ফেসবুকীয় ‘ট্রল’ ও আমাদের মানসিক বিকারগ্রস্ততা

মহুয়া ভট্টাচার্য:

‘ট্রল’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যদি খুঁজতে যাই, অভিধান বলছে – ‘ট্রল’ মানে হলো ‘খেয়াল খুশিমত খাপছাড়া গান গাওয়া’। অর্থ হিসেবে তা স্যাটায়ার বা সমালোচনা বোঝালেও বর্তমান সামাজিক মাধ্যমে এর ব্যবহার হচ্ছে কেবল ‘হেটস্পিচ’ বা হয়রানি হিসেবে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এইসব হেট স্পিচ বা হয়রানিমূলক কাজে জড়িত ব্যক্তিরা ভয়ংকর ও কুৎসিত মনোবিকারের শিকার।

আমাদের নৈরাশ্যবাদ দিন দিন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করছে সুকুমার বৃত্তিগুলোকে। আমরা এখন বুঝতে পারি না সমালোচনা কী, আর কাদা ছোড়াছুঁড়ি কী। যেকোনো একটি বিষয় নিয়ে অহরহ ট্রল করে যাওয়ার আগে বুঝতে চেষ্টা করি না ঘটনার গভীরতা। সমালোচনা অবশ্যই থাকবে, সমালোচনা জরুরিও। কিন্তু তা গঠনমূলক হওয়া চাই তো।

ধরুন, একজন ষাটোর্ধ্ব  ব্যক্তি তাঁর কন্যসম নারীকে বিয়ে করেছেন। তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে তাঁরা ছবি পোস্ট করেছেন। এবার আপনি সেই ছবি নিয়ে ট্রল করতে আরম্ভ করলেন, আপনার সাথে যোগ দিলেন আপনারই সমমনা কিছু ব্যক্তি। আপনি বয়স্ক ভদ্রলোকের টাকার দোহাই দিলেন, ক্ষমতার দোহাই দিলেন তাঁর তরুণী বিয়ে করার জন্য। তিনি কি মহা অপরাধ করে ফেলেছেন? তাঁর স্ত্রী কি কোথাও এসে বুঝিয়ে গেছেন এই বৃদ্ধের সাথে তিনি সুখী নন? আপনি কি কোন প্রমাণ পেয়েছেন তিনি জোর করে কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে নারীটিকে বিবাহে প্রলুব্ধ করেছেন? আমি নিশ্চিত আপনি তেমন কোনো প্রমাণ যোগাড় না করেই স্রেফ হাসি-তামাশা করতে এই সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে ট্রল করতে নেমেছেন।

ট্রল কিন্তু সমালোচনা নয়। রেলমন্ত্রীর বিয়ে থেকে শুরু করে সন্তান হওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময়ে তাঁকে কম ট্রলের সম্মুখীন হতে হয়নি এই বেশি বয়সে তরুণী বিয়ে করা নিয়ে। কিংবা শমী কায়সারের কথাই ধরুন না। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অভিনেতা, অভিনেত্রী, সংবাদকর্মী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব কেউই বাদ যান না এই হয়রানি থেকে।এসব ঘটনায় আসলে ট্রলকারী যে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। কিংবা খুব যে সচেতনভাবে এসব করছেন তাও নয়। এসব হলো আপনার ব্যক্তিগত জীবনের নৈরাশ্যের ফল, যা আপনার অবচেতন মনে আপনাকে গ্রাস করেছে ধীরে ধীরে। এই নৈরাশ্যবাদিতা নারী-পুরুষ ভেদে ভিন্ন হতে পারে।

যাপিত জীবনে বিভিন্ন কাজে অসফলতা, আনন্দ ও বিনোদনের অভাব, সমাজে – পরিবারে নিজের কাজের মূল্যায়ন না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় হওয়ার ভুলপন্থা অবলম্বন, একাকিত্ব এবং যৌন অবদমন ইত্যাদি কারণগুলো এর সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যে একাকিত্ব ও যৌন অবদমন নারী- পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ভয়ংকর আকার ধারণ করে, এর কারণেই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করছে এইসব নৈরাশ্যবাদীরা।

ব্যস্ততম পৃথিবীর একটি ভয়ংকর অসুখের নাম একাকিত্ব। হাজার মানুষের মধ্যে বসবাস করেও এক জীবনানন্দীয় শূন্যতা ভর করে আমাদের ভেতর। তা কাটিয়ে ওঠার ভুল প্রয়াস হতে পারে এই ভিত্তিহীন দুর্বল আক্রমণ। নারী-পুরুষের মনোযৌন সমস্যা তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত করে এবং এর ফলে তার সামনে কেউ সঙ্গীর সাথে সুখী জীবন যাপন করতে দেখলে অসুখী হয়, আর তার সহজ বহিঃপ্রকাশ হলো ফেসবুকীয় ট্রল।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যা আমরা নিজের অনিচ্ছা স্বত্বেও মনে অবদমন করে রাখবো, তাই বিভিন্ন নেতিবাচকভাবে প্রকাশিত হবে। এজন্যই আমরা অন্য কারো দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার সঙ্গী পরিবর্তনের খবরকে নিজের অবদমিত ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মন্দভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করি। বার্ধক্যে এসে কারো সঙ্গী নির্বাচন আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠে। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে অবশ্যই মনোচিকিৎসকদের সাহায্য নেওয়া দরকার।

শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ফিট হওয়া সত্ত্বেও কোনো একজন নারী পুরুষ যৌন জীবন উপভোগ করতে পারেন না। শারীরিক সম্পর্কে অর্গাজমের বিষয়টিও আমাদের অনেকের অজানা। নিজেদের এইসব অজ্ঞতা ও অপারগতার বহিঃপ্রকাশ এই “হেটস্পিচ ” বা অন্যদের প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ বা “ট্রল “। নিজের জীবনে যার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি, তা অন্যদের মধ্যে দেখতে পাওয়া অনেকটাই বিষবৎ মনে হয় তাদের কাছে। এদের এই ট্রলিং ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীদের জন্য মানসিক বিপর্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অতীতে বহুব্যক্তি এর শিকার হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই ট্রলকারীদের একটি সহজ শিকার নারী। নারীর দেহ এবং আচরণের প্রত্যেকটি ধাপে ধাপেই তারা তাদের হয়রানির উপকরণ খুঁজে পেয়ে যান। প্রযুক্তির যথেচ্ছ এই অপব্যবহারে নারী পুরুষ উভয়কেই দায়ী করা যায় এখন। নারীরাও এই মানসিক বিকারগ্রস্ততায় কম যান না। এর জন্য পারিবারিক শিক্ষা এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশকেও পর্যালোচনায় রাখতে হয়। আইনের কঠোর প্রয়োগের সাথে সাথে মানসিক সুস্থতার উন্নয়নের জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি এক্ষেত্রে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.