নারীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া প্রসঙ্গে

জিনাত নেছা:

নারীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া – একটি ভিডিও নিয়ে বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়া তোলপাড়। নারীর সিগারেট খাওয়া নিয়ে তোলপাড় হওয়া ভিডিওতে কিছু বিষয়ে যে কেবলই নারীর হাতে সিগারেট – হিপোক্রেসি হিসেবে দেখছি তা নিয়ে দু একটা কথা বলতে চাই।।

সকল জায়গা এমনকি সিগারেটের প্যাকেটে ও লিখা থাকে ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।কিন্তু আপনাদের কি মনে হয় সিগারেট ইস্যুতে নারীর সিগারেট খাওয়া নিয়ে যে আলোচনা তাতে আদৌ সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, সিগারেটের ক্ষতিকর দিক কিংবা ধূমপানের ক্ষতিকর দিক এগুলো মুখ্য বিষয়? এখানে কি নারীর স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে? মোটেও কিন্তু তা নয়। যদি কারো মনে হয়ে থাকে এসব বিষয়কে মুখ্য করেই নারীর সিগারেট খাওয়া ইস্যু আলোচিত হয়েছে তাহলে আমি বলবো আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন!

মূলত ‘নারী’ বলেই নারীর সিগারেট খাওয়া ইস্যু এতো আলোচিত। একজন নারী সে কেন একজন ক্ষমতাবান পুরুষের মত সাহসিকতার সাথে খোলা ময়দানে সিগারেট খাবে? এটাই মূলত মুখ্য বিষয়।নারী মানেই কোমলমতি, নারী মানেই ঘরে থাকবে, নম্র হয়ে কথা বলবে, উঁচু গলায় কথা বলতে পারবে না, নারী মানেতো ঘর সংসার করবে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গৃহকর্মে নিপূণা হবার চেষ্টা করবে যাতে ভালো পাত্র তাকে পছন্দ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ঘরে বসে রান্না করবে। আমাদের সমাজে ডিগ্রিধারী বেকার বউয়ের রান্নায় আবার আলাদা স্বাদ কিনা! নারী নিজেকে অন্যের জন্য তৈরি করবে। সেই নারী কেন খোলা ময়দানে পুরুষদের মত সিগারেট খাবে?? এটা সমাজের চোখে গর্হিত একটা অপরাধ!

লেখক: জিনাত নেছা

সিগারেট খাবে কেবল পুরুষরা, ঘরে খাবে, বাইরে খাবে, খোলা ময়দানে খাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকবে, আর আশেপাশে বসে থাকা, হেঁটে যাওয়া নারীদের লক্ষ্য করে ধোঁয়া ছাড়বে। নারী যদি প্রতিবাদ করতে যায় তাহলে আরো বেশি করে ধোঁয়া ছাড়বে। পুরুষ চায়ের দোকানে সিগারেট খেয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে পৃথিবী উদ্ধার করবে। কিন্তু নারী এসব কিছুই করতে পারবে না। কারণ সে একজন ‘নারী’। আর সিগারেট হলো পুং লিংগের প্রোডাক্ট। শুধু সিগারেট নয়, নারী সাইকেল চালাতে গেলেও সমস্যা, বাইক চালালেও সমস্যা, নারীর সবকিছুতেই এই সমাজের সমস্যা। এই হলো আমাদের সমাজের বাস্তবতা।

এখন চলুন ভিডিওটি একটু ভালো করে দেখি, তাহলে কিছু বাক্যও শুনতে পাওয়া যাবে, তা হলো:

