাপাশি কর্পোরেট রেসপন্সিবিলিটির অংশ হিসেবে অনেক কর্পোরেট হাউস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এখন প্রান্তিক নারীদের অবস্থার পরিবর্তনে বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীদের অবস্থার পরিবর্তনে নিঃসন্দেহে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বেসরকারি সংস্থার বেশ ইন্টারেস্টিং একটা অবদান আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। তা হলো বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের মূলধারার ক্যারিয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ক্রেডিট কিন্তু বেসরকারি সংস্থার উপরেই বর্তায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যখন দেশ জুড়ে একটু একটু করে উন্নয়ন কার্যক্রমের বিস্তার শুরু করে তখন থেকে তারা তৃণমূলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়োগ দিতে শুরু করে নারী কর্মীদের। একটু চিন্তা করে দেখুন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশ। রাস্তাঘাট নেই। যা আছে সেগুলো যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত। এ রকম একটা অবস্থায় বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে গিয়ে মায়েদের ঘরোয়া পদ্ধতিতে খাবার স্যালাইন বানানোর পদ্ধতি শিখিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নারী কর্মীরা। এই কাজের জন্য তাঁরা পায়ে হেঁটে বা নৌকায় দূরদূরান্তে গেছেন। সে সময়কার গোঁড়া সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সে এক অভাবনীয় ঘটনাই বটে। তাদের এই কাজটির কারণে দেশব্যাপী ঘরে বানানো স্যালাইনের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশ থেকে ডায়রিয়ায় শিশু মৃত্যুর হার লক্ষণীয়ভাবে কমে যায়।

পরবর্তীতে দেশ জুড়ে বেসরকারি সংস্থার কাজ যত প্রসারিত হতে থাকে তত নারী উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে নারী কর্মীর সংখ্যাও। এই কর্মীদের বড় অংশই স্বল্প শিক্ষিত বা ট্রেনিং প্রাপ্ত গ্রামীণ নারী। এমন একটা সময় ছিল যখন এই নারী কর্মীদের মেঠোপথে সাইকেল বা মটরবাইক চালিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় গ্রামের মানুষের কটু কথা শুনতে হতো৷ বেসরকারি সংস্থা গ্রামের বউদের বাড়ির বাইরে নিয়ে এসে তাদের বেয়াদব বানিয়ে ফেলছে, উল্টাপাল্টা কথা শিখিয়ে শশুরবাড়ির লোক বা স্বামীর মুখেমুখে কথা বলতে শেখাচ্ছে – এসব কথা শুধু বেসরকারি সংস্থার উপকারভোগী নারীদের নয়, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত নারী কর্মীদেরও পদে পদে শুনতে হয়েছে। এখনও শুনতে হয়।

গ্রামের বা তৃণমূলের নারীরা হয়ত নারীবাদ শব্দটার অর্থ ভালো করে জানেন না। তাদের অনেক বড় অংশ পুরুষতন্ত্র, নারী ও পুরুষের সমঅধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন – এসব বড় বড় টার্মের সঙ্গে পরিচিত নন। কিন্তু গ্রামের যে কিশোরীটি তার বাল্য বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পেরেছে, বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় স্বাবলম্বী হওয়া যে নারী আজকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হয়েছেন, যে উন্নয়নকর্মী নারী আজকে তাঁর সংস্থার কোন শাখা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন, তাদের প্রত্যেকের গল্পগুলো যদি শোনা যায়, তাহলে উপলব্ধি করা যাবে কতটা সাহস আর দৃঢ়তার সঙ্গে পরিবার এবং সমাজের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রবল লড়াই করেছেন।

এ কথা সত্য যে মাঠ পর্যায়ে নারীর অবস্থার যে পরিবর্তন এখন পর্যন্ত হয়েছে তা মূলত পরিবার কেন্দ্রিক। অর্থাৎ পরিবারে নারীর অবস্থানের উন্নয়ন হচ্ছে। অর্থনৈতিক অবদান রাখার সুযোগ বাড়ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে পুরো গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় এখনও নারীকে অধস্তন হিসেবেই দেখা হয়। প্রান্তিক নারীর এখনও বাজারে অভিগম্যতা নেই, সমাজপতিরা তাদের কথা শোনেন না, গ্রাম সালিশিতে বা ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মতের গুরুত্ব দেয়া হয় না। তারপরও যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা মোটেও নগণ্য নয়, বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর সমঅধিকার এবং নারী ও পুরুষের সমতা অর্জনের এই অভিযাত্রাকে তাই পরিবারের গণ্ডি থেকে বের করে সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ছড়িয়ে দিতে এখন সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহকে কাজ করে যেতে হবে। এটাই তৃণমূল নারীর অগ্রযাত্রাকে সচল রাখতে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.