দিনা ফেরদৌস:
একসময় ছেলেরা মেয়েদের সাথে ফাইজলামি করে বলতো, “আমার সোনার বাংলা” গানের পরের লাইন কী বল তো ? মেয়েরা লজ্জা পেত। ‘ভালোবাসি’ কথাটা খুব লজ্জার, কারও কারও কাছে নোংরা কথাও। তারপরও সকলে ভালোবাসতে চায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ভালোবাসা কামনা করে।
একজন মানুষের জীবনে বহুবার, বহুভাবে, বহু পরিস্থিতিতে ভালোবাসা আসতেই পারে। ভালোবাসা খারাপ নয়, ভালোবাসার মধ্যে যদি ভালোবাসা না থাকে তবেই খারাপ। শারীরিক চাহিদা মানুষের আদিম চাহিদা, সেই চাহিদা আছে বলেই প্রেম, বিয়ের দরকার হয়, কিন্তু এটাকে মুখ্য ধরেই যারা শরীরী ভালোবাসা খোঁজ়ে, তারা ভালোবাসার অবমাননা করে।
ভালোবাসা তো সেটাই যেখানে মায়া থাকবে, বিশ্বাস থাকবে, ক্ষমা থাকবে , একসাথে ঘর করার স্বপ্ন থাকবে। এখন কেউ যদি মনে করে, ভালোবাসলেই তার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, তাকে যখন তখন বেডে নিয়ে যাওয়া যাবে, তার ব্যক্তি জীবনের সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করা যাবে, সে কী পরবে, কেমনে চলবে, কোথায় যাবে, সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তবে সেটা ভালোবাসা তো নয়ই, সেটা নিয়ন্ত্রণ। আর নিয়ন্ত্রণ তাকেই করা হয় যে সুযোগ পেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এক কথায় যার উপর বিশ্বাস করা যায় না। এখন কথা হচ্ছে, যাকে বিশ্বাস করা যায় না, তার সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে কেনো?
দুনিয়ায় মেয়েদের অভাব নাকি? মেয়েদের বলছি এই কারণে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের নানাভাবে জিম্মি করে রাখার চেষ্টা করে ছেলেরাই, কখনওবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তোলে, কখনও ভালোবাসা না পেয়ে খুন, ধর্ষণ, এসিড এইসব তো আছেই। কয়জন মেয়ে ভালোবাসা না পেয়ে ছবি ভাইরাল করেছে? ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক করেছে? এসিড মেরেছে? শারীরিক নির্যাতন করেছে?
এখন একদল আক্রমণ করে বসবেন, বলবেন ‘মেয়েরা প্রেম করতে যায় কেনো’? আমি বলবো, প্রেম কী মেয়ে একা করে, ছেলেওতো করে। কই তাদেরকে তো প্রেম থেকে বিরত থাকতে বলেন না? আর প্রেম করলেই নির্যাতনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। আর এই যে দুই দিন পর পর সংবাদপত্রে খবর আসে শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনে মেয়েটি মারা গেছে, বা স্বামীর হাতে খুন। সেদিনও দেখলাম একটা মেয়েকে তার স্বামী রাস্তায় সবার সামনে মারছে পরকীয়া করার কারণে, এটা করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? এই খারাপ বউ রাখার দরকারটা কী? এখন আরেকদল বলবেন, কাবিনের টাকার জন্যে। এইখানেও আমি একই কথা বলবো, নিজের সামর্থ্যের বাইরে দেনমোহর দিতে যাবার দরকারটা কী? আপনি জানেন না আপনার ইনকাম কী, আর কত টাকা দেবার সামর্থ্য রাখেন? কোন বড়লোকের বা গরীবের বেটি যদি আপনার সামর্থ্যের বাইরে দেনমোহর ধরে তো ওখানেই বিয়ে ভাঙা উচিৎ, বিয়ে করার আগে। আমি তো বলবো এইটা ভণ্ডামি, একজন দশ লাখ টাকা কাবিন ধরলে আপনি ওইখানে চুপচাপ মেনে নিবেন, কারণ এই দামী মেয়ে না হলে আপনার চলবে না, আপনার সুন্দরী দামী মেয়ে চাই-ই, চাই যোগ্যতা থাক বা না থাক। তো আপনি ফকিরের পুত, বড় গল্প দিয়ে বড় কাবিন দেয়ার নাম করে, ওইটা সারাজীবন বাকিতেই রেখে বিয়ে করলেন, যখন পোষালো না, বউ তালাকের প্রশ্ন আসলো, তখন কাবিনের টাকা শোধ করার যোগ্যতা না থাকায়, আত্মহত্যা করে সমাজকে জানিয়ে গেলেন আপনার বউ একটা লোভী (অথচ দেনমোহরের টাকা একটা নারীর অধিকার), অথবা চরিত্রে দোষ দিয়ে সারাক্ষণ রাখলেন সন্দেহের উপর মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বউ ছাড়লেন না।
