স্তন ক্যান্সার এবং মানসিক স্বাস্থ্য

মনিকা বেগ:

প্রেক্ষাপট

এক ২০১৮ তেই বিশ্বজুড়ে প্রায় ২১ লাখ নারী এবং পুরুষ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এবং প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নারী এবং পুরুষ স্তন ক্যান্সারে মারা গেছেন। পৃথিবীর ১৫৪ টি দেশে নারীরা যত রকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তার মাঝে স্তন ক্যান্সার একদম শীর্ষে অবস্থান করছে। তার মানে এটি নয় যে বাকি ৪১ টি দেশের নারীদের মাঝে স্তন ক্যান্সার কম হচ্ছে।

এখনও উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশেই স্তন ক্যান্সারের নির্ণয় এবং চিকিৎসা রাজধানীকেন্দ্রিক এবং অপ্রতুল। ধারণা করা হয়, ৫০-৮০% ক্ষেত্রেই স্তন ক্যান্সারের নির্ণয় হয় একদম শেষ পর্যায়ে এসে, যখন চিকিৎসা করে রোগ নিরাময় করার আর তেমন সুযোগ থাকে না। সেই কারণে স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক বেশি হয়।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (IARC) এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১২,৭৬৪ জন নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং তাদের মধ্যে ৬,৮৪৪ জন এই রোগে মারা যান।

কিন্তু আমাদের দেশের পারিবারিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে নারীরা স্তন ক্যান্সার বিষয়ে তেমন সচেতন নন, বা সচেতন হলেও ভয়ে-সংকোচে-লজ্জায় এই বিষয়ে মুখ খোলেন না, সেখানে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং মৃত নারীর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বললে বোধ হয় ভুল বলা হবে না।

পারিবারিক এবং সামাজিক বাস্তবতা

আমরা যখন শুনি কোনো নারীর স্তন ক্যান্সার হয়েছে, তখন যেই ভাবনাগুলো আমাদের মাথায় প্রথম আসে সেগুলো হলো, ‘আহা বেচারা, স্তন কেটে ফেলতে হবে? সব চুল পড়ে যাবে? চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে না? বিয়ে হবে তো? সম্পর্ক/স্বামী টিকবে তো? সংসার দেখবে কে?’ অনেকেই আবার মহা উৎসাহী হয়ে গবেষণা করতে বসে যান, কেন ঐ নারীর স্তন ক্যান্সার হলো, তার জীবন ধারায়, আচার-আচরণে কী কী ভুল ছিল, ইত্যাদি বিষয়ে। কাউকে কাউকে এমনও বলতে শোনা যায়, ‘ও যা বেড়ে গিয়েছিলো! ওর স্তন ক্যান্সার হবে না তো কার হবে?’ যেন এই এক সুযোগ, ঐ ক্যান্সার আক্রান্ত নারীকে এক হাত দেখে নেয়ার!

কিন্তু তাদের কতজন জানেন, অন্যান্য ক্যান্সারের মতোই স্তন ক্যান্সার হওয়ার জন্যও নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই? কতজন জানেন, অন্যান্য ক্যান্সারের মতোই স্তন ক্যান্সারও যেকোনো সময় যে কারও, এমনকি পুরুষদেরও হতে পারে? কতজন জানেন, একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারী কী অপরিসীম মানসিক এবং শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে প্রতিটি দিন পার করেন?

না, অনেকেই জানেন না, বা জানতে চান না, বা জানলেও মানতে চান না। আর সে কারণেই, অন্যান্য ক্যান্সারের রোগীদের তারা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করালেও, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ঠিকই দাঁড় করান।

এর একটি অন্যতম কারণ হলো, এদের অনেকেই প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে অথবা অবচেতন মনে নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবেই দেখেন। নারীর স্তন এবং যৌনতাকে আলাদা করে ভাবতে তারা শেখেননি। এদের চোখে একজন পুরুষ মানুষ পঙ্গু হয়ে বা প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও তিনি পুরুষ মানুষই থাকেন, কিন্তু একজন নারীর স্তন অপসারণ করা হলে, সেই নারী আর নারী থাকেন না, জড় পদার্থ হয়ে যান। আর তাই একজন নারী যখন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তখন তাকে মানসিকভাবে আঘাত করে, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে হেয় করে, তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগটি ঐ মানুষগুলো কোনোভাবেই হাত ছাড়া করেন না।

বিজ্ঞান কী বলে?

স্তন ক্যান্সারের নির্ণয় এবং চিকিৎসা একটি জীবন পরিবর্তনকারী ট্রমাটিক (traumatic) ঘটনা। যা কিনা প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টের সাথে সাথে, অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণা, যেমন রাগ, উদ্বেগ, হতাশা, অসহায়ত্ব, অনিদ্রা, মৃত্যু ভয় এবং এমনকি আত্মঘাতী চিন্তাভাবনারও সৃষ্টি করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রতি পাঁচ জন নারীর মধ্যে একজন কমপক্ষে দুই বছর পর্যন্ত বিষন্নতায় ভোগেন।

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, রোগীরা বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভুগতে পারেন, যেমন ক্লান্তি, হাড়-মাংসপেশী-জয়েন্টে ব্যথা, হাত ফুলে যাওয়া (lymphedema), হঠাৎ হঠাৎ গরম লাগা (hot flashes) এবং ঘেমে যাওয়া (night sweats), যোনিপথের শুষ্কতা, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি। প্রতিটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই আবার রোগীদের জীবন যাত্রার মান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা কিনা তাদের কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

