আলী আদনান:
এক
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী আনুশকা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি কোনভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এমনটি আর কখনও কারও জীবনে ঘটুক, সেটাও প্রত্যাশিত নয়। এ ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি যেমন উঠেছে, তেমনি এ সুযোগে কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থ হাসিলেও তৎপর হয়েছেন।
তার মধ্যে একটি হলো ‘নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব’ ও অন্যটি হলো ‘গ্রুপ স্টাডি’। আনুশকা- দিহানকে নিয়ে যতেগুলো নিউজ পড়লাম সবগুলো নিউজের কমেন্ট বক্সে একটি পক্ষ নারী পুরুষের বন্ধুত্বের উপর সকল দোষ চাপাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আনুশকা’র মৃত্যুর দায়ভার নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের উপর বর্তাবে কেন?
আনুশকা মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে দিহানের সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই মিলন কী ইচ্ছাকৃত ছিল, নাকি তাকে বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করা হয়েছে, উভয়ের সম্মতিতে শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় ওরা জড়ালেও একপর্যায়ে সেটা ধর্ষণে রূপ নিয়েছিল কিনা অর্থাৎ আনুশকা ওর কাছ থেকে রেহাই চেয়েছিল কিনা, ‘বিকৃত’ শব্দটি বারবার বলা হচ্ছে- কিন্তু সেটাও কোন ধরনের বিকৃতি- সব মিলিয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও পাইনি।
একইভাবে আমরা এখনও নিশ্চিত হইনি দিহান – আনুশকার বন্ধুত্বের ধরনটা কেমন ছিল, সেই বন্ধুত্বে সততা কতোটুকু ছিল, একটি পক্ষ নিজের লোভ চরিতার্থ করার জন্য বন্ধু সেজেছিল কিনা, সেই বন্ধুত্বের আড়ালে কোন ধরনের প্রতারণা লুকিয়ে ছিল কিনা, দিহান আগে যাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তাদের পরিণতি কী- এরকম অনেক প্রশ্ন কিন্তু এসে যায়, যা হয়তো আমরা ধীরে ধীরে জানবো। কিন্তু এরমধ্যেই একটি পক্ষ “নারী পুরুষের বন্ধুত্ব সবকিছুর জন্য দায়ী”এমন আওয়াজ নিয়ে মাঠে নেমেছে এবং একটা ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।
নারী পুরুষের বন্ধুত্ব পৃথিবীতে সবচেয়ে মানবিক সম্পর্কগুলোর একটি। ‘বন্ধুত্ব’ কথাটা যখন এসে যায়, তখন সেখানে ‘নারী’ ‘পুরুষ’ শব্দ দুটো হাস্যকর হয়ে যায়। বন্ধুত্বের মতো মানবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে লৈঙ্গিক পরিচয় যদি এসে যায়, তাহলে বুঝতে হবে হয় সেটা বন্ধুত্বে রূপ পায়নি, কিংবা এই লোক দেখানো বন্ধুত্বের আড়ালে অন্য উদ্দেশ্য আছে। স্বার্থ হাসিলের জন্য কতোজনই তো কতোকিছু সাজে। সেটা যে সাজে তার দোষ, সম্পর্কের দোষ নয়।
‘বন্ধুত্ব’ যখন লুকোচুরির ব্যাপার হয়, বন্ধুত্বে যদি কোন অভিপ্রায় থাকে তখন সেটা আর যাই হোক ‘বন্ধুত্ব’ হয় না। আপনি যদি সেটাকে ‘বন্ধুত্ব ভেবে থাকেন তাহলে দায়ভার আপনার। বন্ধুত্বের নয়।
দুই
মৌলবাদিতা আমাদের চরিত্রে সুবিধাবাদিতা এনে দিয়েছে। আমরা যা চাই তা বলি না, যা বলি তা করি না, যা করি তা লুকিয়ে যাই। নারী পুরুষের বন্ধুত্বের মধ্যেও এমন নানা ধরনের জটিলতা আমরাই আমাদের স্বার্থে এনে দিয়েছি।