বিয়ে করেন বা প্রেম করেন যাই করেন, একটা মেয়ে যতোই খারাপ হোক, তাকে নির্যাতনের অধিকার আপনার নেই। তাকে ডিভোর্স দেন, কামড়াকামড়ির সম্পর্ক থেকে বের হয়ে। এখন বলবেন না, সংসার ভাংলে বাচ্চা কাচ্চার ভবিষ্যত খারাপ হবে, এখন যদি আপনি মরে যান, তো আপনার বাচ্চা কাচ্চার কী হবে, ভেবেছেন? জানি হাজারটা যুক্তি বানাবেন, আসলে সরে যেতে ইগোতে লাগে। তাই সমাজের সামনে তাকে খারাপ বানিয়ে ,নষ্টা দেখিয়ে, ঘোঁট পাকিয়ে তাকে সমাজ ছাড়া করতে চাইবেন। কারণ কী? কারণ আপনি ভেতরে ভতরে খুবই দুর্বল, এই বউ ছাড়া আপনার গতি নাই, এ ছোট হলেই আপনি নিজেকে বড় ভাবতে পারেন। কারণ কী? কারণ বড় হওয়ার মতো জীবনে আর কিছু করেননি, যা করলে সকলে আপনাকে বড় বলে সম্মান করে।
এখনও যেইসব ভাইয়েরা বিয়ে করেননি, তারা চাইলেই পারেন এইসব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে। প্রেম বা বিয়ে কোন সম্পর্কই স্থায়ী নাও হতে পারে, নিজেকে প্রেশারে রেখে, নিজের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে দেনমোহর দেয়া থেকে বিরত থাকুন। এখন আপনার প্রেমিকা যদি বিয়ের সময় বলে তার পরিবারের রুল হচ্ছে আট লাখ টাকার কাবিন, আর আপনার যদি ক্ষমতা না থাকে, সরি বলে সরে আসুন, তবেই না ক্ষমতাবান পুরুষ। যে মেয়ে আপনার সামর্থ্য জেনে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি, তাকেই করুন , তাহলে অন্তত কোন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে হবে না। যেই দেনমোহর দেবার সামর্থ্য কোনকালেই হবে না, তা বিয়ের মতো পবিত্র একটা বিষয়ে মিথ্যা মোহরানা লিখিয়ে মিথ্যা দিয়ে শুরু করলে, তার ফল ভালো হবার কথা নয়। এখন কেউ যদি আপনার সামর্থ্য জেনে বলে মেয়ে বিয়ে দেবে না, মুখের উপর বলুন এমন মেয়ে আপনিও চান না।
ভালোবাসা দিয়ে শুরু করেছিলাম, দয়া করে ভালোবাসাকে আর কলঙ্কিত করবেন না। আর প্রেম করলে ওইখানে মায়ার জন্ম দেন, ভরসা রাখতে দেন, শারীরিক সম্পর্কই সব নয়। কোন স্বামী- স্ত্রী’ই প্রতিদিন শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত থাকেন না, মানুষের কাজের ক্লান্তি আছে, বাইরের হতাশা আছে, অনেকের অনেক যন্ত্রণা আছে, আবার কারও কারও শারীরিক সম্পর্কে অনিহাও আছে, তারপরও যুগ যুগ একই ছাদের নিচে থাকে, সেখানে সব সময় ভালোবাসা নাও থাকতে পারে, কিন্তু দায়িত্ব আছে, বিশ্বাস আছে, ভরসা আছে। আমরা বাইরে থেকে দশ কথা বলতে পারি, কিন্তু প্রত্যেকের সম্পর্কের রসায়ন আলাদা।
