কাজী তামান্না কেয়া:
পুরুষতন্ত্র সারা পৃথিবীর নারীদের জন্যেই একটা বড় বাধা, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে তো অবশ্যই। এই বাধা থাকা সত্ত্বেও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবার কারণে বাংলাদেশের নারীরা আশেপাশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নারীর চেয়ে এগিয়ে ছিল। আমরা সোশ্যাল সায়েন্সের লোকজন যেই কথাটা বলি, তা হলো বাংলাদেশ এনজিওর দেশ। এনজিওগুলো মূলত মাইক্রোক্রেডিট প্রদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেন। নারীর ক্ষমতায়ন কী? সহজ কথায়, যেখানে নারীর হাতে টাকা, কাজ, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন নারী ২০ হাজার/৫০ হাজার/১ লাখ টাকা তুলে কৃষি, গবাদি পশুপালন বা অন্য যেকোনো ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে পারে। এই নারীদের জন্যে সরকারের সহায়তা না থাকলেও এনজিওদের সহায়তায় তারা স্বাবলম্বী হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। এনজিওদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ঋণের দায়ে জর্জরিত হওয়ার ঘটনা এবং এইসব ঋণ মূলত নারীদের জন্যই নির্ধারিত থাকায় নারীদের ব্যবহার করে ঋণ নিয়ে সেই টাকা আত্মসাতের ঘটনা অহরহই ঘটেছে, এমনকি ভয়াবহ নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারণ এই ঋণ, একথাও প্রচলিত আছে সমাজে। আমরা সেইসব জানি এবং মানিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তবে ঋণ শোধ করতে পারবে কিনা সেই ভয়ে কেউ টাকা তোলা বন্ধ করেনি। পুরো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি সত্যি এবং পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকল থাকা সত্ত্বেও নারীরা ঋণ তুলতে পিছপা হয়নি এবং তা ব্যবহার করা থেকেও পিছিয়ে আসেনি।
বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে ছেলে মেয়ের অংশগ্রহণ সমান এবং ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরা এগিয়ে। কলেজে উঠতে উঠতে মেয়েদের হার কমতে থাকে। তবে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে সেখানেও মেয়ে শিক্ষার্থীর হার উল্লেখ করার মতো। সরকারি বিভিন্ন চাকুরিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ যেমন পুলিশ প্রশাসনে, প্রাথমিক শিক্ষায়, স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে বিপুলসংখ্যক নারী কর্মরত আছে। এইসব উন্নয়ন যাত্রায় মৌলবাদের ভয়ে বা পুরুষতন্ত্রের কাছে বাংলাদেশের নারীরা পরাজিত হয়নি কখনও।
সবচেয়ে আনন্দের কথা নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হবার ফলে বেশকিছু সামাজিক ইন্ডিকেটরে উন্নয়ন করা সহজ হয়েছে, যেমন বাড়ি বাড়ি টয়লেট স্থাপন, টিউবওয়েল স্থাপন, বাচ্চার টীকা দেওয়া, ভিটামিন খাওয়ানো ইত্যাদি। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন নারী সরকারি এবং বেসরকারি সুবিধা গ্রহণ করে নিজের পরিবারের উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং এখানে পুরুষতন্ত্র তেমন কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, ধর্মতন্ত্র তো নয়ই। নারীরাই এসব শতবর্ষী জঞ্জাল পেরিয়ে এসেছে যুগে যুগে।
এখনও নারীদের যেসব অধিকার পেতে হবে যেমন সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমান সুযোগ, ডিভোর্স হলে সন্তানের ভরণপোষণ প্রাপ্তি সহজ হওয়া, সিংগেল মায়ের এবং সন্তানের জন্যে প্রয়োজনীয় ভাতা সেটা স্বামী বা সরকার যার কাছ থেকেই হোক, কর্মী হিসেবে দেশের বাইরে গেলে সম্মানজনক উপায়ে কাজ করার সুবিধা, বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুবিচার পাওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এই সমস্যাগুলি সমাধান করতে গেলে রাষ্ট্রকে অনেকক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা যারা নারীবাদ নিয়ে কথা বলি, আমাদের বিরোধী শত্রু চিহ্নিত করতে ভুল করলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে পুরুষতন্ত্রের সাথে সাথে ধর্মতন্ত্র নারীর সক্ষমতাকে পিছিয়ে দেয়। এই দুই তন্ত্র এক হয়ে নারীকে হিজাব বোরকায় আবৃত করে এবং নারীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে। নারীর এগিয়ে চলার পথ কখনো মসৃণ ছিল না, এখনও নেই। যত বাধাই আসুক স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সেই কথা বলতে হবে হোক তা পুরুষতন্ত্র বা ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে। জয়ী হোক নারী।