রাকিবুল ইসলাম, প্যারিস থেকে:
“হাঁটা মাতব্বরি” মানে কি জানেন? কেউ আপনাকে দায়িত্ব দেয়নি, অনুরোধ করে নাই, তারপরও গায়ে পরে আপনি খবরদারি করতে গেলেন, একেই বলে হাঁটা মাতব্বরি। এর পরিমাণ বেড়েই চলছে, আর সর্বক্ষেত্রে এমন একজন হাঁটা মাতব্বরের দেখা পাবেন। এমনি এক হাঁটা মাতব্বর গতকাল এক নারীকে লাঞ্ছিত করেছে প্রকাশ্যে ধূমপানের কারণে।
ধূমপানে পুরুষের চেয়ে নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি কি বেশি? না, মোটেই তা না। মানব শরীরে সমান ভাবে ক্ষতি করবে ধূমপান। আরো উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তেমনিভাবে ক্ষতি করে গাড়ির কালো ধোঁয়া, রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস।
আলোচনাটাকে কোনভাবে ধর্মীয় দিকেও নিতে পারবেন না। কারণ ইসলাম ধর্মে সকল প্রকার নেশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। আর পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রীয় আইনে ধূমপান নিষিদ্ধ না। যদি বলেন মেয়েটা শুধু সিগারেট না আরো খারাপ কাজ করে, ঠিক আছে সেটা আইনের হাতে ছেড়ে দেন। আপনি কে আইন প্রয়োগের?
যদি বলেন সামাজিক পরিবেশ নষ্ট করে, দেখতে খারাপ দেখা যায়, না সেটাও পুরোপুরি সঠিক হবে না। ছোটবেলা দেখেছি গ্রামের বাড়িতে অনেক বৃদ্ধা নারী উঠোনের মাঝে বসে অবসর সময়ে গল্প করছে আর হুক্কা টানছে, বিড়ি ফুঁকতে দেখেছি বহু দাদী নানী বয়সী নারীদের। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে আত্মীয়রা কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও এখনকার মত সামাজিক সংকট তৈরি হয়নি। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি।
আরো উদাহরণ আছে,
জর্দা দিয়ে পান খাওয়া নিয়ে কিন্তু আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। জর্দা কিন্তু সিগারেট বা গাঁজার মত নেশা জাতীয় বস্তু। কিন্তু সমাজে সবার সামনে, অতিথি আপ্যায়নে স্বাভাবিক ভাবে নারী-পুরুষ উভয়ে এই নেশা করছে। একসময় “গুল” নামক একধরনের পাউডার পাওয়া যেত নারী-পুরুষ সকলে সবার সামনে এটা নেশার জন্য ব্যবহার করতো। এমনি কি চায়ের ক্ষেত্রে শুনেছি “অমুকের চায়ের নেশা”, নেশা কিনা জানিনা কিন্তু চা যদি দুধ চিনি দিয়ে পান করেন তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে নিশ্চিত। এখন শরীরের ক্ষতি হবে জেনেও কেউ যদি এগুলো করে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ। তাহলে কেন একটা পূর্ণবয়স্ক মেয়ে তার ইচ্ছায় ধূমপান করলে গায়ে পরে বাধা দিতে হবে?
সমাজ নষ্ট করে এমন অনেক ভয়ংকর উপাদান আছে। সে দিকে কি আমাদের নজর আছে? Tiktok, হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে প্রদর্শনী, কুরুচিপূর্ণ ফেসবুক গ্রুপ গুলো কি আমরা বন্ধ করতে পারছি? যে ছেলে বা মেয়েটিকে প্রতিবেশীরা ভদ্রভাবে স্কুলে যেতে আসতে দেখেছে সে আজকে ঘরের ভেতর থেকেই টিকটকে অর্ধনগ্ন হয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে, Funny Video র নামে কুরুচিপূর্ণ কৌতুক করছে, prank এর নামে রাস্তা ঘাটে লোকজনকে বিরক্ত করছে। এগুলো তো ভয়ংকর অসুস্থতা, ভাইরাসের মত দ্রুত লক্ষ লক্ষ কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ছড়িয়ে পরছে।
তাহলে নারী ধূমপায়ী দেখলে আমরা আঁতকে উঠি কেন?
আমার কাছে বিষয়টা পুরুষতান্ত্রিক দমন নিপীড়ন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। একটা মেয়ে সহজ স্বাভাবিক ভাবে একটি ছেলের পাশে বসে সিগারেট টানছে এটা দেখে পুরুষ সমাজ আতঙ্কিত হয়, নিজের অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। ভাবে এই বুঝি মেয়েরা ছেলেদের সমকক্ষ হয়ে গেল, আর হয়তো গৃহপালিত পশুর মত নিয়ন্ত্রন করা যাবে না।
আমাদের সমাজের পুরুষরা সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নারীকে নিজের অধীনস্থ ভাবতে পছন্দ করে। নিজের প্রভুত্ব কায়েম করতে পছন্দ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরামর্শ প্রদান কিংবা প্রধান দায়িত্বশীল হিসেবে একজন নারীকে মেনে নিতে প্রস্তুত না এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
আমার ফুপুকে দেখেছি ফুপার অকাল মৃত্যুতে অথৈ সাগরে পড়তে। বহু কষ্টে সংগ্রাম করে নিজ যোগ্যতায় সংসার দাঁড় করিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন, সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছেন। এই সমাজ কিন্তু তাঁকে নারী হিসেবে বিশেষ ছাড় দেয় নাই, প্রতিটি অর্জন নিজের দক্ষতায় করেছেন। বরং অনেক জায়গায় বাধা বা অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন।
পুরুষ তার পৌরুষত্বের বড়াইয়ে অন্ধ। আমি নিজেও শতভাগ এই পুরনো অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারি নাই, তবে চেষ্টা চলছে। চেষ্টা করতে হবে, আমাদের সবাইকে সেই চেষ্টা করতে হবে। কারণ পরিবর্তন আসবে, সে পরিবর্তনে আমরা নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারলে পিছিয়ে পরবো আমরাই, ক্ষতি হবে আমাদেরই। নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব একটি পুরনো অসুস্থ সংস্কৃতি। এর থেকে বের হয়ে না আসলে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
পরিশেষে, যদি পুরুষত্ব দেখাতে চান তার অনেক সুযোগ আছে রাস্তা আছে সেখানে দেখান। মেয়েরা ঘরে বাইরে ২৪ ঘন্টাই নিরাপদ থাকবে, সেটা নিশ্চিত করেন।