আপনি মা, সন্তান আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার

দিনা ফেরদৌস:

বাচ্চাদের নিয়ে বেশিরভাগ মেয়েদেরই দু:শ্চিন্তার শেষ নেই। নতুন মায়েদের তো বাচ্চার আচরণ বুঝতে বুঝতেই একটু সময় লেগে যায়। আমি নিজের কথাই বলতে পারি। প্রথম বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর বাচ্চা একটু বমি করলে যেই ভয় পেতাম, দ্বিতীয় বাচ্চার বেলায় দিনে তিনবার বমি করলেও সেই ভয় পাই নাই। প্রথম বাচ্চাকে ঘড়ি দেখে খাবার, গোছলের টাইম, একটু বিছানা থেকে পড়ে গেলেই মনে হতো এই বুঝি সব শেষ। কিন্তু দ্বিতীয়টাকে টাইম-বেটাইম কোন কিছুর হিসাব না করে তার ঘুম ভাঙলে ধীরে সুস্থে খাওয়াই, মাঝেমধ্যে বিকেলেও গোসল দেই। আর দিনে যে কতবার এইখানে, ওইখানে পড়ে ব্যথা পায়, তার হিসাব নেই।

তবে একটা বিষয় বুঝি যে মা যেভাবে সন্তানের আচরণ, ভাষা, প্রয়োজন বুঝে, দুনিয়ায় কারও পক্ষেই তা বোঝা সম্ভব না, হয়তো সারাক্ষণ পাশে থাকার জন্যেই এই বোঝাপড়া। প্রতিটা মায়েরই বাচ্চা পালনের পদ্ধতি আলাদা। ঠিক আমার মতো করে আরেকজন তার বাচ্চা পালন করছেন না, আমি যা খাওয়াই তা খাওয়াচ্ছে না, তাই বলে তারটা ভুল বলার সুযোগ নেই। কথা হচ্ছে বাচ্চা সুস্থ সবল আছে কিনা, খেলছে কিনা, ঠিকমতো প্রশ্রাব -পায়খানা করছে কিনা।

আর একটা বিষয় হচ্ছে, কারও বাচ্চা দেরিতে কথা বলে, কারও বাচ্চা দেরিতে হাঁটে, কারও বাচ্চা দেরিতে ডায়পার ছাড়ে, কারও বাচ্চা দেরিতে নিজের হাতে খাওয়া শিখে, কোন কোন বাচ্চা একটু বেশি মাত্রায় চঞ্চল হয়, কোন বাচ্চা শান্ত প্রকৃতি। এইগুলো নিয়ে অনেকেই তুলনায় চলে যান। আমার মেয়ে ১৩ মাসে সুন্দর করে হাঁটা শিখেছে, তার আগে কিছু না ধরে হাঁটার সাহস করতো না। অপরদিকে ছেলে আটমাস থেকেই কী সুন্দর হাঁটে, যা বলা যায় সব কপি করে বলে, সারাক্ষণ বোনের সাথে বকবক করে। মেয়ে প্রথম সন্তান হওয়াতে ওর খেলার সঙ্গী ছিল না, আমি ছিলাম তখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত, ওর বাবার অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে ঢাকা শহরের রাস্তার জ্যামেই চলে যেতো সারা বিকেল, রাত্রে বাসায় ফিরে রেস্ট করার ফাঁকে বাচ্চাকে যা সময় দিতেন, তা যথেষ্ট ছিল না। আমাদের দেশে বেশিরভাগই বাচ্চা দেখার জন্যে আলাদা সহকারি রাখেন, কেউ কেউ দাদি- নানির সাহায্য নেন। আমি কারও সাহায্যই নেইনি কোনদিন। ফলে কথাবার্তার মানুষ না থাকায় একটু দেরিতে কথা বলা শিখে।