যারা প্রেম করে বা প্রেমে পড়ে তারা একটা স্বপ্নের মধ্যে পড়ে আসলে, ঘরে বাপ- মা কতকিছু দেন খাবার দাবার, পোশাক ,পড়াশোনা, হাত খরচ, না চাইলেই কতো কিছু পাওয়া যায় অনায়াসেই, কিন্তু সব পেয়েও দেখা যায় প্রেমিকের দেয়া সাধারণ একটা গোলাপ ফুল বইয়ের চিপায় রাখে দিনের পর দিন, প্রেমিকের সাথে একদিন কথা না বললে এসি রুমেও ঘুম আসে না (নারী – পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হয়), প্রেমিক যখন যেখানে বলে ভুল-শুদ্ধের ধার না ধেরে তার কাছে ছুটে যায়। প্রেমিকের একটু চুমুর মধ্যে স্বর্গীয় সুখ পায়। এখন বলবেন, বিয়ের আগে এইসব পাপ। আমি বলবো বিয়ের পরেও এইসব পাপ হতে পারে, যদি দেড় টাকা দেবার সামর্থ্য না থেকে, তখন দশ টাকার বাকি কাবিন লিখিয়ে বিয়ে করেন, আর তা শোধ না করেই স্ত্রী’কে স্পর্শ করেন, তো সেইটাও অবৈধ। এখন অনেকেই গালি দিবেন কবুল পড়ে বিয়ে অবৈধ হয় কী করে, বিশেষ করে যারা বিয়েতে গিয়ে রোস্টের পিস খেয়ে আসছেন। এবার বলবো, দেখেন গিয়ে, সে কবুল বলেছে কীসের উপর ভিত্তি করে, আপনি পরে তাকে কী কাঁচকলা খাইয়েছেন!
কোন প্রেমই কখনও অপবিত্র হয় না, অপবিত্র হচ্ছে আমাদের মন, যা প্রেমকে অপবিত্র করে তুলি। কোন ছেলেমেয়ে পরিবারে বলে-কয়ে প্রেম করে না, আর বেশিরভাগ পরিবারই সন্তানদের প্রেম ট্রেম মেনেও নিতে পারেন না। তবে যার সাথে প্রেম করে তাকে বিশ্বাস ভরসা করেই আগায়, সেই ভরসাটুকু নষ্ট করে দেয়া উচিত না।
আজ হয়তো আমি বলতে পারি, মেয়েরা প্রেম করো না, বুদ্ধিমান মেয়েরা এখন প্রেমে সহজে পড়েও না। কিন্তু দুনিয়ায় সব পুরুষ তো আর খারাপ নয়, সবাইকে এক পাল্লায় মাপাও উচিত না, কিছু কিছু নোংরা অমানুষদের জন্যে। অনেক অনেক পুরুষ আছেন, যারা সত্যিকার ভালোবাসতে জানেন, ভালো বাসেন, অনেকে ভালোবাসার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করেন না। অনেকে সত্যিকারের ভালোবাসার কাঙ্গাল। কিছু কিছু নোংরা অমানুষের জন্যে তারাও হয়তো কাউকে সত্যিকার ভালোবেসে, ভালোবাসা পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন, কারণ অনেক মেয়েই এখন বিয়ে ছাড়া ভালোবাসায় বিশ্বাসী না।
আবার অনেক ছেলে এখনও ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত, উদ্দেশ্য এখন কারও সাথে এনগেজড থাকতে, চাকরি পেয়েই বিয়ে করবে। নতুবা মেয়ের বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিয়ে হলে তারা হয়তো অনেক সুখীও হতে পারতেন , কিন্ত চারপাশের পরিস্থিতি দেখে এখন মেয়েরা অনেক মেয়েরাই পরিবারের উপর সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়, ফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক ছেলেই তার কামনার মানুষটিকে পায় না।
সবাই যে শরীরে প্রেম খোঁজে তা না, প্রেম সম্পর্কে ভুল মেসেজ দেয়ার কারণে মানুষ প্রেম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর যেইসব মেয়েরা প্রেম বিশ্বাস করে কাছে যাচ্ছে, তারাই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তাই অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের এক হওয়া উচিৎ, প্রতিবাদ করা উচিত। যা অন্যায় তা সব সময় অন্যায়, আর অন্যায়কারীর পক্ষে কোন যুক্তিই আসলে যায় না। প্রেম নয়, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত অপরাধ গুলোকে। প্রেম করে মানুষ পরবর্তীতে বিয়ে করার উদ্দেশ্য, সংসার করে সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য। আর অপরাধ, সেই সঙ্ঘবদ্ধ সমাজে আঘাত আনে, সমাজকে কলুষিত করে আরেকটা অন্যের জন্ম দেয়। আসুন আমরা সকলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করি ।