# “পরে ধর্ষণ হলে তো আমাদেরই দোষ দেবেন”-এর দ্বারা বোঝা যায় একজন সিগারেট খাওয়া নারীকে ধর্ষণ করা বৈধ। আপনি নারী আপনি সিগারেট খান মানেই আমি ‘পুরুষ’ আপনাকে ধর্ষণ করতে পারি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই উক্তির দ্বারা স্পষ্ট যে, এই সমাজের পূর্ব থেকেই মাইন্ড সেট যে, নারী সিগারেট খেলেই সে খারাপ এবং পুরুষ তাকে ধর্ষণ করতে পারে। কী হাস্যকর! সামান্য সিগারেট দিয়ে কিনা ধর্ষণের মতো এক গর্হিত অপরাধকেই জাস্টিফাই করা হচ্ছে।

# ভিডিওটার পরিবেশটা লক্ষ্য করুন, প্রচুর মানুষ চারপাশে বসে আড্ডা দিচ্ছে,পুরুষরা বীরদর্পে সিগারেট খাচ্ছে, কিন্তু কোন সমস্যা হচ্ছে না! একজন নারী বসে সিগারেট খাচ্ছে, তাতেই কিছু জনদরদী লোকজনের চেতনা বেড়ে গেছে। নারীকে দলবেঁধে এসে হ্যারাস করছে। মূলত এটা পুরুষ বেটাদের ‘বেটাগিরি’ দেখানোর একটা উপায় মাত্র। এখানে কিন্তু কেউই “সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” কিংবা প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ “এসব বিষয়ে একবারও উচ্চারিত করেনি। এখানে নারীর স্বাস্থ্য নিয়েও তাদের কনসার্নের জায়গা ছিলো না। তাদের মূল কনসার্নের জায়গা হলো নারী কেন সমাজের তথাকথিত নিয়ম ভেঙ্গে পুরুষের মতো খোলা ময়দানে সিগারেট খাবে?? নারীর জায়গা ঘরে, নারী কেবল ঘরে থাকবে, সংসার করবে, বাচ্চা উতপাদন করবে আর স্বামীর কথা মেনে চলবে।

এখানে আরেকটি মজার বিষয় হলো, প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে জানা যায় একজন নারী সিগারেট খায় মানেই সে নারীবাদী। একজন নারী বড় টিপ পরা মানেই সে নারীবাদী। এই সো-কল্ড কথাবার্তা যারা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, নারীবাদ কি তা একটু ভালোভাবে জেনে কথা বলবেন। সিগারেট ইস্যুতে আমার একজন পরিচিত নারী বলছিলেন,”নারীবাদী না হলে কেউ এভাবে সিগারেট খেতে পারেনা”। এসকল নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনারা নারী কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বাহক।

আর হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় খোলা ময়দানে একজন নারীর সিগারেট খেতে যে সাহস লাগে তা নারীবাদকে ধারণ করলেই কেবল পাওয়া যায়। কিন্তু নারীবাদ কখনোই সিগারেট খাওয়াকে প্রমোট করে না। বরং নারীবাদ দেখানোর চেষ্টা করে বৈষম্য আসলে কোথায় আর এই বৈষম্য ভাংগার জন্য কি ধরনের সাহসিকতার দরকার!

যারা কিনা সারাজীবন নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কোন কথা বলে না, তারাই কিনা নারীর সিগারেট খাওয়া ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! আপনাদের কেন এতো মাথাব্যথা? শুধুমাত্র কোনো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছে দেখলেই এরা স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে যান বলেই এসব হিপোক্রেট থিওরিকে পাত্তা দেওয়ার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

বরং যারা কিনা নারীবাদী আছেন তারা এর প্রতিবাদ করুন। সিগারেটসহ পৃথিবীর কোন বস্তুই কোন একটা পক্ষের ব্যক্তিগত অধিকার না হয়ে যায়,শুধু নারী বলেই কাউকে হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে না হয়। শুধু নারী বলেই যদি কাউকে হ্যারাসড হতে হয় তাহলে সেই লিংগ বৈষম্যের প্রতিবাদ হউক সর্বোচ্চ।

(ফিচারের ছবিটি বন্ধু আসমা অধরা’র)

শেয়ার করুন: