আলী আদনান:
এক.
মানুষের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। যুগে যুগে কালে কালে মানুষ যা অর্জন করেছে তা সংগ্রাম করেই অর্জন করেছে। বিনা রক্তপাতে যেমন স্বাধীনতা আসেনা, বিনা শ্রমে যেমন সফলতা পাওয়া যায় না, তেমনি বিনা সংগ্রামে কখনো মুক্তি মেলেনা। ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’ শুনতে অনেকটা এক শোনালেও এদের পার্থক্য অনেক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা পা দিচ্ছি নতুন বছরে, নতুন দশকে। এই বছরটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে একটি হলো আমরা জাতিগতভাবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পা দিচ্ছি। দ্বিতীয়টি হলো আধুনিক বিশ্ব মহামারী করোনা’র ভেতর দিয়েই আমরা বছরটিকে স্বাগতম জানাচ্ছি।
বছর আসে বছর যায়। মানুষ দিনের শুরুতে স্বপ্ন দেখে। দিন শেষে সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘুমাতে যায়। আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা ধরেই নিয়েছি এটাই স্বাভাবিক। স্বপ্নভঙ্গ হতেই পারে। স্বপ্নভঙ্গের দায়ভার নিয়ে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। অধিকার হরণের জন্য কারও বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই না।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে বাস্তবিক অর্থে আমাদের কোন অর্জন নেই৷ কাগজপত্রে যেসব অর্জন তা ভোগ করছে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণী। আইনকানুন কাগজপত্রে থাকলেও তার সুফল পাচ্ছে শুধুমাত্র একটি বিশেষ গোষ্ঠী। সমাজে সকল নাগরিকদের জন্য আমরা সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, হঠকারিতা, ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্রতা, আমাদের পুরো কাঠামোটা জর্জরিত করে রেখেছে।
একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নির্ধারনের জন্য জনগণ নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের উপর। আমাদের দেশে ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটাই একটা গালি। ‘পলিটিশিয়ান’ শব্দটা নিয়ে যতো ট্রল হয় চোর ডাকাত নিয়েও অত ট্রল এখানে হয়না। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা।
আপনি ( হ্যাঁ, আপনাকে বলছি যিনি এ লেখাটি পড়ছেন) ভেবে দেখুন তো। কয়েক মিনিট নিরিবিলি ভাবুন। আশেপাশে এমন কেউ কি আপনার আছে যাকে আপনি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন? হোক সেটা পরিবারে, আত্মীয়তায়, প্রতিবেশীদের মধ্যে, সমাজে বা রাষ্ট্রে? নেই। প্রত্যেকেই আপনাকে ঠকাতে ব্যস্ত। আমাদের প্রত্যেকের হাতেই এক একটা ফাঁদ আছে। যে ফাঁদ দিয়ে আমরা অন্যকে কুপোকাত করার চেষ্টায় লিপ্ত।
আপনি রাস্তা পার হচ্ছেন। গাড়ী চাপা পড়লেন। অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ থাকলে হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই আপনার সাথে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা সব খোয়া যাবে। আপনি যদি নারী হোন তাহলে অন্যরকম বিপদও ঘিরে ধরার সম্ভাবনা থাকে। এখানে বাড়িতে আগুন লাগলে আগে মানুষ আগুন নেভাতে আসতো। এখন আসে সুযোগ বুঝে লুট করার চিন্তায়।
হাসপাতালে নবজাতক যেমন চুরি হয় তেমনি কবরের লাশও আজকাল চুরি হয়। আমাদের জীবন শুরু হয় অনিশ্চয়তায়, শেষ হয় অনিশ্চয়তায়। মানুষ ঘর থেকে বের হয়। সে বা তার পরিবারের সদস্যরা জানে না আবার ঘরে ফিরে আসা হবে কিনা। ঘরও খুব নিশ্চিত জায়গা তা দাবি করার সুযোগও আমাদের নেই। সারাক্ষনই একটা উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে কাটে!
