কেন সেক্স এডুকেশন জরুরি!

দিনা ফেরদৌস:

আমার এক বান্ধবীর বান্ধবী বিয়ের ১৪/১৫ দিনেও তাদের কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি জেনে অনেকেই নাকি বলাবলি করেছিলেন বরের হয়তো কোন সমস্যা আছে। মুরুব্বিদের অনেকেই তাদের কাছে খবর কী জানতে চাইলে সেই বান্ধবী লজ্জায় বেশি কিছু বলেনি। পরে সে আমার বান্ধবীকে বলে যে, তার ভয় লাগছিল আর ব্যথা পাবার কারণে তার বর বলেছেন যে, তুমি আমার বিয়ে করা বউ, উড়ে তো আর যাচ্ছো না, সারাজীবন পড়ে আছে, আমরা আরও চেনাজানা হই তারপর…। তাদের এখন তিন বাচ্চা আর খুব সুখী একটি পরিবার।

এই গল্পটা এতো খোলামেলা বলার কারণ হচ্ছে যে, পুরুষদের কোন কারণে বলা হয় প্রথম রাতেই বিড়াল টিড়াল মারতে হবে, ক্ষমতা/তাকত্ দেখিয়ে দিতে হবে, না হলে বউ প্রথমদিনেই নপুংসক ভেবে বসবে। অথচ ব্যাপারটা অনেক ছেলের কাছেও নতুন, তাদেরও লজ্জা লাগে, তাদেরও নতুন একটা মানুষের সাথে সহজ হতে সময় লাগে। এটা মেয়ের বাড়ির লোকেরা বলে। আর ছেলের বাড়ির লোকেরা পারলে সোজা বিছানার চাদরে রক্তের দাগ দেখতে আসে (যদিও শহরের দিকে এখন আর কেউ সহজে বেডরুমে ঢুকেই না, গ্রামের দিকে আছে)। ফলে যাদের সেক্স সম্পর্কে ধারণা কম, তারা এইসব চটকদার কথায় বিশ্বাস করে, বিয়ের রাতেই জোরজার করে শারীরিক সম্পর্কে চলে যায়। আর যারা সাধারণ জ্ঞান রাখেন, তারা সময় নেন। এই সময় নেয়ার ফলে সম্পর্কও সুন্দর হয়, ভালোবাসা তৈরি হয়, শারীরিক সম্পর্কটাও সহজ হয়।

তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা সম্পর্ক বলতে সেক্স করাই বোঝে। মনে করে প্রেম করলে আগে সেক্স করতে হবে, সম্পর্ক শেষে থাক বা না থাক। আমি অনেক ছেলেদের বলতে শুনেছি, “ওরে তো আমি খেয়ে ফেলছি, এখন যেই বিয়ে করুক, আমার জুঠা’টা পাবে”। আমি বহু মেয়েদের জানি যারা শারীরিক সম্পর্কে মোটেও আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও জোর করে তার সাথে সম্পর্কটি স্থাপন করা হয়েছে, বিশেষ করে যারা দেখতে খুব সুন্দরী বা পড়াশোনায় ভালো। কারণ সুন্দরী মেয়েদের বিয়ের জন্যে পাত্রের অভাব হয় না, অন্যদিকে পড়াশোনায় যারা ভালো, তারা যদি ছেলেটিকে পড়াশোনায় ছাড়িয়ে যায়, তো বিয়ে করতে পরে যাতে অস্বীকার করতে না পারে। তবে এইসব কথা বেশিরভাগ মেয়েরাই শেয়ার করতে পারে না, তখন নিজের বন্ধুরাই বলে, এর সাথে সম্পর্ক রাখতে যাস কেনো? আর নিজের প্রেমিক যখন ধর্ষকের ভূমিকা পালন করে, তখন বলার আসলে জায়গা থাকে না।

তবে আমি বিশ্বাস করি, যারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে বিশ্বাসী, তাদের বেশিরভাগই শেষে আর বিয়ে করে না (তবে সবাই যে করে না, তা নয়)।
অনেক সময় আছে, কৌশলে মেয়েটিকে চা/কফি/কোকের সাথে ওষুধ মিশিয়েও দেয়, বিশেষ করে পরবর্তীতে যাদের ব্ল্যাকমেইল করার ইচ্ছে থাকে। এইসব ক্ষেত্রে জোড়াজুড়ির চিহ্ন পাওয়া যায় না।

কলাবাগানে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ আমার কাছে সন্দেহজনক। এর আগেও একবার আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের ঘটনায় মেয়েটির বর্ণনায় পাওয়া যায় ইয়াবা সেবনের কথা।
একটি মৃত্যু অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিছুদিন আগেও ১৪ বছরের মেয়ে নুর নাহারের সাথে স্বামী জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে প্রায় এক মাস ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করে পরবর্তীতে মারা যায় মেয়েটি, আর এই মেয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মারা যায়, বিষয়টি কেমন গোলমেলে লাগছে।

