বীথি সপ্তর্ষিকে যে পারতেই হবে

সুপ্রীতি ধর:

সেদিন আমারই এক প্রিয় বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। দেশের বাইরে থাকে বহু বছর। ওর লেখালেখি, ওর আরও নানান কর্মকাণ্ডে আমরা কাছের মানুষেরা যারপরনাই মুগ্ধ ওর প্রতি। বিশেষ করে ওর মানবিক বোধ, সেই বোধের চর্চা, মানুষকে ভালবাসার অপূর্ব ক্ষমতা আমাদের অনেককেই ওর সাথে ধরে রাখে। আমরা কখনও, শত বিপর্যয়েও হাতটা ছাড়ি না।
যখনই দেখি সে কোন একটা কাজকে ঈশ্বর জ্ঞান করে রাতদিন লেগে আছে, তখনই বুঝি ওর ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে বলেই এসব করছে। তবে ঘূণাক্ষরেও ধারণা করতে পারিনি যে তার ক্ষরণ কোন পর্যায়ে গেছে! যেদিন জানলাম, এরপর টানা তিনদিন আমি সবকিছু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম।
অনেকদিন ধরেই একটা ভয়াবহ এবিউজিভ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সেটা ভয়াবহতর আকার নিয়েছে। দুটো সন্তান, তারাও এখন প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার প্রক্রিয়ায়, তার মানে মায়ের হাতটা ছাড়লো বলে!
কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, জানো সু, ঠিকই একই ঘটনা অন্যের বেলায় ঘটেছে শুনলে আমি নিশ্চিত বলতাম, ‘বেরিয়ে আসো, থেকো না। আত্মসম্মানবোধ নেই? কিন্তু নিজের বেলায় কেন আমার সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে? কেন আমি পারছি না?’

ওর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নানানরকম হতে পারে। জীবনটাকে দেখার গভীরতা থেকেই উত্তরগুলোও ভিন্ন হবে। যে মানুষটা জীবনভর এক্সিলেন্ট রেজাল্ট করে এসেছে, এখনও প্রচণ্ড সম্মানের সাথে চাকরি করছে, কোথাও কোন কমতি নেই, সেই কিনা পার্টনারের সমস্ত অন্যায়, অপবাদ মাথায় নিয়েও তার জন্য প্রিয় খাবার রান্না করে। আর সেই ব্যক্তিও সেই খাবার খেয়ে এসেই স্ত্রীর নামে ডিভোর্সের মামলা ফাইল করে। হায় জীবন! বন্ধুটাকে বুঝতে চেষ্টা করি নানান প্রশ্ন করে। খুব যে বুঝতে পারি তা নয়। শুধু বুঝি যে, আসলে সবার কষ্ট, সবার জীবনবোধ একরকম না। অনেককিছু পারার পরও এই আমরাই আবার অনেককিছু পারিও না। বন্ধুটিও সেই পারা আর না পারার মধ্যে আটকে গেছে। এখন সবশেষ পেরেকটি ঠোকার পর জানতে পারলো, এতোদিনের সব বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে সেই লোক। যৌথ ব্যাংক হিসাবের বড় একটা অংকের কোন হদিসও মিলছে না। যে বন্ধুটি কোনদিন বৈষয়িক কোনকিছুতেই নিজেকে আটকাতে চায়নি, সে আজ চেক বই, ব্যাংক একাউন্ট মেলাতে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছে।

ওপরের গল্পটা আজকেই করছি একটা কারণে। আজই আমার প্রিয় এক নারীবাদী বন্ধু, বীথি সপ্তর্ষি তার পার্টনার তুষার সারোয়ারের মাধ্যমে মানসিক, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার কাহিনী প্রকাশ করেছে। ওটা পড়ার পর থেকে সারাটা দিন সময় নিয়েছি বিষয়টি ধাতস্থ হতে। অনেকেই প্রশ্ন করছে, এতোদিন কেন সইলে, আরও আগে উচিত ছিল বেরিয়ে আসার, আমার মনে হয়, এসব ফালতু কথা। কে কখন বেরুতে পারবে, এটা একান্তই তার বিষয়। কেন আগে পারেনি, সেটাও তার বিষয়। আমরা কেউই তার জীবনটা যাপন করি না বলেই আমাদের পক্ষে এরকম জাজমেন্ট দেয়া উচিত হবে না। আমি যেমন কিছুটা জানতাম এ বিষয়ে, কিন্তু ওকে কোনদিন এ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করিনি। তবে তাকে অন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম, যাতে সে আরও দূর পর্যন্ত পড়াশোনার চেষ্টাটা চালিয়ে যায়।