আচ্ছা, বন্ধুত্ব সম্পর্কে যাওয়ার আগে আমরা একটু ‘প্রেম, নিয়ে কথা বলি। নারী পুরুষের বন্ধুত্ব ও নারী পুরুষের প্রেম নিশ্চয় এক বিষয় নয়। প্রেম নির্দিষ্ট। বন্ধুত্ব নির্দিষ্ট নয়। প্রেমে একটা কমিটমেন্ট এসে যায়। বন্ধুত্বেও কমিটমেন্ট আছে, তবে সেটা প্রেমের মতো সুনির্দ্দিষ্ট নয়। আমাদের সমাজে প্রেম নারী পুরুষকে ঘর বাঁধতে অনুপ্রেরণা দেয়, স্বপ্ন দেখায়৷ কিন্তু বন্ধুত্ব মুক্তবিহঙ্গ। এ সম্পর্ক পৃথিবীর কোনকিছুকেই তোয়াক্কা করে না। আশেপাশে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা দেখি যেখানে ছেলেটি মেয়েটিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মেয়েটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তা মেনে নেয়। কিন্তু বন্ধুত্বে দু’জনেই সমান। কেউ কারও শাসনের ধার ধারে না। বন্ধুত্বে থেকেও অনেক তরুণ-তরুণী ঘর বাঁধছে। তবে সেই বন্ধুত্ব যখন প্রেমে রূপ পায় তখনি তারা স্বপ্নটা দেখা শুরু করে, তার আগে নয়।
নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব একটা বিশ্বস্ততায় পৌঁছালে শারীরিক সম্পর্ক হতেই পারে। এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। শারীরিক সম্পর্কটা আসলে দু’জন তরুণ-তরুণীর বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করে। এখানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম- এসবের কোনটিরই কিছু করার নেই। ছেলে – মেয়ের বন্ধুত্বে যেমন শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হতে পারে তেমনি স্বামী স্ত্রী একই ছাদের তলায় বসবাস করলেও বছরের পর বছর তাদের শারীরিক সম্পর্ক নাও হতে পারে। শারীরিক ঘনিষ্ঠতার জন্য যেটা দরকার, সেটা হলো, দু’জনের পারস্পরিক বোঝাপড়া।
পারস্পরিক বোঝাপড়া জোর করে হয়না। যখন হওয়ার তখন হয়ে যায়। একজন তরুণীর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক৷ তিনি আমার সবকিছুই পছন্দ করেন। কিন্তু আমার সাথে শারীরিক সখ্যতা গড়ার কোন অভিপ্রায় তার নাও থাকতে পারে। তিনি আগ্রহ না দেখালে আমাদের সম্পর্কটার নাম যাই হোক না কেন, হোক সেটা স্ত্রী, প্রেমিকা, বান্ধবী- জোর করার কোন অধিকার আমার নেই।
আবার আমার স্ত্রী, প্রেমিকা বা বান্ধবী আমার সাথে সেক্স করতে রাজী হয়নি, তার মানে এই নয় সে আমাকে অপছন্দ করে। হতে পারে সে এটার জন্য শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না, বা এটা তার মাথায় নেই, বা সে এটা নিয়ে ভাবছে না, বা তার এ সংক্রান্ত অভিপ্রায় নেই। আমি আবারও বলছি, অভিপ্রায় থাকাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু কারো অভিপ্রায় না থাকলে আপনি জোর করতে পারবেন না, বা এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে তিনি বিরক্ত হোন বা পুরো ব্যাপারটাতে কোন অশোভনীয়তা প্রকাশ পায়।
শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অশোভনীয়তা নয়। অশোভনীয়তা হচ্ছে আপনার অনধিকার চর্চা বা কাউকে বিব্রত করা। আরেকটা বিষয় আরও সহজভাবে মাথায় রাখা উচিত। সকল বন্ধু প্রেমিক নয়। কিন্তু সকল প্রেমিক আগে একজন ভালো বন্ধু হওয়া আবশ্যক।
