তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির অপেক্ষায় বাংলাদেশের হিজড়া সমাজ

bangla_hijraফারহানা পারভীন (বিবিসি): ঢাকার মধ্য বাড্ডায় কয়েক ঘরে বেশ কয়েকজন হিজড়া থাকেন। সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে ছোট ছোট এই বাড়িগুলোর এতটাই খারাপ অবস্থা, যে সেগুলোকে তারা বাসা না বলে ডেরা বলতেই অভ্যস্ত। এই পল্লীতে যারা থাকেন তারা জীবিকা নির্বাহ করেন মূলত যৌনকর্মী হিসেবে। আর মাঝে মাঝে নেচে-গেয়ে কোন নবজাত শিশুকে আশীর্বাদ করে কিছু অর্থ আয় করেন।

তেমনি একটা ডেরায় বসে আমার কথা হচ্ছিল কাজলের সাথে।

‘‘ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের কাপড় পরতে ভাল লাগতো, মেয়েদের সাথে মিশতে ভাল লাগত’’, বললেন কাজল।
এ জন্য তার ভাই, বাবা মায়ের কাছ থেকে তাকে অনেক মারধর খেতে হয়েছে। তার বয়স যখন সাত বা আট বছর, তখন থেকেই তার হাঁটা-চলা মেয়েদের মত হতে থাকে।

যত বয়স বাড়তে থাকে সে উপলব্ধি করে সে অন্যদের থেকে আলাদা।

তখন সে বিষণ্ণতায় ভুগতো আর ভাবতো তার মত কি আর কেউ নেই?

কাজল বলছিলেন এর এক পর্যায়ে তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার পর পরিবার ছেড়ে যোগ দেন অন্যান্য হিজড়াদের সাথে।

সামাজিক বিড়ম্বনা

বাংলাদেশে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১৫ হাজার হিজড়া রয়েছে। এদের সামাজিক ভাবে গ্রহণ না করার কারণেই চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ নানা স্থানে বিভিন্ন ভাবে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় তাদের ।

হিজড়াদের নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে, তারা দীর্ঘদিন ধরেই এদেরকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে, যাতে তাদের অন্যান্য অধিকারগুলো রক্ষা হয়।

বাংলাদেশে সমাজ হিজড়াদের নিচু চোখে দেখে, এমনকি নিজ পরিবারের কাছেও তারা নিগৃহীত হয়। ফলে, কিশোর বয়সেই তাদের পড়ালেখা থেমে যায়।

পরিবারের সদস্যদের কাছে সমর্থন না পেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে হয়, আশ্রয় নিতে হয় অন্যান্য হিজড়াদের মাঝে।

প্রত্যেক হিজড়ার একজন করে গুরু মা থাকেন। তিনিই তাদের আশ্রয় দেন।

মধ্য বাড্ডার হিজড়া পল্লীর আরেক বাসিন্দা লিজা। তিনি বলছিলেন স্কুলে সহপাঠী ও শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণেই বন্ধ হয়ে যায় তার পড়াশোনা।
তারপর তিনি আর স্কুলে যাননি । এভাবেই তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে।

মানসিক কারণ

জন্ম নেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে পুরুষ বা নারীতে পরিণত হতে যেসব হরমোন স্বাভাবিক মাত্রায় থাকা প্রয়োজন, সেসব হরমোনের তারতম্যের কারণেই এই নারী-পুরুষের বাইরে আরেকটি লিঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে বলে প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হয়।

কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সাথে আরো বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির বিভাগের শিক্ষক এবং হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছেন ড. শাহানুর হোসেন।

তিনি বলছেন, একটি শিশুর হিজড়া হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য হরমোনের তারতম্যের সাথে মানসিক কারণও থাকতে পারে।

‘‘শিশু বয়সে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া বা কোন ট্রমা থেকেও তারা নিজেকে অপর লিঙ্গের মত ভাবতে থাকেন,’’ ড. হোসেন বলেন।

বাংলাদেশে এই হিজড়া জনগোষ্ঠী স্কুল থেকে ঝরে এবং পরিবার থেকে বের হয়ে গিয়ে, এক অর্থে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

সমাজের প্রত্যেক স্তরে, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের মত জায়গাতে তারা চরমভাবে অবহেলা আর বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশে প্রথমবার এ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু সংস্থা। সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সুবিধাগুলো পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তারা কাজ শুরু করে।
তেমনি একটি সংস্থা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ।

‘বাংলাদেশে নয় কেন?’

