বিবাহ-বিচ্ছেদে কি নারীর কোনো দায় নেই?

ঝুমকি বসু:

সমীকরণ ১ – তিতলি + জামিল = সুখের সংসার। রূপা + সাগর = সুখের সংসার। মিলি + কাজল = সুখের সংসার।

সমীকরণ ২ – তিতলির সঙ্গে জামিলের বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর। তিতলি তার বিয়ের আগের প্রেমিক হাসানকে এখনও ভুলতে পারেনি। জামিল মনেপ্রাণে ভালোবাসে তিতলিকে। প্রতিটি বিশ্বাসী স্বামীর মতো অফিসে গিয়ে একমনে কাজ করে, মাঝে মাঝে স্ত্রীকে ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়। স্বামীর অবর্তমানে হাসানের সঙ্গে চলে তিতলির অভিসার। কখনও তা নীল সাদা জগতের দেয়াল ভেদ করে বেডরুমেও পৌঁছে যায়। জামিল এগুলোর কিছুই জানতে পারে না। অফিস থেকে ফেরার পথে বউয়ের পছন্দের ডেইরি মিল্ক পকেটে নিয়ে ঘরে ফেরে, তিতলিকে বুকে নিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমায়।

এই তিতলিকে আবার ভালোবাসে সাগর, তিতলি সেটাও জানে। সাগরের প্রেমে সাড়া না দিলেও তাকে সে একেবারে নিরাশ করে না। তার সাথেও চলে নীল সাদা জগতের রোমান্টিক কথা চালাচালি, কখনওবা ফোনে ভাব বিনিময়। সাগর কিছুটা জানে যে তিতলি তাকে ভালোবাসে না, বাসে হাসানকে, তবু সে তিতলির মোহ ছাড়তে পারে না। এদিকে সাগরের স্ত্রী রূপা সন্ধ্যায় সেজে-গুজে স্বামীর প্রিয় খাবারগুলো রান্না করে কলিংবেলের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। অফিস শেষে সাগর বাসায় ফেরে। চলে টুকটাক গল্প। রূপা তার স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বামীর চোখে তখন তিতলির ছায়া।

ঘটনাক্রমে একদিন কাজলের সঙ্গে রূপায় পরিচয় হয়। কথায় কথায় কাজল রূপার প্রেমে পড়ে যায়। কাজলের বউ মিলিও অনেকটা রূপার মতো, স্বামী অন্তপ্রাণ। রূপা কাজলের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে। সে কাজলের ভালোবাসা বুঝলেও তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় তার সব ভালোবাসা শুধুই তার স্বামীর জন্য। তবু তার অলস সময়ে সে কাজলের সঙ্গে নীল সাদা জগতে গল্প করে সময় কাটায়। মাঝে মাঝে ভাবে তার স্বামী সাগর একবারও অফিস থেকে ওর খোঁজ নেয় না, অসুস্থ হলে অস্থিরতা দেখায় না, অথচ রূপার জন্য কাজল সেগুলো করে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।

দেখলেন তো, সমীকরণ এক কত সহজ-সরলভাবে মিলিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু সেই একই চরিত্রগুলো সমীকরণ দুইকে কত জটিল করে তুলেছে এবং এই অংক আর সহজে মেলানোও যাচ্ছে না। একমাত্র একজন নারী এই সমীকরণকে বেশি জটিল করে তুলেছে, আর সে তিতলি। সে একইসাথে তিনজন পুরুষকে নিয়ে সমানতালে খেলছে। সুখের সংসারগুলোতে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। কেউ আর পুরোপুরি সুখী হতে পারছে না।

সেদিন প্রথম আলোর একটা প্রতিবেদন দেখে এই সমীকরণটা মাথায় এলো। ঢাকায় তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে গেছে। এ বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্‍্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। দৈনিক ৩৯ টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক হয়েছে।

এই এতোগুলো তালাকের জন্য কি শুধু পুরুষেরাই দায়ী? নারীর কোনো দোষ নেই?

একটু ভেবে দেখবেন তো, এই যে আমাদের সমাজের এখন যে অস্থিরতা, দাম্পত্য ভাঙ্গা তার জন্য কি নারী একদমই দায় এড়িয়ে যেতে পারে? পুরুষ তো অবশ্যই দায়ী, তবু একজন নারী হয়েও আমি এ দায় অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের জীবনটাকে এখন আমরা স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার সিরিয়াল বানিয়ে ফেলেছি। দাম্পত্যে সামান্য অশান্তিতেই অস্থির হয়ে উঠছি, শান্তি খুঁজছি অন্য কারও কাছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে সংসার।

আমি বলছি না আপনার স্বামীর অত্যাচার, শারীরিক বা মানসিক আঘাত আপনি সহ্য করেন, কিন্তু আপনার নিজের মনকেও স্থির রাখেন। শুধু সুখের খোঁজে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবেন না। আমি চোখের জল আটকাতে পারি না যখন দেখি অবুঝ সন্তান মায়ের অভিসার দেখে ফেলায় মায়ের সহায়তায় প্রেমিকের দ্বারা সেই সন্তানকে খুন হতে হয়। এরাও একজন নারী। যার কাছে সন্তানের চেয়ে অভিসার বড় হয়ে যায়, নিজের নাড়িছেঁড়া ধনের চেয়ে প্রেমিক বড় হয়ে যায়।
বলবেন, এই প্রেমিকটাও তো খারাপ পুরুষ। খারাপ তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এই নারী যদি তাকে না উস্কাতো তাহলে কি আগুনটা এতোদূর পোড়াতে পারতো? পুরুষ চিরকাল বোহেমিয়ান, কিন্তু তাকে উস্কায় নারী আবার নারীই পারে তাকে বেঁধে রাখতে। পুরুষের যে পলিগামি স্বভাব তা কোনো নারী ছাড়া কখনোই বিকশিত হতে পারে না। এমনকি সংসারে যে নারী নির্যাতিত হয়, চোখ মেলে চেয়ে দেখুন তার অন্তরালেও জড়িয়ে আছে একজন নারী। ছেলে অফিস থেকে ফেরার পর পানের বাটা সাজিয়ে বউয়ের নিন্দা নিয়ে বসেন শাশুড়ি মা, চোখ ছলছল করে বোন বলে ভাবির নিন্দা, পাশের ফ্লাটের খালাম্মা এসে বলেন, তোমার বউ তো দেখি কাজ-টাজ পারে না, দেখতেও তো তেমন ভালো না, এই মেয়ে বিয়ে করলে কী দেখে কে জানে! বান্ধবী একদিন শুনিয়ে দেবে, তোর বউটা একদম আনস্মার্ট। পুরুষ ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে, পুড়তে থাকে, তারপর একদিন শেষ বিস্ফোরণ – ডিভোর্স।

প্রায় প্রতিটি সংসার ভাঙ্গায় তাই পুরুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী। এ দায় আমরা অস্বীকার করবো কীভাবে? সমাজ বদলাতে হলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে। মানবিক অবক্ষয়ের এই দুর্দিনে প্রতিটি নারী চলুন পৃথিবীকে সুন্দর করার অঙ্গীকার নিয়ে এগোই। শপথ করি, নারী হয়ে ভাঙবো না কোনো নারীর মন, কোনো সুখের সংসারে হবো না কালো ছায়া। আমরা গড়তে জানি, সবসময় জেগে থাকুক আমাদের সেই সত্ত্বা। আমাদের ছোঁয়ায় পৃথিবী হয়ে উঠুক সুন্দর, আমরা হয়ে উঠি মানবিক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.