দুটি বাচ্চাই গর্ভে আসা থেকে শুরু করে জন্ম দেয়া ও বড় হয়ে উঠার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। আগের অভিজ্ঞতার যা কাজে লেগেছে তাহলো, পরের বাচ্চার কোন আচরণে হুটহাট ভয় পাই নাই , প্রথমে বোঝার চেষ্টা করি, তারপর ডাক্তারের পরামর্শ নেই। একবার, দুইবার না খেলে বাচ্চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বলেও মনে করি না, দেখার চেষ্টা করি সে ঠিকঠাক খেলছে কিনা, এক ধরনের খাবারে বিরক্ত কিনা। বাচ্চাদের খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালরি রাখার চেষ্টা করি। ফলে ডাক্তারের কাছে যখনই বাচ্চা নিয়ে যাই, বাচ্চার স্বাস্থ্য দেখে ডাক্তার আমার প্রশংসা করেন রীতিমতো। প্রশংসা পেয়ে বিগলিত হয়ে যাবারও কিছু নেই। বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ হয়। ছোটজন নতুন হাঁটতে শিখেছেন। ইচ্ছেমতো সারা ঘর বিচরণ করেন। বাথরুম +রান্নাঘর তিনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। ফলে সারাক্ষণ পাহারায় থাকতে হয়। তিনার সবচেয়ে প্রশংসনীয় ক্ষমতা হচ্ছে, কার্পেটের যেই ময়লা আমাদের অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে খুঁজে দেখতে হবে, তা তিনি খালি চোখে দেখে চোখের পলকে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে পারেন। ফলে টুকটাক অসুখ-বিসুখ হয় বৈকি। বাচ্চারা অসুস্থ হলেই যে মা খেয়াল করে না, তা নয়।

আমাদের সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে না, “মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি”। যাদের বাচ্চা আছে, তারা সকলেই কম বেশ এইসব মাসীদের সাথে পরিচিত । যেমন আমার মেয়ে যখন দেরিতে হাঁটা শিখলো তখন সারা পাড়ার কোন বাচ্চারা আগে হাঁটা শিখেছে, তা নিজ দায়িত্বে লোকজন আমার কানে পৌঁছে দিত। আমার মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা, বাচ্চা পেটে থাকলে কী খেলে গায়ের রঙ ফর্সা হয়, তা নিয়ে যেমন আলোচনা শুনতে হয়েছে, তেমনি আমার বাচ্চার চেয়ে কার কার বাচ্চা দেখতে বেশি সুন্দর হয়েছে তা নিয়েও আলোচনা শুনতে হয়েছে কান ভরে। মূর্খদের বুঝানো মুশকিল, ফল- ফুল খেলেই বাচ্চার গায়ের রঙ ফর্সা হয় না, এইসব জেনেটিক্যালি পাওয়া। অন্যদিকে আমার ছেলের গায়ের রঙ মেয়ের থেকে কিছুটা উজ্জ্বল। তার মানে এই না যে আমাদের মা-বাবার চোখে কোন বাচ্চাকে দেখতে কম সুন্দর লাগে। আমাদের চোখে দুই বাচ্চাই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দর, আর হৃদয় উজাড় করে যতটুকু ভালোবাসা দেয়া যায়, সেইখানে কোন কমতি রাখি না।