সংস্থাটির প্রধান সালেহ আহমেদ বলছেন, তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, তবে হিজড়াদেরকে মূল শ্রোতধারায় ফিরিয়ে আনাটা সময়সাপেক্ষ।

‘‘উপমহাদেশে হিজড়া প্রথার চল সেই মুঘল আমল থেকে। যৌন পেশা, বাঁধাই , ছল্লা এসব তাদের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে,’’ মি: আহমেদ বলেন।

হিজড়াদের সাথে কাজ করতে গিয়ে মূলত দু’ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয় এই সংগঠনটির।

‘‘একদল আছেন যারা এসব কাজ থেকে সরে আসতে চান। আরেক দল আছেন তারা চাননা। তাই আমি মনে করি সময় লাগবে,’’ তিনি বলেন।
তবে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হলে সেটা দ্রুত সম্ভব বলে সালেহ আহমেদ মনে করেন।

হিজড়াদের নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা মনে করছেন নারী-পুরুষের বাইরে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের জায়গাতে তারা কিছুটা সুযোগ পাবেন।

সালেহ আহমেদ বলছেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের মত মুসলিম দেশে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাহলে বাংলাদেশে নয় কেন?
‘‘বাংলাদেশে সরকারি ভাবে হিজড়াদের কোন পরিসংখ্যান নেই। আদমশুমারিতে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন না থাকায় হিজড়াদের গণনা করা হয়নি,’’ মি: আহমেদ বলেন।

‘‘সমাজে তাদের অস্তিত্ব থাকলেও খাতা কলমে তাদের কোথাও অস্তিত্ব নেই,’’ তিনি বলেন।

‘আমি তো মানুষ’

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে তাদের কাছে ১৫ হাজার হিজড়ার তালিকা আছে। তবে আসল সংখ্যা আরও বেশি হবে, কারণ অনেক হিজড়া তাদের পরিচয় গোপন করায় গণনা করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে তারা ২০০৮ সালে প্রথমবারের মত ভোটাধিকার পায়।

তবে ভোটার আইডি কার্ডে জেন্ডার নির্ধারণ না থাকায় সেখানেও বিভিন্ন বিড়ম্বনা।

সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে হিজড়ারাই প্রশ্ন তুলেছেন।

বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাজমা বেগম বলছেন, তারা ২০১২ সালে প্রথম বারের মত হিজরা শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ-এর ওপর পাইলট প্রকল্প শুরু করেন।

তবে এর গুণগত মানের দুর্বলতার কথা তিনি স্বীকার করেন । আর তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কাজ চলছে বলেও তিনি জানান।

তবে সেটা কত দিন নাগাদ সম্ভব হবে সে ব্যাপারে তিনি সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি।

মধ্য বাড্ডার সেই হিজড়া পল্লীতে ফিরে আসলে কাজল বলছিলেন তার আক্ষেপের কথা।

সমাজের সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও তার মূল কষ্টের জায়গা তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি।

তিনি বলছেন, একটা মেয়ে যেভাবে চলাফেরা করে তিনি তেমন স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করেন, কিন্তু রাস্তায় বের হলে মানুষ বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করে।

‘‘আজ হিজড়া হওয়ার কারণে গাড়িতে মানুষ আমার পাশে বসে না, আমি বসলে তারা উঠে চলে যায়। আমি একটা ভাল বাসা ভাড়া নিতে পারি না, আমি তো মানুষ,’’ তিনি বলেন।

‘‘আমার ইচ্ছা করে আমার বাবা, মা, আমার পরিবারের সাথে থাকতে। আমার বাবা মা আমাকে রাখতে চায় কিন্তু সমাজের মানুষের কথার ভয়ে তারা আমাকে তাদের কাছে রাখে না। আমার মনে খুব কষ্ট’’ কাজল বলেন।

হিজড়াদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব বেসরকারি ও সম্প্রতি সরকারিভাবে যে গবেষণা গুলো করা হচ্ছে, সেখানেও এই বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সেখানে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতির ফলে হয়ত তারা সামাজিক সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে তাদেরকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার সময়টা আরো দীর্ঘায়িত হবে।

(বিবিসি বাংলা থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.