‘বন্ধুত্ব’ হওয়া বা ‘প্রেম’ হওয়া আর চাকরি হওয়া এককথা নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে বন্ধু বানানোর কিছু নেই। ‘তুমি আমার বন্ধু হবা’ এমন সংলাপ অনেকে আওড়ালেও এর বাস্তবতা ভিত্তিহীন। বন্ধুত্ব যখন হওয়ার হয়ে যায়। বন্ধুত্ব বলে-কয়ে হওয়ার বিষয় নয়। সবার ‘বয় ফ্রেন্ড’ আছে ‘ জাস্ট ফ্রেন্ড’ আছে কিন্তু আমার নাই। সমাজে আমার স্ট্যাটাস থাকলো না। আমাকেও যেভাবে হোক ‘বিএফ’ ‘জিএফ’ ম্যানেজ করতে হবে এমন ট্রেন্ডও ভয়াবহ।
তিন
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ‘নারী পুরুষের বন্ধুত্ব’ শব্দটা মন থেকে নিতে পারেনি, এখনো পারছে না। কারণ এ সমাজ নারীকে অবদমিত রাখতে শিখিয়েছে। আমাদের মগজে ঢুকানো হয়েছে নারী নিচে থাকবে। সমাজে, সংসারে এমনকি সেক্সের সময়ও নারী নিচে থাকবে। পুরুষ থাকবে উপরে। কিন্তু নারী ও পুরুষ যদি বন্ধু হয়ে যায়, তখন নারী আর নিচে থাকছে না। দু’জনই সমান হয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে অবদমনের সুযোগ নেই। ডিমের খোসার মতো পুরুষতন্ত্র এটাকে হুমকি হিসেবে নিচ্ছে।
আগেও বলেছি, আশেপাশে পরিচিত অপরিচিত অনেক প্রেমেও আমরা পুরুষতন্ত্র প্রত্যক্ষ করি। মেয়েটি সম্পর্কের খাতিরে তা মেনে নেয়। যেহেতু প্রেমেও পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা পাচ্ছে সেহেতু অনেকক্ষেত্রে সমাজ প্রেম নিয়েও তেমন উচ্চবাচ্য করে না। শুধু শর্ত জুড়ে দেয়, বিয়ে করো। কারণ, বিয়ে হলেই পুরুষতন্ত্রেরই লাভ। দমনের সুযোগ আরো বেশী পাওয়া যায়। কিন্তু নারী পুরুষের বন্ধুত্বে পুরুষতন্ত্রের কোন লাভ তো নেই বরং অনেকটা চপেটাঘাত সমাজের মুখে।
আনুশকা – দিহানের ঘটনায় পুরুষতন্ত্র একটা সুযোগ পেয়ে গেল। আমরা এখনো নিশ্চিত হইনি দিহান আনুশকার কেমন বন্ধু ছিল, সে কী আসলেই বন্ধু ছিল, নাকি ধর্ষণ করার জন্য বন্ধু সেজেছিল? যদি একজন ধর্ষক বন্ধু সেজে থাকে সেটা ধর্ষকের দোষ, বন্ধুত্বের নয়। আমাদের উচিত বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হওয়া। সমাজ থেকে বন্ধুত্ব বাদ দেওয়া নয়। যারা ইস্যুটা কাজে লাগানোর জন্য হৈ চৈ করছে, করুক। আসুন, আমরা একটু নিকট অতীতে যাই-
কুমিল্লার তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। তনু কি তার বন্ধুর হাতে ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়েছিল? নাকি সে গ্রুপ স্টাডিতে গিয়েছিল? ফেনীর নুসরাত কী তার বন্ধুর হাতে ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়েছিল? নাকি নুসরাত গ্রুপ স্টাডিতে গিয়েছিল? সুবর্ণচরের গৃহবধু কী বন্ধুর হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে? নাকি তিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েন? বেগমগঞ্জে একজন নারীকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে যখন সারাদেশে ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছিল- তার আড়ালে কি নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব ছিল? নাকি বলবেন, ঐ নারীও বন্ধুর ফ্ল্যাটে একা গিয়েছিল? মাদ্রাসাগুলো এখন বলাৎকারের নিরাপদ আশ্রয়। ঐ শিশুগুলো তো কোন বন্ধুর হাতে নির্যাতনের শিকার হয় না। তাহলে আপনারা কোন মুখে নারী পুরুষের বন্ধুত্বকে আঘাত করার জন্য বেছে নিলেন? দায় চাপাচ্ছেন গ্রুপ স্টাডির উপর?