খুব কষ্ট লাগে মানুষ যখন তার নিজের বা অন্যের বাচ্চার সঙ্গে আমার বাচ্চাদের তুলনায় করে, অকারণে। কারও কারও কথা শুনলে মনে হবে আমার বাচ্চা তারাই পেলেপুষে দেবে অথবা তারা যেইভাবে বাচ্চার যত্ন নেয়, শুধু তারাই জানে বাচ্চা পালন, আর দুনিয়ায় মানুষ বাতাসে বাচ্চা জন্ম দেয়, বাতাস খাইয়ে বাচ্চা বড় করে। প্রথম বাচ্চার সময়ে যতটুকু নার্ভাস থাকে একজন মা, দ্বিতীয় বাচ্চার সময়ে অনেক অভিজ্ঞ হয়ে যায়, সাহস কাজ করে। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা দেশের বাইরে জন্ম নেয়ার কারণে ডাক্তারদের অনেক কাউন্সেলিং পেয়েছি, যা দেশে পাইনি। বাচ্চার কোন কোন আচরণে ভয় পাবার কিছু নেই, কোন কোন আচরণ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, কীভাবে খাওয়াতে হবে, কী দিয়ে খাওয়া শুরু করতে হবে, বাচ্চা না খেতে চাইলে কী করতে হবে, ব্রেস্ট ফিডিং কীভাবে করাতে হবে, বাচ্চা মিল্ক না পেলে কী করতে হয়, মিল্ক এসে চলে গেলে আবার কীভাবে ফিরিয়ে আনতে হয়, এইসব ডাক্তার’রাই বলে দেন। সেইসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো অন্যদিন।

যেদিন বাচ্চা নিয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় আসবো, তার আগের রাতে ৪৫ মিনিটের কাউন্সেলিং হয় ১০ জন মা’কে নিয়ে, সঙ্গে বাবারাও ছিলেন। এরপর মনে হয় না কোন মায়ের বাড়তি কিছু জানার দরকার আছে। তারপরও বাচ্চার সাথে থাকতে থাকতে অনেক কিছুই প্রতিদিন নতুন জানা হয়, সেইসব নিয়ে অন্যের সাথে শেয়ার করাই যায়, কিন্তু আমি আমার বাচ্চার জন্যে যা করি, তাই সর্বোৎকৃষ্ট বলার জায়গা নেই। প্রতিটি বাচ্চার আচরণ, প্রকৃতি যেমন ভিন্ন, তেমনি প্রতিটি মায়েরও আছে বাচ্চা পালনের পদ্ধতি ভিন্ন। এইসব নিয়ে সাজেশন দেয়া যায়, কিন্তু সরাসরি ভুল ধরা মারাত্মক অভদ্রতা। কারণ আমার বাচ্চা দুটি আমরা (আমি+ আমার বর ) একা লালন পালন করে বড় করছি। আমরা দুজনেই পড়াশোনা করা মানুষ, বাচ্চাদের সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেই পয়সা খরচ করে, সেইখানে টোটকা জ্ঞান কেউ দিলে বিরক্ত লাগে।

বর্তমানে মেয়ের বয়স সাত বছর, তার ননস্টপ বকবকানির যন্ত্রণায় বলতে হয়, “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ” দশা। আমি সাত বছরে যা নিয়ে ভাবতে পারিনি, সে এই বয়সে অনেক অনেক ভালো বুঝে। যদিও সময় পাল্টেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলেই এই প্রভাব বুঝি। কিন্তু প্রথম দিকে সকলের কথায় কিছু না বললেও, মায়ের মন হিসেবে কিছুটা ভয় তো কাজ করতোই।

লেখাটি আমার মতো সাধারণ মায়েদের জন্যে, যারা অন্যের বাচ্চাদের দেখে ভাবেন, আমার বাচ্চাটা হয়তো পিছিয়ে আছে। আর সেইসব মায়েদের বলছি, যারা সব সময় এর তার বাচ্চাদের নিয়ে তুলনা করেন, কার বাচ্চা দেখতে কেমন, অন্যের বাচ্চা কালো, শ্যামলা বা ফর্সা হলে আপনাদের কী? যেই বাচ্চারা দেখতে আপনাদের মনমতো না, তাদের থেকে দূরে থাকুন, অভিনয় করে ভালোবাসা দেখালে মনে রাখবেন, বাচ্চার মেয়েরা কিন্তু ঠিকই বুঝে, কোনটা আসল ভালোবাসা আর কোনটা নাটকীয়।

