নারী নাপাক, তাই কাজী হইবার যোগ্যতা নাই

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

বাংলাদেশে নারীরা প্রধানমন্ত্রী, বিমানের পাইলট, ডাক্তার, পুলিশ, আর্মিসহ সকল কাজে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করিলেও নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী হওয়ার  যোগ্যতা প্রমাণ করিতে ব্যর্থ হইয়াছেন। কারণ তাহারা ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে তাহারা নারী।

যুক্তি হিসেবে মহামান্য আদালত যাহা বলিয়াছেন তাহা হইলো- যেহেতু নারীরা মাসের একটা নির্দিষ্ট সময় নাপাক (ধর্ম মতে) থাকেন, আর মুসলিম বিবাহ যেহেতু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিবাহের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে, তাই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।

আমি নিতান্তই নির্বোধ, তাই মনে প্রশ্ন, বাংলাদেশের নারীদের মসজিদে গিয়ে নিকাহ করার অনুমতিটুকু আছে তো, নাকি সেটিও স্থগিত করা হইয়াছে?
ধরুন আজ যে নারীর বিবাহের তারিখ ঠিক হইলো, তাকে কি জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে মাসের ঠিক কোন সময়টিতে তিনি নাপাক থাকিবেন? যদিওবা জিজ্ঞাসা করা হইলো, কোন কারণে নাপাক হওয়ার তারিখটি যদি এদিক-সেদিক হইয়া যায় (যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা), তখন কি বিবাহ স্থগিত হইয়া যাইবে?

বালিকা হইতে যুবতীকাল, ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরিয়া যে দেশে বসবাস করিয়া আসিয়াছি, শ’খানেক বিবাহ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকিয়াছি, পেট পুরিয়া খাইয়াছি, কোন বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখিলাম না নারী-পুরুষ দলে দলে মসজিদে যাইতেছেন বিবাহ করিতে। বেশিরবাগ সময়ে কাজীকে ঘরে বা কমিউনিটি সেন্টারে ডাকিয়া বিবাহ রেজিস্টার করা হইতো। আজই প্রথম খবরের কাগজে হাইকোর্টের এই গুরুত্বপূর্ণ রায়টি সম্পর্কে পড়িতে যাইয়া জানিতে পারিলাম, আজকাল বেশিরবাগ বিবাহ মসজিদে সম্পন্ন হইতেছে। বিবাহের মতো এহেন ধর্মীয় ব্যাপার-স্যাপার মসজিদেই শোভা পায়, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। দেরিতে হইলেও বাংলার মুসলমান নারী-পুরুষ সুপথে আসিয়াছেন দেখিতে পারিয়া আমি যারপরনাই আহ্লাদিত।

পাশাপাশি নিজের বিবাহটি মসজিদে করিতে না পারিয়া মনের মধ্যে খচখচানি বাড়িয়া চলিয়াছে। ভাবিয়াছি, ওজু করিয়া স্বামীর সামনে আজই মসজিদে যাইয়া দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবার প্রস্তাব উপস্থাপন করিবো। না না, অন্য কোন পুরুষকে নয়, যিনি আছেন তাহাকেই। অবশ্যই যে দিনগুলোতে আমি নাপাক থাকিবো না, সেইরকম কোন দিন দেখিয়া বিবাহটা পোক্ত করিতে মসজিদে যাইয়া উপস্থিত হইবো, এমনটাই আশা।

চিন্তার কথা একটাই শিশু জন্মের পর আমার নাপাক হবার দিনক্ষণের আবার ঠিক-ঠিকানা নাই। কবে যে নাপাক হইবো স্মরণে থাকে না। এবার হইতে নাপাক হবার সম্ভাব্য দিনক্ষণ ডায়েরিতে টুকিয়া রাখিতে হইবে। বালিকা হইতে যুবতী হইয়া কী যে বিপদে পড়িয়াছি, মাসে মাসে নাপাক হইয়া যাই। নাপাক না হইবার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করিতে পারিলে ভালো হইতো। উপায় একটা আছে, তাহা হইলো চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া এবং পরামর্শ মোতাবেক ওষুধপাতি খাওয়া বা নাপাক হইবার যন্ত্রপাতি কাটিয়ে ফেলিয়া দেওয়া।

নাপাক হইবার যে অচ্ছুত অঙ্গটি আমার শরীরের ভিতর অবস্থান করিতেছে, যাহার নাম জরায়ু, যেইখানে মানব শিশু বাড়িয়া উঠে, চাহিলে সেটিকে কাটিয়া বাদ দেওয়া যাইতে পারে। এই নাপাক প্রজননতন্ত্রটি-ই যে নারী স্বাধীনতার অন্তরায়, তা বোধ করি অনেকেই বুঝিয়াছেন।

তবু প্রশ্ন থাকিয়া যায়, যে নারীর মাসে মাসে নাপাক হইবার কোন সম্ভাবনা নাই, তিনি কি কাজী হবার যোগ্যতা রাখেন? প্রাকৃতিকভাবেই একটা বয়সের পর নারীর নাপাক হবার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না, কিন্তু তিনি কর্মক্ষম থাকেন, তাহলে কি মেনোপজ হইয়াছে এরূপ কর্মক্ষম নারী কাজী হবার যোগ্যতা রাখেন? তাছাড়া মাসের যে দিনগুলো নারীরা নাপাক থাকিতেছেন না, সেই দিনগুলো কাজী হইতে বাধা থাকিতেছে কেন?

নির্বোধ আমি, ছুত-অচ্ছুত বুঝিতে জীবন পার হইয়া যাইতেছে, তাই কারো কোনরূপ অনুভুতিতে আঘাত লাগিলে নিজগুণে ক্ষমা করিবেন।

 

লেখক: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট
নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

শেয়ার করুন: