যে রকম বীজ বপন করা হবে, ফল তো তেমনই আসবে!

রোকসানা আক্তার ঝর্ণা:

নিউজফিডে একটা নিউজের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি, কারণ অপরাধী এই ছেলেগুলো আমার ছেলেরই বয়সী মানে ১৭ বছর বয়সের। ওরা ওদেরই সমবয়সী সহপাঠীকে গ্রুপস্টাডির কথা বলে বাসায় ডেকে নিয়ে চারজন মিলে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে ছেলেগুলো মেয়েটির মাকে ফোন করে বলেছে স্টাডি করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই এখন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এরপর ওরা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধর্ষণের ফলে পায়ু এবং যোনিপথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটি মারা যায়।

আমি এই নিউজের সাথে অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মন্তব্যগুলোও পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে একদিকে যেমন মন বিষাদে পূর্ণ হচ্ছিল, তেমনি অন্যদিকে প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হচ্ছিলাম। এই পুরুষগুলো কোন গ্রহে বাস করে? আমরা কি আসলে মানুষের পর্যায়ে আছি? মানুষ কোথায় একটা অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের বিচারব্যবস্থাকে বাধ্য করবে অপরাধী যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়, বরং তা না করে মানুষ সেই অপরাধের দায়ভার সেই ভিকটিমের উপর এবং তার পরিবারের দায়িত্বহীনতা নিয়ে সমালোচনা করছে।

আবার কিছু মানুষ নারীদের চলাফেরার উপর ধর্ম কী বলেছে, আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে মেয়েদের জন্য কী প্রথা , রীতি নীতি কপচাতে কপচাতে এই অপরাধের ভয়াবহতা , নৃশংসতা ভুলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নারীদের চলাফেরার উপর এক একজন বুদ্ধিজীবীর মত উচিত অনুচিত মতামত দর্শাচ্ছেন। আসলে আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকাংশ পুরুষদের চিন্তা ভাবনারই প্রতিফলন হচ্ছে এই মন্তব্যগুলোতে। সাথে আবার কিছু লেঙ্গুরবিশিষ্ট নারীও আছেন। পৃথিবী বিভিন্ন দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে সমতার ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে নারীদের ক্ষেত্রে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধ এখনও মধ্যযুগীয়।

কেউ কেউ লিখছে, এই মেয়ের বাবা মায়ের উচিত হয়নি ছেলেদের সাথে মিশতে দেয়া, মেয়েটি কেন একা ছেলের বাসায় যাবে! ইসলামে ছেলেমেয়েদের একসাথে উঠাবসা নিষেধ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলি , ইসলাম কি তাহলে বলেনি পুরুষদের যে, তোমাদের স্বভাব এবং চোখকে সংযত রাখো! নিজেদের কু স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করো! আর ধর্ম যদি মানুষের স্বভাব আর আচরণকে নিয়ন্ত্রণই করতো, তবে মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় পুরোধাদের দ্বারা এতো বলাৎকার ঘটতো না।

মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রবৃত্তি থাকে। একটা ধনাত্মক, আরেকটা ঋণাত্মক। এই ঋণাত্মক প্রবৃত্তি মানুষ দমন করে তার মূল্যবোধের দ্বারা। মানুষের মধ্যে এই মূল্যবোধ তৈরি হয় পারিবারিক এবং সামাজিক সুশিক্ষার মাধ্যমে। এই মূল্যবোধ মানুষের ভিতরে একদিনে তৈরি হয় না। এর জন্য মানুষের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায় আছে। কারণ মানুষ যখন একটা বিষয় জানে এবং বুঝে, তখন সেই বিষয়টাকে যুক্তি দ্বারা বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে সেই বিষয়ের ভালো মন্দ এবং করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। এভাবেই মানুষ বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষা লাভ করে। সেই শিক্ষা একাডেমিক হোক, আর সামাজিক অথবা পারিবারিকই হোক। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে মূল্যবোধেরও জন্ম হয়। অথচ নারী একজন মানুষ এবং মানুষ হিসাবে তার সমস্ত অধিকার নিয়ে আরেকজন পুরুষের মতোই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। নারীদের প্রতি এই মূল্যবোধটাই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও গড়ে উঠেনি। কখনও কখনও পুরুষ তার এই মনোভাবের কারণে নারীর প্রতি তার সহিংসতাকে অধিকার মনে করে। আর তাই নারীর প্রতি সহিংসতা পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ঘটেই চলছে।

যে চারটি ছেলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, ওদের তো এখন জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা, কিন্তু ওরা ধর্ষণ এবং হত্যার মতো এতো বড় অপরাধ এই বয়সে এতো প্ল্যানমাফিক করে কীভাবে ? এদের পরিবার পরিজন এদের কী পরিবেশ এবং শিক্ষা দিয়েছে যে এদেরকে এতো বড় অপরাধী করে তুলেছে? এই ছেলেগুলোই কি শুধু অপরাধী, সাথে এদের পরিবারও কি দায়ী না? শুধু প্রতিপত্তি আর প্রভাবশালী হলেই কি বাচ্চা মানুষ হয়ে যায় ? সবার ভাগ্য হয় না সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়ার।

রোকসানা আক্তার ঝর্ণা

কথা হলো বাচ্চা যে পরিবেশেই জন্ম নিক, ছোটবেলা থেকে তার সুষ্ঠু শারীরিক বিকাশের সাথে সাথে তার সুস্থ মানসিক বিকাশও সমানভাবে জরুরি। আমাদের সমাজের অধিকাংশ অভিভাবকরাই একটা শিশুর শারীরিক বিকাশের দিকে যেভাবে সচেতন থাকেন, সেইভাবে কিন্তু সেই শিশুটির মানসিক বিকাশের দিকে নজর দেন না। একটা শিশু শৈশবে পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেই শিখে। যদি পারিবারিক পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা অনুকূল না হয় তবে সেটা তার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় আনে এবং যার প্রতিক্রিয়া অনেক সময় মানুষ বড় হয়েও ভোগে। এই অপরাধীদের ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটেছে। মা-বাবা তাদের শারীরিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন, দামি স্কুলে পড়িয়েছেন, কিন্তু সুস্থ মানসিক বিকাশের দিকে নজর দেননি তাই ওরা এক একজন জঘন্য অপরাধী হয়ে উঠেছে।

ছোটবেলায় অনেক দর্শনমূলক প্রবচন শুনতাম। এই যেমন, যে রকম বীজ বপন করবে তেমনই ফল পাবে, আরেকটা ছিল গাছের ফলন ভালো পেতে চাইলে গাছ চারা থাকতেই পানি ঢালতে হয়, বড় হওয়া গাছে পানি ঢেলে লাভ নেই। কথাটা মূলত মুরুব্বিরা বলতেন যখন শিশুদের লালন পালনের বিষয় নিয়ে কথা উঠতো। কোন মানব শিশুই এই পৃথিবীতে অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। একজন শিশুকে পরিপূর্ণ একজন সুস্থ স্বাভাবিক এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের, তারপর রাষ্ট্রের। আমরা কি তবে সব জায়গাতেই ব্যর্থ হতে চলেছি? চলমান ঘটনাগুলো কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, একজন শিশুর আগমনে পিতামাতা হওয়া যেমন চরম আনন্দের, তেমনি সন্তানের সুষ্ঠু লালনপালনের ব্যর্থতার অধিকাংশ দায়ভারও পিতামাতার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.