এজন্যই আমি সব সময় বলি সেক্স এডুকেশনের দরকার আছে। সেক্স এডুকেশন হচ্ছে, সেক্স সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ধারণা লাভ, যার ফলে একটা দায়িত্ব ও ভালোবাসা জন্মায় যে কীভাবে সেক্স করলে তা আনন্দদায়ক হবে, এবং অযাচিত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা যাবে। অনেক সময় দেখা যায় আপনি চাচ্ছেন একটু দেরিতে বাচ্চা নিবেন নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে, তখন সেক্স এডুকেশন থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে নিরাপদ সেক্স করা যায়। সেক্স এডুকেশন থাকলে এই যে টিনেজ বয়সে বাচ্চাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটু আকর্ষণ থাকলেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বিছানায় নিয়ে যাবার, তখন তা না করে সতর্ক হয়ে যাবে। আর তখন এই সেক্স এডুকেশন না থাকায় তারা ঝোঁকে পর্নোগ্রাফির দিকে। ওইখান থেকে ভালো কিছু শিখার কথা নয়, নোংরামি ছাড়া। আর বাচ্চারা যখন একা চলতে শুরু করে আপনি চাইলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, যদি না সে নিজ থেকে ভালো থাকতে চায়। এই ঘটনা ঘটার আগে দিহানের মা-বাবাও হয়তো ভাবতেন তাদের ছেলে দুনিয়ার কিছু বুঝে না। শারীরিক চাহিদা মানুষের জৈবিক চাহিদা, সব প্রাণীই তা জানে। তাই যা জানা হবেই একটা সময়ে, তা যাতে সুন্দরভাবে হয়, সেইদিকেও খেয়াল রাখা আমাদের দায়িত্ব।

অনেকে এখন জ্ঞান বিলাবেন বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষা দিন, নৈতিক জ্ঞান দিন। নৈতিক ধর্মীয় জ্ঞান নিয়ে মসজিদ/মাদ্রাসায় ধর্ষণের যেই সেঞ্চুরি চলছে তা শুনতে খারাপ লাগলে আমাকে দুই কথা শুনিয়ে দিলেই যদি বন্ধ হয়ে যা, তো বলেন। আপনি নৈতিক শিক্ষা দিলেন সন্তানদের, তারা সেই জ্ঞান লাভ করে ফেইসবুকে দিনরাত ধর্মীয় বাণী দিতে দিতে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুললো, আপনার মতো পিতামাতাকে উঠতে বসতে সালাম দিল, জানলো ছেলেমেয়েরা আলাদা জাতি, একপক্ষ আগুন তো অন্যপক্ষ ঘি, কাছে গেলেই গলে যায়। আপনি দেখলেন মেয়ে আপনার বোরকা পরে কলেজে যায়, ভাবলেন ঠিকঠাক চলছে, ছেলের থুতনিতে দুই গোছা দাড়ি দেখে ভাবলেন ছেলে ঠিক রাস্তায় আছে। তবে যখন এক বোরকাওয়ালী ও এক দাড়িওয়ালার কোন কারণে ধাক্কা খেয়ে প্রেম হয়ে গেলো, দুজনেই তখন ভাবতে লাগলো স্বর্গ হতে আসছে প্রেম, তাকে দিতে হবে হৃদয়ে স্থান, তারপর কাছাকাছি দুইদিন থাকতে না থাকতেই, সব নৈতিকতা চলে গেলো স্বর্গে, পড়ে থাকলো দুই শরীর। কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে আমরা জানি না কিছুই, বেশিরভাগই অজানা থেকে যায়। আর আমরা বসে নৈতিকতার গান গাই।
যান ওই ছেলের ফেইসবুক ঘেঁটে আসেন, ইনশাআল্লাহ, সব ধরনের নৈতিক জ্ঞান পাবেন আশা রাখছি। এইসব কাজ কোন ছেলেমেয়েই পরিবারকে জানিয়ে করে না। আর শরীর আপনার জ্ঞানের ধার ধারে না। ওইখানে লাগে মগজ, যা জ্ঞান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জানি একদিন আপনারাও লাইনে আসবেন, তবে সময় থাকতে এলে আমাদের সন্তানেরা ভুল রাস্তা থেকে বাঁচবে। সন্তানদের সাথে আমাদের পিতা-মাতার আরো ঘনিষ্টভাবে মেশা উচিত, তারা কোথায় যায়, কী করে, তার খোঁজ খবর রাখা উচিত। বিশেষ করে ছেলেদের সাথে বাবারা, ও মেয়েদের সাথে মায়েরা সেক্স নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার। এখন বলতে পারেন, আমি কি বাবা- মাকে বেহায়া হতে বলছি! তবে শুনুন, আপনার মেয়ে যদি বিয়ের আগে গর্ভধারণ করে, তখন তো ঠিকই হসপিটালে নিয়ে ক্লিন করিয়ে আসবেন, অথবা বাচ্চা বেশিদিনের হয়ে গেলে রাস্তাঘাটে ফেলে রেখে আসবেন, তখন বেহায়া লাগে না?
আর দিহানের বাবাকে গিয়ে এখন জিজ্ঞেস করে দেখেন, আপনার অনুভূতি কী জনাব? আশাকরি, উত্তর পেয়ে যাবেন। ওইসব লাজ-লজ্জার আগে দরকার, আমাদের বাচ্চাদের সেইভ করা। আবারও বলছি, সেক্স এডুকেশনে সেক্স করা শেখায় না, সেক্স করা সব প্রাণীই জানে কোন জ্ঞান ছাড়াই। কিন্তু সুস্থভাবে সেক্স করা জানে খুব কম মানুষই, যার ফলে বিয়ের পরের দিনই বহু নারীকে হসপিটালে যেতে হয়, আর নূর নাহারের মৃত্যুর উদাহরণ তো আছেই।

এখনও সময় আছে, বাচ্চারা বাইরে থেকে ভুল জ্ঞান নিয়ে কোন ভুল করার আগে, আমাদের পিতা-মাতাই পারেন তাদের সঠিক জ্ঞান দিতে, বিশেষ করে যারা টিনেজ তাদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে। সেই সাথে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও সেক্স এডুকেশন নিয়ে আলোচনা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।

শেয়ার করুন: