অন্দরমহলে বাঙালি নারীর একক দায়িত্ব আর কতদিন?

বনানী রায়:

“কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ইশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। … এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাঁহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। … ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।”
– বেগম রোকেয়া, ১৯০৪

এই কথাগুলি ১১৭ বছর আগে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া লিখে গেছেন। সময় তো কম গড়িয়ে যায়নি। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে সবকিছু কত দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাঙালি নারীর ভাগ্য বদলাবে কবে? আর কত শত বছর লাগবে আমাদের চিন্তাধারা বদলাতে? কবে এই সমাজ রান্নাঘর আর সন্তান লালন পালনের একক দায়িত্ব থেকে নারীদের মুক্তি দেবে? কত যুগ পরে কেউ বলবে না বা ভাববে না যে, নারীর জায়গা অন্তঃপুরে। নারীরও মন আছে, সেখানে সেও তার মত করে মুক্তি খোঁজে, সেও বাঁচার মত করে বাঁচতে চায় এই খবর ক’জন রাখে, ক’জন বোঝে?

যেকোনো কাজ যখন মানুষ ভাললাগা নিয়ে নিজের ইচ্ছেতে করে তখন সেটিতে সে আনন্দ খুঁজে পায়। আর সেই কাজ যখন তার উপর জোর করে চাপানো হয় বা চাপটা তার উপরই এসে পড়ে তখন সেই কাজে কোন আনন্দ থাকে না। সে যে কাজই হোক না কেন। একসময় নারীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হত, আরো পরে তারা ঘরোয়া ভাবে পড়ার কিছুটা সুযোগ পেতো। তখন নারীরা সংসারের কাজকেই প্রধান কাজ হিসেবে নিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তাঁদের শিক্ষা সেই পর্যায়ের ছিল না যার মাধ্যমে সে ঘরের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারে বা অর্থোপার্জন করতে পারে।

কিন্তু এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত নারী। কেউ কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না, কেউ ঘর সামলে তবেই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে, কেউ হাজার কথায় জেরবার হয়েও কাজ আঁকড়ে ধরে আছে, কেউ অবস্থার চাপে পড়ে সব ছেড়ে ছুড়ে ঘরে বসে আছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি? কতদিন নারী তার সমস্ত শিক্ষা দীক্ষা, যাবতীয় গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে শুধু সংসার আর সন্তান উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে? নারীকে তার যোগ্য সম্মান পেতে আর কত গলা ফাটাতে হবে? কেন সেই আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায় না?

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বড্ড একপেশে। যুগ যুগ ধরে সেই ছোটবেলা থেকে ছেলে আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে লালন পালন বা পারিবারিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা পরবর্তী জীবনে সবাইকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। একজন ছেলে সন্তান ছোটবেলা থেকেই দেখছে বা শিখছে রান্না বান্না সহ ঘরের সব কাজ মেয়েরা করে। সে যতই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক তার সেই ছোটবেলার শিক্ষা সে মন থেকে তাড়াতে পারে না। তাকে ছোটবেলা থেকে ঘরের কোনো কাজ করতে বা শিখতে বলা হয়নি তাই সে সেগুলি পারেও না। তাই পরবর্তীতে সে ঘরের কাজের জন্য নারীকেই নির্বাচন করছে যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা পরম্পরায় বা নিজের আরাম আয়েশে থাকার বাসনা থেকে। কে আর নতুন করে ঘরের কাজ শিখে নারী সহায়তায় হাত বাড়িয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে যায়। কারণ সে না করলেও বুঝতে পারে, কাজগুলি নিতান্তই সহজ নয়। তাই অনেকে বুঝেও সবকিছু না দেখে বা এড়িয়ে গিয়ে সেই মান্ধাতার আমলের ধারণাকেই আগলে আছে। যে যত নারী স্বাধীনতার পক্ষে, নারীর ঘরের বাইরে কাজ করার পক্ষে বা নারীর অগ্রগতির পক্ষেই কথা বলুক বা কাজ করুক অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ঘরে গেলে একই দৃশ্য দেখা যাবে। সেই অন্দরমহল নারীর, এই ধারণা থেকে আমরা বোধহয় কোনোদিনও মুক্তি পাবো না। যত বছরই কেটে যাক, ঘরের কাজ আর বাইরের কাজ সবকিছুতে নারী পুরুষের সমান দায়িত্ব এ বোধহয় বাঙালি নারীদের আর কোনোদিন বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠবে না। এ তো গেল ঘরের মধ্যকার সমস্যা।