শুধু বলবো, দেরি হোক, বা না হোক, ও যে শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তাতেই বরং আমাদের এখন তার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এটা তাকে ব্লেইম করার সময় না। তবে তার সেই পোস্টের নিচে একদল হামলে পড়েছে সব বামপন্থীদের গুষ্ঠী উদ্ধারে, এমনকি নারীবাদ ও নারীবাদীদের গুষ্ঠী উদ্ধারে। গত কয়েক বছর ধরে আমরা যারা এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই, আমরা জানি এসব অনলাইনজীবীদের রোষানলের কারণ কেন আমরা? তাই এ নিয়ে বিচলিত হই না খুব একটা।

তারপরও বলবো, নারীবাদ একটা মতবাদ। যে মতবাদকে একটু একটু করে চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়। তাত্ত্বিকদের লেখা বই পড়ে শিখে নিজের কাজে প্রতিফলন ঘটানো দুরূহ কাজ। সবাই পারে না। এটা আসলে জন্মগত চর্চা হতে হয় পরিবারের ভিতর থেকে। একেবারে নিজের পরিসরে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে এর চর্চাটা আগে আয়ত্ত করতে হয়, তারপর বৃহত্তর পরিসরে কাজে নামতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দুপাতা কঠিন কঠিন কিছু থিউরি আওড়েই লোকজন নিজেদের জ্ঞানী ভাবতে শুরু করে, সমস্যা এখানেই। আর এই যে কথায় কথায় তারা কঠিন শব্দে চর্চিত জ্ঞানের প্রকাশ ঘটান, মেয়েরা তখন অভিভূত হয়, এই মোহ কাটতে সময় লাগে। অনেকের বছর বছর পেরিয়ে যায়। এরই মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে যায় জীবনগুলো।

সুতরাং বীথির এই ঘটনায় নারীবাদ বা নারীবাদীদের যারা একহাত নিচ্ছেন, তাদের বলি, এই তত্ত্বের যারা চর্চা করেন, তারা সবাই রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন আছে, সুখ-দু:খ আছে। তারা কেউ আকাশ থেকে টুপ করে পড়েই নারীবাদী হয়ে উঠে না। প্রতিদিন হাজারও কষ্ট গিলে খেয়ে কত নারীকে অন্য নারীর হাতটা শক্ত করে ধরতে হয়, জানেন আপনারা? সমাজের বাইরের জীব নন তারা। আর যাদের সাথে তাদের পার্টনারশিপ গড়ে উঠে, তারাও একটা খোলস পরে থাকেন আদর্শের। মূলত জন্মগতভাবে পুরুষতন্ত্রের সবরকম নিয়মাবলীর মধ্যে বেড়ে উঠা একজন পুরুষ (নারীও হয়) পক্ষে সেই শেকল ছিন্ন করা রীতিমতোন দু:সাধ্য। অশান্তিগুলোর সূত্রপাতও সেখানেই। কারণ পরিবারের নারীকে কী সম্মান দেখানো হয়, এটা তো শিশুবয়স থেকে শেখে একটা ছেলেশিশু।

সবশেষ বলবো, বীথিকে অনেকদিন ধরে চিনি। উইমেন চ্যাপ্টারে লেখার মধ্য দিয়েই তার সাথে আমার পরিচয়। বয়সে ছোট বলে আদরের সম্পর্ক। আমি চাইবো, ও এই সময়টা দ্রুতই পেরিয়ে আসতে পারবে। সময়টা ফ্যাক্টর না, বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা নিতে পারাই মূল ফ্যাক্টর। ও সেটা নিয়েছে। সময়টাও চলে যাবে।

বীথি সাহসী মেয়ে। কত মেয়ের কাছে সে অনুপ্রেরণা। সাহসের প্রতীক। সে ভেঙে পড়বে না, বরং ঘুরে দাঁড়াবে, দেখিয়ে দেবে সবাইকে, ‘আমি পেরেছি’। এই যে আমরা অনেকেই পেরেছি, বীথিও সেইখানে আরেক আইকন যোগ হবে, এই স্বপ্ন দেখি আমি।

আরও একটা আশা করি, যে রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য তুষার সারোয়ার, সেই রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম একজন কর্ণধার হাসনাত কাইযূম ভাইকে বিষয়টি বলার পরও তিনি তা নিয়ে কোনরকম আগ্রহ দেখাননি। বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে চেপে গিয়েছেন কিনা জানি না, আরও জানি না তাদের রাষ্ট্রচিন্তায় নারী আসলেই কোন রোল প্লে করে কিনা! যদি না করে, তবে সংগঠনটির এখানে ইতি টানতে হবে। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টিতেও এরকম নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, এবং যথারীতি সবাই তা ধামাচাপা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। এসব বামপন্থী নেতা ভাইদের বলছি, আপনারা কি মনে করেন যে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আনার পর আপনারা নারী ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন? তার আগে নয়? তার মানে নারী ইস্যু আপনাদের কাছে খুবই নগণ্য কোন ইস্যু? প্রশ্নগুলো উত্তর দিলে খুশি হবো।

সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.