নাজনীন পারভীন:
(১)
অনেক দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে, ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়ে আসছে। স্পষ্ট হয়ে ওঠা শব্দটা ক্রমশ হাতুড়ি পেটানোর শব্দে পরিণত হয়েছে। মনে হলো হাতুড়িটা অন্য কোথাও নয়, পেটানো হচ্ছে তার মাথার উপর। তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো সুলতানা ইসলামের। তাসলির গলা শুনে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। না, কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে না, তাসলি দরজায় নক করছে। ঘুমের ওষুধের রেশ তখনো ভালো ভাবে কাটেনি। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোলো। দরজা খুলে দিতেই তাসলি ঘরে ঢুকলো চা নিয়ে।
– এমা তুমি এখনও বিছানা ছাড়োনি। আমি যে তোমার চা নিয়ে এলাম।
– কাল রাতে বেশি ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম, তাই আজ উঠতে দেরি হয়ে গেল।
– মা-ছেলেতে কী যে করো না। ভাইয়ার চা দিয়ে এলাম দরজার বাইরে, তারও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। এরপর তোমাকে দিতে এলাম। তোমাকেও তো কতক্ষণ ধরে ডাকছি। মা-ছেলেতে মিলে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছো যে আজ? চা কোথায় দেবো?
– বারান্দায় রেখে যা- বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
বারান্দায় এসে দেখলো ধোঁয়া ওঠা চা, তার মানে নতুন করে আবার চা দিয়ে গেছে তাসলি। সাথে বিস্কুট আর পত্রিকা। এইজন্য তাসলিকে এতো ভালোবাসে সুলতানা ইসলাম। আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল তাসলিকে। হাড়গিলা চেহারার উঠতি বয়সের একটা মেয়ে, রাস্তায় ফুল বিক্রি করছিল। ওকে দেখে মায়া লেগেছিল সুলতানার। এক জীবনে অনেক ভিখারী, ফুল বিক্রেতাকে বলেছে- রাস্তায় না থেকে ওর বাসায় যেতে, বাসার কাজ করতে। কেউ কখনও এ পথ মাড়ায়নি। কিন্তু তাসলিকে বলা মাত্র ওর চোখে-মুখে একটা ঝিলিক দেখেছিল। বলেছিল ফোন নম্বর দিতে, ও জানাবে। একটা কার্ড দিয়ে এসেছিল, যার পেছনে বাসার ঠিকানা। বেশ কয়েকদিন পরে অফিস থেকে ফিরলে দারোয়ান জানালো, একটা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সুলতানা অবাক হয়ে দেখলো ফুল বিক্রি করা সেই মেয়েটা। এই ক’দিনে ভুলেই গিয়েছিল মেয়েটার কথা। সেই থেকে তাসলি এই বাসার একজন সদস্য। পরে তাসলির কাছে জেনেছে, কীভাবে সে দুদিন এসে সুলতানা ইসলামের পুরো খোঁজখবর নিয়ে তারপর এখানে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এমনিতেই ঢাকায় এসে অনেক বিপদে পড়েছে, তাই কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি। সময়ের সাথে সাথে তাসলির উপর নির্ভরতা বেড়েছে, খালাম্মা থেকে কখন ওর মা হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। প্রথম দিকে শুধু বাজারের মাসের টাকা দিত তাসলির হাতে। তাসলির দ্বারা পাইপয়সাও কখনও এদিক-ওদিক হয়নি সুলতানার সংসারের। আজ তাই সুলতানা ইসলাম চোখ বন্ধ করে ভরসা করে তাসলিকে। শুধু সংসারের রান্না-বান্না না, বাজার-ঘাট থেকে শুরু করে ব্যাংক পর্যন্ত সব তাসলির ডিপার্টমেন্ট। আগে তো ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল ব্যাংকে গিয়ে দিয়ে আসতো। যখন সব প্রিপেইড হলো সুলতানা ভেবেছিল এবার হয়তো এগুলো নিজেকে দেখতে হবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সব ম্যানেজ করে নিল তাসলি। নিজের জমানো টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনে নিল, আবরার, সুলতানা ইসলামের ছেলের কাছ থেকে শিখে নিল কীভাবে ব্যলান্স চেক করতে হয়, কীভাবে টাকা দিতে হয় অনলাইনে। গ্রামে থাকতে স্কুলে পড়তো তাসলি, তাই নতুন কোন কিছু শিখতে তার সময় লাগেনি।