এমনকি ১১৭ বছর আগে যে কথাগুলি বেগম রোকেয়া লিখে গেছেন, আজ এই অতি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি যদি সেই একই কথাগুলি বলি সমাজের চারপাশ থেকে খাড়া উঠবে আমার দিকে। তাহলে এত বছরে আমাদের অর্জন কি? নারী শিক্ষিত হল, উপার্জনক্ষম হল তবু সাজানো বিধানগুলি কেন আজও নারীর বিপক্ষেই থাকবে? সমাজের সর্বস্তরে নারীর বিচরণ বাড়লো, নারী প্রত্যেক ক্ষেত্রে তার যোগ্যতার প্রমাণ দিল; তবু কেন খাড়াগুলি আজও সব পুরুষেরই হাতে থাকবে?

একসময় নারী শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ  বঞ্চিত ছিল।এরপর নারী শিক্ষিত হতে চাইলো, জ্ঞানের আলো জ্বালাতে চাইলো; সমাজের রক্তচক্ষু তাকে থামাতে এগিয়ে এলো। নারী সব বাধা পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চললো। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হলো নারী। ঈশ্বরকে সামনে রেখে পুরুষের কারসাজির বিধান হেরে গেল।

নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে হাজার বাধা পেরিয়ে যখন শিক্ষার আলো নিজের মধ্যে ধারণ করে আরো এক ধাপ এগিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইলো; তখন ঘরে ঘরে পুরুষ বাধা হয়ে দাঁড়ালো, যা করতে চাও ঘরে বসে কর, বাইরে নয়। সে বাধাও একদিন বানের জলে ভেসে গেল, অবশ্য অনেক নারীর ঘরও ভেসে গেল। তবু নারীকে আটকে রাখা গেল না, তারা বীরদর্পে এগিয়ে চললো। সমাজের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে তারা নিজেদের প্রমাণ করতে পারে নি; তবু আজও সব বিধান পুরুষেরই পক্ষে।

আজ নারীকে থামানোর সূক্ষ্ম কৌশল চলছে। ঘরে ঘরে তাদের শিক্ষার মধ্যে থেকে আলো কেড়ে অন্ধকারে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। বহু পুরনো সেই একই কায়দায় ধর্মের দোহাই দিয়ে, সে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন। ধর্মে তো নারীর সম্মান, মর্যাদা রক্ষার কত বিধান রয়েছে, সেগুলির চর্চা নেই কেন? নারীরাই বা কবে বিধি বিধানগুলি ভালভাবে নাড়াচাড়া করে বুঝবেন, সবই তাদের আটকানোর কৌশল।

যে যে ভাবে সাজলে নারীকে দেখতে সুন্দর লাগে, সেই সেই ভাবে সাজাই বিধানে মানা আছে। পুরুষের জন্যে কোন বিধান নেই কেন? পুরুষের সাজপোশাক কে ঠিক করে দেবে? অবশ্য বিধানে থাকলেও পুরুষ না মানলে তার কোন পাপের বোঝা বয়ে নিয়ে নরকে দাঁড়াতে হয় না বোধহয়। নরকের দরজা বুঝি মেয়েদেরই শুধু হাত ছানি দিয়ে ডাকে! বহু বছর আগে যখন এই সব ধর্মগ্রন্থগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে বা বিধান রচনা করা হয়েছে, তখন তো নারীর শিক্ষায় বাঁধা ছিল। তবে কি এসব পুরুষেরই কারসাজি?

বাঙালি নারী শিক্ষিত হোক, আত্মনির্ভরশীল হোক, বুদ্ধিমতী হোক আর যাই হোক; সংসারকে আগলে রাখা আজও তারা তাদের দায়িত্ব বলেই মানে। এই সমাজ ব্যবস্থায় ক’ জন পুরুষ নিজেদের কর্মক্ষেত্র সামলে অন্দরমহলে নারীকে সহযোগিতা করে? চারদিক সামলে তবেই নারীকে এগিয়ে যেতে হয়। তবু তাদের এগিয়ে যাওয়াতে বাধা দিতে এতো কৌশল কেন?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.