মায়েদের শুধু বলবো বাচ্চার কোন সমস্যা দেখতে পেলে আশেপাশের লোকজনের ( তা যতোই সিনিয়র মা বা মুরুব্বি হয়ে থাকেন না কেন ) বুদ্ধি না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার’রা এই বিষয়ে পড়াশোনা করে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন। অমুক তার বাচ্চারে এইটা খাওয়ান, তাই বলে আপনারও খাওয়াতেই হবে বাচ্চার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, এমন কোন কথা নেই। আপনি বাচ্চাকে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার বিভিন্নভাবে প্রসেস করে খাওয়াতে পারেন। যেমন একদিন সিদ্ধ ডিম দিলে, আরেক দিন ভেজে দিতে পারেন। অমুকের বাচ্চা সিদ্ধ ডিম খায়, তাই আপনার বাচ্চাকেও জোর করে একই নিয়মে খাওয়াতে গেলে উল্টো হিতে বিপরীত হতেও পারে। কেউ কেউ ভালোর জন্যে বলে ঠিক আছে, কিন্তু সে সেই বিষয়ে তিনি কতটুকু জানেন তা আগে বুঝতে হবে। অনেকে আবার একটু বেশি বেশিই দেখবেন বলে, সেই বলার উদ্দেশ্য শুনলেই বোঝা যায় যে, সে আপনার চেয়ে কতো ভালো মা তা জাহির করতে চাচ্ছে।

বাচ্চার দেরিতে কথা বলা নিয়ে ভাবনা কাজ করলে, একজন স্পিচ থেরাপির ডাক্তারের কাছে যান, ডাক্তারই ভালো বলতে পারবেন, এটা আসলেই সমস্যা, নাকি স্বাভাবিক। বাচ্চা বেশি শুকনা বা মোটা হলে একজন নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শ নেন দুঃশ্চিন্তা না করে। এইসব নিয়ে দেখবেন আশেপাশের লোকজন নানা ধরনের পরামর্শ দেয় না বুঝেই। অনেকে পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি আঘাত করতে পর্যন্ত ছাড়ে না, ওই যে “মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি “। সোজা দুই কথা শুনিয়ে বুঝিয়ে দেবেন, “নিজের চরকায় তেল দাও “। আজ একটা বললে কিছু বলবেন না ভদ্রতা করে, কাল আর একটা নিয়ে আসবে। বাচ্চাদের অনেকে দুষ্ট বলে থাকেন চঞ্চলতার কারণে। বিশ্বাস করুন, এই চঞ্চলতাই বাচ্চাদের বৈশিষ্ট্য।

অবশেষে বলবো, বাচ্চা আপনার, যত্ন নিবেন আপনি, বাচ্চার অসুখ বিসুখ হলে আপনাকেই কাটাতে হবে বিনিদ্র রজনী, তাই আপনার চেয়ে কেউ বেশি জানে না, আপনার বাচ্চা সম্পর্কে। মায়েরা ভালো থাকুন নিজেদের যত্ন নিন, একজন সুস্থ সবল মা’ই পারে সুন্দরভাবে বাচ্চার দেখাশোনা করতে। বাইরের লোকজনের হাতে বাচ্চা দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে সব সময় সতর্ক থাকুন। বাচ্চারা বিরক্ত করলে মা-বাবা যতো সহজে মেনে নিতে পারেন, অন্যের পক্ষে মেনে নেয়াটা ততোটাই কঠিন। আর যদি বাচ্চা দেখাশোনার জন্যে সহকারি রাখেন, তবে সহকারির সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন, এতে আপনার বাচ্চা নিরাপদে থাকবে। যারা মনে করেন আপনার বাচ্চাকে পছন্দ করে না, তাদের থেকে দূরে রাখুন, বিশেষ করে অন্যের বাচ্চার সঙ্গে যারা আপনার বাচ্চার তুলনা করে। মনে রাখবেন, বাচ্চাদের তুলনা হয় না, প্রত্যেক বাচ্চাই তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.