মা-ছেলে আর তাসলি তিনজন মিলে গোছানো একটা সংসার। আবরার কাজ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল অফিসে আর সুলতানা ইসলাম করেন শিক্ষকতা। ইডেন কলেজ থেকে পাশ করা সুলতানা বিভিন্ন কলেজ ঘুরে ঘুরে ক্যারিয়ারের শেষ জীবনে ইডেন কলেজে পড়াচ্ছেন। শিক্ষকতা পেশাটা খুব উপভোগ করেন তিনি।প্রতিবছর এক ঝাঁক নতুন মেয়েরা আসে, চোখে নানান রকম ম্বপ্ন নিয়ে। ওদের চিন্তা-ভাবনা, ওদের সঙ্গ, তারণ্য, সব মিলিয়ে সুলতানা ওদের একজন হয়ে যায়।দেখতে দেখতে বছর পেড়িয়ে যায়, এক সময় পাশ করে বেরিয়ে যায়, তাদের জায়গা দখল করে নেয় আরো নতুন এক ঝাঁক তারুণ্য। সুলতানা ওদের সাহিত্য পড়ানোর সাথে সথে জীবনের বোধ, জীবনে কিভাবে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়, কীভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে পথ চলতে হয় তার শিক্ষা দেন। কারন সবার জীবন এক রকম ভাবে এগোয় না, একজনের জীবন যুদ্ধ একেক রকম, নির্দিষ্ট কোন ফরমুলা দিয়ে তার সমাধান করা যায় না।
তাসলি ঘরে ঢুকলো চিন্তিত চেহারা নিয়ে।
– মা, ভাইয়া তো অফিসের জন্য বের হলো না এখনও, ওর তো কখনো দেরি হয় না অফিসে যেতে।
সকালের চাও কিন্তু পড়ে আছে। শরীর খারাপ করলো নাকি? তুমি একবার দেখবে?
সুলতানা তাসলির সাথে বের হয়ে আবরারের দরজায় নক করলো কয়েকবার। ভেতরে কোন শব্দ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলো, কিছুই বোঝা গেল না। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। ফোন করলে তা বেজে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে। এবার সুলতানা ইসলামের কপালেও চিন্তার রেখা দেখা দিলো। বিল্ডিং এর কেয়ারটেকারকে ডাকা হলো। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে হাল ছেড়ে দিলো সে। সুলতানাকে বললো:
– ম্যাডাম, লকের চাবি আছে আপনার কাছে?
দরজা ভেঙ্গে ফেল।
– না ম্যাডাম, আমার মনে হয় তার আগে পুলিশ ডাকা দরকার।
থানায় ফোন করতে গেল সুলতানা।
– হ্যালো, মিরপুর মডেল থানা?
– হ্যাঁ, আমি সাব-ইন্সপেকটার আমিনুল, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাডাম?
– আমি সুলতানা ইসলাম, শিয়ালবাড়ি ইবনে-সিনার পেছনের আশা এপার্টমেন্টে থাকি, আমি আর আমার ছেলে আবরার। সকাল থেকে ওকে ডেকে যাচ্ছি, কিন্তু দরজা খুলছে না। ওকে কখনও ডাকতে হয় না, আটটার মধ্যে রেডি হয়ে বের হয়ে আসে নাস্তা করার জন্য।
– মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন?
– মোবাইল ওর ঘরে বেজে যাচ্ছে। আমি এপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারকে ডেকেছিলাম কিছু একটা করার জন্য। ও বললো, দরজা ভাঙ্গার আগে পুলিশ ডাকা দরকার। আমার খুব ভয় করছে, আমিনুল সাহেব-কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো সুলতানার।
– আপনি চিন্তা করবেন না, আমার পৌঁছাতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।
অল্প সময়ে পুলিশ পৌঁছে গেল। দুই -একবার দরজায় জোরে জোরে শব্দ করে আমিনুল জিজ্ঞসা করলো:
– আপনার ছেলে মদ খায় অথবা অন্য কোন নেশা করে?