এছাড়াও স্তন ক্যান্সার সার্ভাইভারদের (survivors) মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা, আত্মহত্যা, নিউরো-কগনিটিভ (neurocognitive) প্রতিবন্ধকতা (যেমন স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া, মুড পরিবর্তন হওয়া, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া) এবং সেক্সচুয়াল ডিসফাংকশনের (শারীরিক সম্পর্কে অনীহা, যোনিপথের শুষ্কতা ইত্যাদি) ঝুঁকি বাড়ারও জোড়ালো প্রমাণ রয়েছে।

একজন স্তন ক্যান্সারের রোগীর মানসিক জার্নি

যে কোনো স্তন ক্যান্সারের রোগীর জন্যই মানসিকভাবে সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটি বোধ হয় যখন ডাক্তার প্রথমবারের মতো তাকে বলেন যে তার ক্যান্সার হয়েছে। সেই মুহূর্তে এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে, অবিশ্বাস, রাগ, উদ্বেগ, হতাশা, মৃত্যুভয়সহ কত রকমের অনুভূতি যে জগদ্দল পাথরের মতো তার বুকের উপরে ভর করে, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন।

সাথে যোগ হয়, স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া। এ যেন সজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় নিজের শরীরকে কেটে-ছিঁড়ে, বিষাক্ত পদার্থে পূর্ণ করে চিরদিনের মতো বিকৃত করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া।

তারপর এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতোই শুরু হয়, বিভিন্ন রকম নির্মম চিকিৎসা – অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি – নেয়া। টানা এক-দেড় বছরের এই দুঃস্বপ্ন শেষে যদি তার ঘুম ভাঙেও, উঠে সে আর নিজেকে চিনতে পারে না। কারণ ততদিনে সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে এক অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

তবুও নিস্তার পায় না সে। শুরু হয় আরেক দুঃস্বপ্ন। প্রতিনিয়ত বসবাস করতে হয় বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সাথে, বিষন্নতার সাথে, এক গভীর ভয়ের সাথে এই বুঝি ক্যান্সার আবার পেছন থেকে আঘাত হানলো। কর্ম জীবনে, সামাজিক জীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং ঘনিষ্ট সম্পর্কে অপূর্ণতা এবং অনিশ্চয়তার সাথেও করতে হয় তাকে নিত্য সমঝোতা।

মানসিক সুস্থতা রক্ষায় কী করতে পারেন?

  • অনুভূতিগুলো দমানোর চেষ্টা না করে অনুভব করুন – আপনার ক্ষতির জন্য, কষ্টের জন্য শোক করার অধিকার আপনার রয়েছে। এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার জন্য এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
  • কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি ফুরিয়ে যাননি। একজন ক্যান্সার রোগী বা ক্যান্সার সার্ভাইভার – এই পরিচয়ের বাইরেও আপনার অন্য পরিচয় আছে। সেটিকে আবার সামনে নিয়ে আসুন।
  • আপনি আপনার নিজেকে মূল্য না দিলে অন্যরাও দেবে না। তাই নিজেকে করুণা করা বন্ধ করুন, এবং নিজের যত্ন নিন। ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে ভালো থাকার চেষ্টা করুন।
  • আপনার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোকে উপশম করার জন্য অনেকগুলো বিকল্প আছে, যেমন প্রেসক্রিপশন ওষুধ, কাউন্সেলিং, ম্যাসাজ, মেডিটেশন, সাইকোথেরাপি, ফিজিও থেরাপি। এগুলোর ব্যবহার করুন। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
  • ক্যান্সার ফিরে আসার (recurrence) ভয় স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। শরীরের যে কোনো অংশে ব্যথা করলেই, হাত দিয়ে নতুন কিছু অনুভব করলেই, আপনার মনে হতে পারে ‘আমার ক্যান্সার কি ফিরে এসেছে?’ আপনার ভয় কমাতে এবং নিশ্চিন্ত হতে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
  • মনে রাখবেন, আপনি একা নন। আপনার মতো আরও অনেকেই এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভব হলে কোনো স্তন ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দিন। অন্য রোগীদের সাথে আপনার অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। তাদের কথাও শুনুন, তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করুন। দেখবেন অনেক হালকা লাগবে।
  • আপনার স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ আপনার নিজের হাতে নিন। ভবিষ্যতে আপনার কী কী পরীক্ষা, এবং কত দিন পর পর করতে হবে, তার একটি লিখিত ফলো-আপ কেয়ার প্ল্যান আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়ে রাখুন।
  • মাসে একবার করে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করুন। ডাক্তারের কাছে শুনে নিন, কী কী নতুন লক্ষণ উপসর্গ হলে আপনাকে তাঁর কাছে যেতে হবে।
  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার চেষ্টা করুন – পুষ্টিকর খাবার খান, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, শারীরিক একটিভিটি (activity) করুন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান।
  • সবার জন্য অনেক করেছেন, এখন নিজের জন্য বাঁচুন। সাজুন, বই পড়ুন, গান শুনুন, ছবি আঁকুন, ঘুরে বেড়ান, লিখুন, অন্যদের সাহায্য করার চেষ্টা করুন। মোট কথা আপনার যেটি করতে ভালো লাগে, সেটিই করুন।

মনে রাখবেন, আপনার মানসিক সুস্থতা, আপনার জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে যারা মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেন, তাদের স্তন ক্যান্সার ফিরে আসার (recurrence) এবং স্তন ক্যান্সারে মৃত্যু হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

ডাক্তার মনিকা বেগ
প্রধান
 এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ক (অবসরপ্রাপ্ত),
এইচআইভি/এইডস সেকশন,
জাতিসংঘ সদর দপ্তর,
ভিয়েনাঅস্ট্রিয়া। 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.