আসলে আপনাদের উদ্দেশ্য অন্যকিছু। আপনারা নারীকে ঘরে ঢুকাতে চান। আজ গ্রুপ স্টাডির বিরুদ্ধে বলবেন, কাল স্কুল কলেজের বিরুদ্ধে বলবেন। আজ নারী পুরুষের বন্ধুত্বের বিরুদ্ধে বলছেন, কাল অফিসে নারী সহকর্মী থাকতে পারবে না – এমন দাবি তুলবেন। আপনারা সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজছেন না, আপনারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ধান্ধায় আছেন।
নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্মতিতে সেক্স হওয়া আর ধর্ষণ হওয়া এককথা নয়। যে ধর্ষক সে সবসময়ই ধর্ষক। এদেশে অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু সবজায়গায় ধর্ষক বন্ধু সেজে আসে না। বা সকল বন্ধু ধর্ষক নয়। সকল নিপীড়িত নারীও বন্ধুর ফ্ল্যাটে যায় না। কোন ধর্ষক যদি বন্ধু সাজে সেটা ব্যক্তিবিশেষের দোষ, তাই বলে দেশের সকল নারী- পুরুষের বন্ধুত্ব সে অপরাধের দায় নিবে কেন? আপনাদের জায়গা থেকেই বলি, এদেশে অনেক নারী সংসারে স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়, খুন হয়। অনেক স্বামী স্ত্রীর হাতে নিগৃহীত হচ্ছে- এমন খবর আমরা রোজ পাই। তাই বলে কী আপনারা এখন বলবেন, ‘বিবাহ প্রথা বন্ধ করা হোক’। আনুশকার মৃত্যুর দায়ভার যদি নারী পুরুষের বন্ধুত্বের উপর বর্তায় তাহলে সংসারে স্ত্রী বা স্বামী নির্যাতিত হলে বিবাহ প্রথা বাতিল হবে না কেন?
নারী পুরুষের সমতার জন্য সমাজে বন্ধুত্বের দরকার। এখানে ধর্ষক বন্ধু সাজার সুযোগ পাচ্ছে সেটা আমাদের সিস্টেমের সমস্যা, বন্ধুত্বের সমস্যা নয়। নারী- পুরুষের বন্ধুত্বের বিকল্প নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকুরী, ব্যবসা- সব জায়গায় নারীরা পুরুষের সাথে কাঁধে কাধ রেখে এগিয়ে চলছে। একটি সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনে এর বিকল্প নেই। যারা নারী পুরুষের বন্ধুত্বের বিরোধীতা করে নারী ও পুরুষকে একে অপরের শত্রু হিসেবে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে তাদের আসল উদ্দেশ্য নারীকে ঘরে বন্দী করা। যা একটি সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আনুশকার মৃত্যুর ঘটনায় প্রকৃত দোষীরা শাস্তির আওতায় আসবে এবং আমরা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হব সেটাই প্রত্যাশা।
(লেখক: আলী আদনান, লেখক, সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।
e mail: [email protected])