– ও তো কর্পোরেট অফিসে কাজ করে, অফিসে ড্রিংক করলেও করতে পারে, কিন্তু বাসায় কখনও দেখিনি।
– ম্যাডাম, দরজাটা ভেঙ্গে ফেললাম।
মুহূর্তে খুলে গেল দরজা, আবরার বিছানায় শুয়ে আছে। আমিনুল কাছে গিয়ে পালস দেখার জন্য হাত ধরতে গিয়ে দেখলো শরীর ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছে। পালস দেখার কিছু নেই। সুলতানা উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমিনুলের দিকে। মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ালো আমিনুল। নিজেকে সামলাতে গিয়ে দরজা ধরে বসে পড়লেন সুলতানা। সমস্ত উৎকণ্ঠা, ভয়, খারাপ কিছু হবার আশংকার পালা শেষ হলো। সমাপ্ত হলো মা-ছেলের আটাশ বছরের সংসার জীবন। শেষ হয়ে গেল সুলতানা ইসলামের ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা, ক্রমোজোম বনাম মানুষ করার লড়াই। যে চ্যালেঞ্জ সে নিয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেল কোন ফলাফল ছাড়াই।
(২)
ত্রিশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল ব্যবসায়ি আজিজ উদ্দিনের সাথে। সুলতানা তখন ইংরাজিতে অনার্স পড়ছে। সরকারি চাকরিজীবী বাবা নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। শুরুর জীবনটা বেশ ভালো ছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবার আজিজ উদ্দিনের, বাবা এমাজ উদ্দিন ছিলেন বিরাট ব্যাবসায়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি আর ছোট একটা ননদ নিয়ে সংসার জীবন শুরু। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে কোল জুড়ে আসে আবরার। এতো বছর আগে হলেও মন-মানসিকতা খুব ভালো ছিল ওর শ্বশুর-শাশুড়ির। বাচ্চা হবার পরও সুলতানার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কিংবা লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করতে চাওয়া, কোন কিছুতেই তারা বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং তারা বিপদে-আপদে সুলতানার সাথে ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
বাচ্চা হবার পর সুলতানা আজিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলো। সময়ের সাথে সাথে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো সুলতানার কাছে। আজিজ অন্য নারীতে আসক্ত, মজার ব্যাপার হলো একজন নির্দিষ্ট নারীর প্রতি তার কোন আসক্তি নেই। একেক সময় একেক নারীর অবস্থান আজিজের জীবনে। কার কার সাথে যুদ্ধ করবে সুলতানা? প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল নারীদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে সবটা জানায় শ্বশুর-শাশুড়িকে। জল ঘোলা হতে হতে দুই পরিবারের মধ্যে বিচার পর্যন্ত গড়ালো। এমাজউদ্দিন ছেলের পক্ষে না থেকে সুলতানার পক্ষ হয়ে কথা বলেন:
– তুমি যদি তোমার বাবা-মার সাথে আর তোমার স্ত্রী-পুত্রের সাথে থাকতে চাও, তবে তোমার জীবনের জঘন্য অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আমাদের সাথে থাকতে হবে। বৌমা কোথাও যাবে না, ওরা এখানে থাকবে। আর তুমি যদি ভাবো তুমি তোমার মতো উচ্ছৃংখল জীবন কাটাবে, তবে তুমি নিজের পথ দেখো। আর তোমার মুখ আমাদের যেন দেখতে না হয়।
আজিজ বাবার কথা মেনে নিয়ে বাড়িতেই থাকলো। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আজিজ তার পুরানো চেহারায় ফিরে গেল।এমাজউদ্দিন চিরকালই এক কথার মানুষ, বের করে দিলেন ছেলেকে বাড়ি থেকে। আজিজ প্রথমে কিছুদিন বাসা ভাড়া নিয়ে থেকে এক সময় আমেরিকায় পাড়ি জমায়। কোন দিন এই বাড়ির পথ মাড়ায়নি। এমনকি বাবা-মার মৃত্যুর পরও কোন যোগাযোগ করেনি। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, আজিজ বেঁচে আছে তো? সুলতানা শ্বশুর-শাশুড়ির ছায়ায় ছেলে বড় করছিল, সাথে চালিয়ে যাচ্ছিল কলেজের পড়ানোটা। শ্বশুর তার নামে এই ফ্লাটটি দিয়েছিল যেন কোনদিন তাকে ঢাকা শহরে গৃহহীন মনে না হয়। আবরারের বয়স যখন দশ, চলে গেলেন ওর দাদী। অল্পদিনের মধ্যে পৃথিবী ছাড়লেন আবরারের দাদাও। আজ এতোদিন পরে সুলতানার মনে হয়, তবে কি ওনারা তাদের একমাত্র ছেলের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি?
