বাঙালী নারীর মন…

মৃন্ময় আহসান:

“কখনো দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ;
পরক্ষণেই ধূসর মেঘেদের অরণ্যানী, কুয়াশার মতই বিমূর্ত!”

কাব্যের ক্যানভাস থেকে মস্তিষ্কের অন্দরমহল, ‘নারীর মন’ সর্বত্র যেন এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ হয়েই রয়ে গেল নিরন্তর! এজন্যই হয়তো মনোবিদ ফ্রয়েডের সরল স্বীকারোক্তি, ‘নারীর হৃদয় নিয়ে ৩০ বছর গবেষণা করেও আমি সেই মহান প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাইনি। যেই প্রশ্নের উত্তর কেউ কোনদিন দিতে পারেনি – একজন নারী আসলে কী চায়?’

কী চায় একজন নারী? আর বাঙালী নারীই বা কী চায়? কবিগুরু যদিও খুব সহজ করেই বলে গেছেন, ‘সাধারণত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নহে; সে নিতান্ত নিরীহ।’
কিন্তু, বাঙালী নারীর মন কি এতোই সহজপাঠ্য? নাহ! তা’ই বা কেমন করে হয়! সেই ছেলেবেলা থেকেই তো ‘নারীর মন’ নিয়ে নানা মুনির নানা মত শুনে এসেছি। কেউ বলেছে ‘নারীর মন ছলনায় পূর্ণ’, কারও মতে ‘নারীর মনে কী আছে তা ঈশ্বরেরও অজানা!’

‘নারীর মন’ বস্তুটাকে ‘হালকা’ বা ‘খেলো’ বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করেছে অনেকে। কেউবা এটাকে ‘জটিল-রহস্যময়-দুর্বোধ্য’ বলে চিহ্নিত করেছে। অপরপক্ষে, ‘নারীর মন অত্যন্ত নরম-কোমল’ এমনটাও শুনেছি ঢের। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে পড়েছিলাম, ‘একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের মধ্যে আসলে কোন মিলই নেই। শরীরের অমিল খুবই ক্ষুদ্র অমিল- আসল অমিল হল মনে, মানসিকতায়। একটা ছেলের মানসিকতা এবং একটা মেয়ের মানসিকতা- আকাশ এবং পাতাল পার্থক্য। কোন ছেলে যদি কোন মেয়ের মনের ভেতরটা একবার দেখতে পারত তাহলে সে বড় ধরনের চমক খেত।’
কী সেই চমক?

জাতীয় কবির বয়ান অবশ্য ভিন্ন কথা বলে, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেয়ালী হচ্ছে মেয়েদের মন!’ মানিকবাবুও এই কথার সমর্থনে লিখেছেন, ‘মেয়ে মানুষের এরকম হয়, ওরকম হয়, সব রকম হয়, শুধু মনের মত হয় না!’
কিসে তবে তাহাদের মনের মত হইবে? কিসেই বা তাহাদের মন গলিবে?
জুলস রেনার্ড নামক জনৈক্ ফরাসী পণ্ডিত অবশ্য পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘কোন নারীকে খুব সুন্দর না বলে, বল যে তাঁর চেয়ে সুন্দর আর কেউ নেই। দেখবে তোমার সামনে সমস্ত রাস্তা খুলে গেছে!’

যাই হোক, ফরাসী নারীর মন আর বাঙালী নারীর মন এক হবার কোন কারণ নেই। আদতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুটি ভিন্ন প্রতিবেশের মানুষের মনোদৈহিক গঠন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণই ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই, বাঙালী নারীহৃদয়ের সুলুক-সন্ধান করতে গেলে, তা উহার নিজস্ব সংস্কৃতির চশমার ভিতর দিয়েই খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের প্রচলিত আচার-বিশ্বাস ও সংস্কারগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে। এই অঞ্চলের অতীব রক্ষণশীল ও কট্টর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা জন্মবধি নারীর উপর যে কঠোর আধিপত্যবাদ কায়েম করে, তার ফলে নারী মনের বিকাশ স্পষ্টতই বাধাগ্রস্থ হয়। কেবলমাত্র ‘শরীর’ নামক এক জুজুর ভয়ই নারীমনে এমন শক্তভাবে বাসা বেঁধে থাকে যা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না অধিকাংশ নারী। ফলে বিপরীত লিঙ্গের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে গিয়েও নারীর মন দ্বিধা ও সন্দেহমুক্ত হতে পারে না। সমরেশ মজুমদার তাঁর এক উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েগুলো তাদের সব রকম কনজারভেটিভ ধারনা বুকে পুষে রেখে এমন ভাবভঙ্গী করে যেন পৃথিবীর সব ছেলেই তাদের দিকে হামলে পড়ছে।’ আহমেদ ছফাও তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বাঙালী ও ইউরোপীয় নারীদের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঙালী মহিলারা মনে করে যৌন অঙ্গটা তাদের সোনার খনি, ইউরোপিয়ান নারীদের কাছে যা তাদের শরীরের একটা অংশমাত্র।’