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমাদের মুক্তি মেলেনি। একটা নিরাপদ, মানসম্মত, নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা এখানে হয়নি। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন আদর্শিক প্রজন্ম এখানে গড়ে উঠেনি। রাষ্ট্রের প্রতিটা কাঠামো খসে পড়া দেওয়ালের বিদঘুটে চেহারার মত করে অট্রহাসি দেয়।
ট্রেনের টিকেট না করে চুপিসারে কেটে পড়া লোকটা এখানে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে। রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে প্রকৌশলী এখানে তৃপ্তি পায়। জানালা দিয়ে ময়লা ছুঁড়ে ফেলা এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। ইভটিজিং করা এখানে স্মার্টনেস। এখানে মানুষ জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে কারণ এতে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। এবং দিনশেষে সবাই একসাথে আওয়াজ দেয় “নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে অনৈসলামিক কিছু চলবে না!”
এরপরও আমরা ভাল থাকি। অনিয়মকে আমরা নিয়ম করেছি। অনিশ্চিয়তার দায় চাপিয়ে দিচ্ছি নিয়তির উপর। ধৈর্যকে সঙ্গী করে এখানকার মানুষ দিন কাটায়, মাস কাটায়, বছর কাটায়। কাটানো ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। ফলাফল শূন্য।
দুই.
অসহায় মানুষ নিয়তি নির্ভর। মানুষ যখন নিজের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হয়, প্রতিনিয়ত শিকার হয় ঠকবাজির ও প্রতারনার, যাওয়ার কোন জায়গা থাকেনা, রুখে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হারায় – তখন সে মেনে নেয় ভাগ্যকে। মন থেকে বিশ্বাস করে এটাই নিয়তি। নিয়তি খণ্ডানোর সাধ্য কারও নেই। ধর্মগ্রন্থগুলো নিয়তিকে মেনে নিতে জোর দিয়েছে। মানুষ আরও জোরে নিয়তিকে ধর্ম ভেবে আঁকড়ে ধরে৷ বাড়তে থাকে অন্যায়, শোষন।
মানুষ যখন অন্যায়ের কাছে হেরে যায়, তখন তার একমাত্র অবলম্বন ‘ধৈর্য্য’। মানুষকে বুঝানো হয় ধৈর্য্য ধর৷ ধৈর্যধারনকারীদের জন্য পরকালে নানা উপহার আছে৷ মানুষ ধৈর্য্যকে ধর্মের উপাদান হিসেবে আঁকড়ে ধরে পরকালের অপেক্ষা করে। যেখানে আছে অনাবিল সুখ ও শান্তি। মোমিন বান্দা যখন পরকালের উপহারের লোভে ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে গিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে, তখন পর্দার অন্তরালে অট্টহাসি হাসে লুটেরা ও দুর্বৃত্তরা।
এদেশে নানা কায়দায় মানুষ ঠকানো হয়। সেই কায়দাগুলোর অন্যতম একটি হলো ‘ধর্ম’। কথায় কথায় আওয়াজ তোলা হয়, “৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে” এটা চলবে না, ওটা চলবে না। একটা শ্রেণীর কাছে এটা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সবাই নব্বই ভাগ মুসলমানের দোহাই দেয়। আমিও তো নব্বইভাগ মুসলমানের ভেতর পড়ি। কই, আমি তো তাদের দাবির সাথে একমত নই। আমার মতো আরো অনেকেই তাদের সাথে একমত নয়। তাহলে যারা ‘৯০ ভাগ’ এর আওয়াজ তোলে তাদের দাবিটাই ভুল বা বানোয়াট। আমার বা আমাদের মাথা বিক্রী করেই ফায়দা লোটা হয়। আমি জেনেও জানিনা, বুঝেও বুঝিনা।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মকে ব্র্যান্ডিং করেছে। যে যতো বেশি ব্র্যান্ডিং করে সে ততো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। যে যতো বেশি স্ট্যান্টবাজ, সে এদেশে ততো বেশি মহৎ। অনেকে এখানে রাজনীতি ও ধর্মের সংঘাত দেখতে পায়। আমি সংঘাত দেখি না। আমি দেখি রাজনীতিবিদরা এখানে কুমির খামারের মালিক। ধর্মীয় পুরোহিতরা কুমির। আর আমজনতা সেই কুমিরের খাবার। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ইস্যুতে আমাদেরকে কুমিরের মুখে ছুঁড়ে ফেলা হয়।
আমি কতোটা ভাল সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমার দাবি কতোটা যৌক্তিক তাতেও কারো কিছু যায় আসে না। আমার বাড়া ভাতে কে ছাই দিচ্ছে, আমার হাঁটার রাস্তায় কে বিছিয়ে দিচ্ছে কাঁটা তাতেই বা কার কী আসে যায়। রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, সভ্যতা- আমি কারো কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নই। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। আমি তখনই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠি যখন আমার আওয়াজ তাদের ঠুনকো দেওয়ালে আঘাত হানে। আমার অধিকারের জন্য নয়, তাদের স্বার্থের দেওয়াল নিরাপদ রাখার জন্যই তারা আইনের দোহায় দেয়, ধর্মের দোহাই দেয়, সমাজে শৃংখলার কথা বলে। তাদের দানবীয় থাবার নিচে পিষ্ঠ হয় আমার মাথা।
তিন.