(৩)
একজন মানুষ, একটা সংবাদ এতোদিনের গোছানো জীবনে সুনামি নিয়ে এলো। ওলট-পালট করে দিল তার জীবনের হিসেব নিকেশ। ঝড় থেমে যাবার পর যেমন ধ্বংসস্তুপ পড়ে থাকে, তেমনি অবস্থায় পড়ে রইলেন সুলতানা ইসলাম। কে এসেছিল, কী হয়েছিল সেদিন?
ভর দুপুরে কেউ একজন বেল বাজিয়ে যাচ্ছিল অস্থির হয়ে। তাসলি বাইরে গেছে তাই সুলতানা দরজা খুলেছিল। উদভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকলো একটা মেয়ে। মেয়েটাকে বেশ পরিচিত বলে মনে হলো, কিন্তু মনে করতে পারলো না সে।
– আন্টি আমি মৌ। আমাকে বাঁচান, সব শেষ হবার আগে।
– তুমি কে আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
– আমি আবরারের সাথে ইউনির্ভাসিটিতে পড়তাম। আপনাদের বাড়িতেও এসেছি কয়েকবার।
– কী হয়েছে তোমার? আর আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
– ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার সময় আবরারের সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারি ও সম্পর্কটা নিয়ে একদম সিরিয়াস না। আমি আস্তে আস্তে সরে যাই আবরারের জীবন থেকে। সেটা প্রায় বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। বছর দুয়েক আগে আমার বিয়ে হয়ে যায়। আজ এতো বছর বাদে সে আমাকে দেখা করতে বলছে কিছুটা প্রাইভেট সময় কাটানোর জন্য। আমি না করায় আমাকে হুমকি দিচ্ছে, আমাদের তখনকার কিছু ছবি বা ভিডিও আমার স্বামীকে দেখিয়ে দেবে বলে।
সুলতানা কী শুনছে, এটা বাস্তবে ঘটছে না কোন দু:স্বপ্ন দেখছে বুঝতে পারছিল না। সুলতানার মন -প্রাণ উজার করে দিয়ে গড়ে তোলা ছেলে, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ভদ্র ছেলে, সে কিনা এসব করেছে। সুলতানার এতো বছরের পরিশ্রম, ওর তেইশটা ক্রমোজোম, সব মাটি করে দিল আজিজের তেইশটা ক্রমোজোম। আজিজের ক্রোমজোমগুলো কি এতোটাই শক্তিশালী ছিল? সুলতানার হত-বিহবল অবস্থা দেখে মৌ বললে:
– আবরার আমার সাথেই যে এটা করেছে, তা কিন্তু নয় আন্টি। ইউনির্ভাসিটিতে, অফিসে এরকম অনেক মেয়েকে আপনি পাবেন, যারা ওর শিকার। ওর একটা মেয়েকে বেশিদিন ভালো লাগে না।
– তুমি বাড়ি ফিরে যাও মৌ।
– আন্টি আমার ওর সাথে আগামীকাল দেখা করার কথা, অফিস আওয়ারের পর। আবরার একটা হোটেলের ঠিকানা দিয়েছে। আমি না পৌঁ-ছা-লে, কথা শেষ করতে পারে না মৌ।
– তোমাকে কাল কোথাও যেতে হবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমার ছেলে তোমাকে আর ডিস্টার্ব করবে না।
সেদিন রাতে খাবার শেষে আবরারকে সুলতানা জানালো কথা আছে।
– আম্মু ঘরে এসো, চা খেতে খেতে কথা বলি।
নিজের হাতে চা বানিয়ে ছেলের ঘরে গেল সুলতানা । কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। অবশেষে ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো:
– মৌ কে আবরার?
– মৌ তোমার কাছে চলে এসেছে। কী বোকা মেয়েটা, নিজেই নিজের বিপদ বাড়ালো।
– তার মানে মৌ যা বলেছে সব সত্যি!