সমাজ প্রচলের গভীরে প্রোথিত এইসব সংস্কার ভেঙে বেরিয়ে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। আর অন্ধ প্রচল পরিধি ভাঙা নারীর একার দায়ও নয় নিশ্চয়!
যাই হোক বাঙালী নারীর মন বোঝার নিরিখে সাহিত্য পর্যালোচনা করতে গেলে হতাশই হতে হয়। সুনির্দিষ্টভাবে এই বিষয় নিয়ে এদেশে কেউ গবেষণা করেছে বা সমৃদ্ধ কোন নিবন্ধ লিখেছে এমনটা খুঁজে পাইনি (আমার অনুসন্ধান অসম্পূর্ণ থাকতে পারে)। যদিও বাংলা সাহিত্যে বিক্ষিপ্তভাবে নারীর ‘বুদ্ধি-প্রকৃতি-প্রবৃত্তি’ বারবারই এসেছে, যা হয়ত সামগ্রিকভাবে নারীর মন বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সাহিত্যের বিদগ্ধজনেদের এসকল বানী/দৃষ্টিভঙ্গির অধিকাংশ’ই বাঙালী নারীকে খুব ‘হালকাভাবে’ বিবৃত করে এসেছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়’ই আছে, ‘পুরুষের বুদ্ধি খড়গের মতো; শান বেশি না দিলেও কেবল ভারেই অনেক কাজ করতে পারে। মেয়েদের বুদ্ধি কলম-কাটা ছুরির মতো; যতই ধার দাওনা কেনো, তাতে বৃহৎ কাজ চলে না।’
অবশ্য সমাজ যেখানে পুরুষ-শাসিত, সাহিত্য সেখানে নির্মোহ থাকবে এমনটা আশা করার কিছু নেই। একটা অফ্রিকান প্রবাদ মনে পড়ছে, ‘সিংহরা নিজেদের ইতিহাস লেখার আগ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল গল্পই কেবল শিকারীর জয়গানই গেয়ে যাবে!’

সন্তানধারণ ও প্রতিপালনে মূখ্য ভূমিকার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই নারীর মধ্যে ‘নিরাপত্তাবোধ’ সংক্রান্ত প্রবৃত্তি বেশ প্রখর। এই নিরাপত্তাবোধমূলক প্রবৃত্তি সার্বজনীন, এবং বাঙালী নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং প্রবলা প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরূপ প্রভাব এই অঞ্চলের নারীর মনকে আরও শঙ্কাগ্রস্থ করে তুলেছে। নারীমনের এই শঙ্কাগ্রস্ততা যে মোটেই অযাচিত নয় তার অসংখ্য প্রমান আমাদের সমাজের চতুর্দিকেই ছড়িয়ে আছে। এমনকি নারীর মৃতদেহও যৌন লালসার বিষয় হয়ে ওঠে এই সমাজে!
আর একটা বৃহৎ প্রপঞ্চ যা বাঙালী নারীর মননে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটা হচ্ছে সম্পদের মালিকানা। আজকালকার শহুরে সমাজে এইটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অর্থনৈতিকভাবে সম্পদশীল নারীর তুলনায় সম্পদহীন নারী অনেক বেশি নিগৃহীত, বা গৃহিণীর তুলনায় কর্মজীবী নারীরা মানসিকভাবে অনেক বেশি দৃঢ়। এইসকল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও সামগ্রিকভাবে বাঙালী নারীর মনন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলত, শত শত বছরব্যাপী পুরুষতন্ত্রের নিপীড়ন, প্রবলা প্রকৃতি, সম্পদহীনতা এবং এরূপ আরও কতগুলো প্রপঞ্চের প্রভাবে বাঙালী নারীর মন দিনে দিনে আরও বেশি রহস্যময়, আরও বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কী আছে এই রহস্যের গহীনে?

এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। কে জানে! হয়ত বাঙালী পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কখনো চায়নি এই রহস্যের গহীনে যেতে। ডুবুরির মত অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নয়, নিখাদ প্রেমিকের হৃদয় নিয়ে ডুব দিতে নারীর হৃদ মাঝারে। স্পর্শ করতে সেইসব অনুভূতিগুলোকে, যা হয়ত হাজার হাজার বছরের অবহেলা আর অনাদর সত্ত্বেও ম্রিয়মান দীপশিখা হয়ে জ্বলে আছে বাঙালী নারীর হৃদয়ে!

হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি লেখ্যাংশ দিয়ে শেষ করি প্রজাপতির এই নির্বন্ধ, ‘ব্যবহার করা কপালের টিপটার আঠা নষ্ট হলেও মেয়েরা সেটা যত্ন করে রেখে দেয়। একজোড়া কানের দুলের একটা হারিয়ে গেলেও অন্যটা ফেলে না। পুরাতন শাড়িটা, ভাঙা চুড়িটা, নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইল টা কাজে লাগবেনা জেনেও তুলে রাখে, সবকিছুর কারণ হল মায়া। মেয়েরা মায়ার টানে ফেলনা জিনিসও ফেলে না। অসংখ্য কষ্ট, যন্ত্রণা পেয়েও মেয়েরা মায়ার টানে একটা ভালোবাসা, একটা সম্পর্ক, একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে চায়। এই জন্য মেয়েরা মায়াবতী আর মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই!’

লেখক: মৃন্ময় আহসান, গল্পকার
ই-মেইলঃ [email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.