আমরা পুরানো পথে হাঁটতে অভ্যস্ত জাতি। নতুন পথ আমরা খুঁজিনা। নতুন মত নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না। নানা ধরনের ভয়ে আমরা চুপ করে থাকি। পাপ পূণ্যের ভয়, আইনের ভয়। নানা ধরনের লোভ আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখে। কতৃপক্ষকে খুশী রেখে একটু অনুগ্রহ পাওয়ার লোভ, পরকালে স্বর্গ পাওয়ার লোভ, আরো নানা লোভ! কিন্তু ইচ্ছে করলেই, একটু ঝুঁকি নিলেই রচিত হতে পারে নতুন মত নতুন পথ।
গতকাল যে ওষুধের মেয়াদ ছিল আজ সে ওষুধের মেয়াদ নাও থাকতে পারে। গতকাল যে মন্ত্রে কাজ হয়েছে আজও সেই মন্ত্রকে শিরোধার্য করা কতোটা যৌক্তিক। আজকের সিদ্ধান্ত আজকের বাস্তবতা বিবেচনা করেই নিতে হবে।
একবার যিনি ব্র্যান্ড হয়ে যান তাকে আজীবন ব্র্যান্ড রাখতে গেলে সমস্যা তো দেখা দিবেই।
পুরনো পথে না হেঁটে আজকের দিনে আমাদের করণীয় কী তা নিয়ে মাথা ঘামানোর বিকল্প নেই। মাথাটা খাটানোর জন্য। শুধু ঘুমানোর জন্য নয়।
রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য রাষ্ট্র। আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই আইন। কিন্তু আমরা যখন রাষ্ট্রের জন্য, রাজনীতির জন্য বলি হই তখন বুঝা উচিত অতীতে আমরা যে পথে হেঁটেছি তা ভুল ছিল। ধার্মিকরা শান্তিপ্রিয় হয় কী হয় না সে তর্কের মেয়াদ ফুরিয়েছে অনেক আগে। কাগুজে কথায় সময় পার করা যায়, কিন্তু জীবন উপভোগ্য হয় না। একটাই তো জীবন৷ আর কতো আমরা ধৈর্য্য ধরে পুরনো মতে চলব পুরনো পথে হাঁটব তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
যুগে যুগে কালে কালে অনেকে অনেক পথ দেখিয়েছেন। অনেকে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলে গেছেন৷ কিন্তু অব্যবহৃত জ্ঞান আমাদের আর দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজন মুক্তি। আমরা এখন মুক্তি চাই। এজন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধতা। প্রয়োজন সম্মিলিত শক্তি। অসংখ্য ভণ্ডের ভীড়ে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার যেখান থেকে নতুন করে মানুষকে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব। সেই নতুন দিনের প্রত্যাশায় এগিয়ে আসতে হবে তারুণ্যকে।
(লেখক: আলী আদনান, লেখক, সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।
ই-মেইল: positivebangladeshadnan@gmail.com)