– আম্মু, এটা আমার নিতান্তই পারসোনাল ব্যাপার। এতে তুমি নাক গলাতে এসো না, প্লিজ।
– না, এটা তোমার পারসোনাল ব্যাপার না, এর সাথে আমিও জড়িত।
– আম্মু আমি তো কখনও তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলিনি। এমনকি কখনও জানতে চাইনি তোমার সাথে বাবার কী হয়েছিল, কেন আমি বাবা ছাড়া বড় হলাম? আমার জীবন তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে এসো না, কারও জন্য সুপারিশ করেও কোন লাভ হবে না।
সুলতানা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। পঁচিশ বছরের আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছে। মনে হলো এটা তার ছেলে নয়, কথা বলছে আজিজ, কথা বলার ভঙ্গি, জীবন নিয়ে স্বৈরিতা, হুবহু একই রকম। ছাত্র-ছাত্রীদের সারা জীবন মূল্যবোধ শেখালো, নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে শেখালো, তবে কি তার শিক্ষার ভেতরে কোন গলদ ছিল? সে তো তার নিজের ছেলেকেই কিছু শেখাতে পারেনি, অন্যদের কাছে কী আশা করবে? আপাদমস্তক একজন ব্যর্থ মানুষ বলে মনে হলো। আবরারের ঠাণ্ডা গলার শব্দে ফিরে তাকালো:
– দিস ইজ মাই লাইফ এন্ড আই হ্যাভ ফুল রাইট টু লিড ইট ইন মাই ওন ওয়ে। ইউ হ্যাভ নো রাইট টু ইনটারফেয়ার। আই উইল ডু হোয়াটএভার আই লাইক।
আবরারের শেষ কথায় ঝড়ের পরে পড়ে থাকা অবশিষ্ট ধ্বংসস্তুপটুকুও যেন বিলীন হয়ে গেল। সুলতানা হারিয়ে যেতে লাগলেন অতল কোন গহ্বরে।
(৪)
তাসলির ডাকে ঘোর কাটলো সুলতানার। ততক্ষণে বডি গোছল করানো হয়ে গেছে। সাব-ইন্সপেকটার আমিনুল জানিয়ে গেল, আবরার আত্মহত্যা করেছে। তার চায়ের কাপে ও ময়লার ঝুড়িতে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে। আছর নামাজের পর শেষকৃত্যের জন্য রওনা হয়ে গেল, আশুলিয়ার উদ্দেশ্যে, গন্তব্য তাদের তাদের পারিবারিক কবরস্থান। সুলতানা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। তার ছেলের শেষযাত্রা দেখার জন্য। শবযাত্রাটা ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে হাড়িয়ে গেল রাস্তার আড়ালে। চোখের পানিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, প্রকৃতিও তাকে সঙ্গ দিল, ধুয়ে দিল চোখের নোনা জল।
সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম ভাবে। শরতের কাশফুলগুলো পানির ভারে নুইয়ে আছে। সুলতানা বসে আছে ছেলের কবরের পাশে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমে গেল, হালকা রোদ আর মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে কাশফুলগুলোকে। নুইয়ে পড়া কাশফুলগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়ালো, তার ঝলমলে সাদা রং নিয়ে। নিজেকে ঠিক কাশফুলের মতো হালকা লাগছে। কী শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে আবরার, আর কোন পাপ তাকে স্পর্শ করবে না। যে সন্তানকে সে পৃথিবীতে এনেছে, সে যদি পৃথিবীর জন্য অশুভ হয়, তবে সেই অশুভ শক্তি বিনাশ করার দায় তো তার উপরেই বর্তায়। বিকেলের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যাবার সময় হয়ে এসেছে।
উঠে দাঁড়ালো সুলতানা, ফিরতে হবে, বাকি জীবনের পথটা একলা চলতে হবে। উঁচু-নিচু রাস্তায় হোঁচট খেল, পড়তে পড়তে একটা হাত এসে ধরলো তাকে। শক্ত করে ধরে রইলো, হাতটা তাসলির, যার হাত সুলতানা ধরেছিল অনেক বছর আগে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন নারী, ততক্ষণে দিনের শেষ আলোটুকু নিভে যাচ্ছে, অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে তারা।