চামেলীবাগ হত্যাকাণ্ড: আসুন, ওদের বুকে টেনে নিই

Police killedউম্মে মুসলিমা: ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে…
গোলাপের দিকে চেয়ে বললাম, সুন্দর
সুন্দর হলো সে’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পরিণত বয়সে এসে আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবন ভুলে যাই। কিছুদিন আগে একদিন সন্ধ্যায় ইডেন কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম এক সহকর্মীর সঙ্গে। ফুটপাতের ওপর বসে থাকা জোড়া জোড়া তরুণ-তরুণীর সন্নিবেশ দেখে সহকর্মী প্রায় মারমুখী। পারলে মেয়েদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে হোস্টেলে ঢুকিয়ে দেন আর ছেলেগুলোকে এক হাত নেন। ‘গেল, যুবসমাজ রসাতলে গেল, পরিবেশ পুরাই দূষণ করে দিল’—বলে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে উদ্যোগী হন। অথচ তিনি জানতেন না যে ইউনিভার্সিটিতে তাঁর কীর্তির (রাতের আঁধারে কীভাবে যেন মেয়েদের হলে ঢুকেছিলেন, মেয়েরা দেখে ফেলে ুপিটুনি দিয়েছিল) খবর আমার মতো অনেকেই রাখে।

তো বয়সের স্বধর্মে তরুণেরা যেমন অস্থির, তেমনি পরিণতরা স্থিতধী। কিন্তু অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে গেলেই দুঃসাহসে মেয়েদের সংরক্ষিত দেয়াল টপকাতে ইচ্ছে করে। এ কাজ সবাই তো করে না। অল্প কিছুসংখ্যক। তেমনি মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যাও কম। কিন্তু এ কমসংখ্যক তরুণ নিজেরা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, পরিবার ধ্বংস করছে, বন্ধুদের প্রলোভিত করছে, প্রতিবেশ দূষণ করছে, শেষমেশ মা-বাবাকে হত্যা করছে।

এরা কারা? নিঃসংকোচে বলতে পারি এরা ওরাই, যারা মা-বাবা, ভাইবোন, স্বজনদের বন্ধু হিসেবে পায়নি। কিশোর-তরুণদের অনেক কৌতূহল, অনেক প্রশ্ন, অনেক সংকোচ, অনেক ভুল বোঝা। এসব নিয়ে ওরা কার কাছে যাবে? বন্ধুদের? ওরা তো একই বয়সের। শিক্ষকের? ওরে বাবা! মেরে ফেলবে। তাহলে মা-বাবা? ছিঃ সব প্রশ্ন কি ওদের করা যায়? ব্যস, নিজে নিজে উল্টোপাল্টা সমাধান। ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে একমুঠো সিদ্ধি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘নে, চিবো, চিবিয়ে গিলে ফেল।’ শ্রীকান্ত ভয় পেয়েছিল। আবার সেই ইন্দ্রনাথই তাকে মানবিকতার প্রথম পাঠ দিয়েছিল। সে রকম বন্ধু মেলা ভার। ভরসা মা-বাবা।

ঐশীর সঙ্গে তার মা-বাবার যে সম্পর্ক ছিল, সে রকম সম্পর্ক অনেক ছেলেমেয়েরই। কেউ কেউ মায়ের সঙ্গে একটু সহজ, বাবাকে এড়িয়ে চলে। অল্পসংখ্যক বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, মাকে পাত্তা দেয় না। ঐশীর কারোর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সে খুঁজে নিয়েছিল বাইরের বন্ধু। মাঝেমধ্যে নাকি তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হতো।

একজন মাকে জানি, তাঁর একটিই মেয়ে। বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক প্রায় দা-কুমড়ো। মেয়েটির প্রেম হয় পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে। বাবা বিন্দু-বিসর্গ জানেন না। মা সবই বুঝতে পারেন। কিছুদিন পর মা লক্ষ করেন মেয়ের অস্থিরতা। মেয়ে রাতে কাঁদে। গভীর রাতে মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখেন, টেবিলে সুইসাইড নোট। বিছানায় উপুড় হয়ে সে ফোঁপাচ্ছে। এর আগে কোনো দিন মা মেয়ের প্রেম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেননি। সুইসাইড নোট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মেয়ে ইচ্ছেমতো প্রাণভরে কাঁদল। ছেলেটি তাকে প্রতারিত করেছে। মা পর পর চার রাত মেয়েকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকলেন। সব শুনলেন। সান্ত্বনায় সিক্ত করলেন। বললেন, ‘জীবন অনেক বড়, সোনা। তুমি অনেক মিষ্টি আর সহনশীল একটা মেয়ে। উচ্চশিক্ষার জীবনে আরও অনেক উজ্জ্বল ছেলের সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে। তখন পরিণত চোখে মানুষ চিনতে আর ভুল হবে না। যে প্রতারণা করেছে সমস্যা তার, অসততা তার। তুমি নিজের কাছে সৎ আছ। এ তোমার হেরে যাওয়া নয়, বরং অন্য কোনো বড় দুর্ঘটনা থেকে তুমি বেঁচে গেছ বলে খুশি হও। আমরা অনেক দিন পার করে এসেছি, অনেক অভিজ্ঞতা, তোমার সবকিছু আমাকে জানিয়ো। তোমার আবেগ আর আমার যুক্তি দিয়ে সঠিকটাকে চিনে নিতে সচেষ্ট হব।’ সেই মেয়েটি বড় হয়ে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করে সে এখন পরিপূর্ণ সুখী একজন মানুষ। সেদিনের সেই কালরাতে মা যদি মেয়েটিকে বুকে টেনে না নিয়ে রেগে-মেগে বাবাকে বলে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড শুরু করে দিতেন, তাহলে কে জানে আত্মহননই হয়তো মেয়েটির শেষ আশ্রয় হতো।

যেসব কিশোর-তরুণ মাদক নেয়, বিপথে চলে তাদের আমরা ঘৃণাভরে দূরে ঠেলে দিই, মারধর করি, আটকে রাখি, অন্যদের সামনে অপমানিত করি। মনে রাখতে হবে, ওরা যে বিপথগামী, তার জন্য বেশির ভাগই দায়ী আমরা মা-বাবা-স্বজনেরা। ‘ঐশীদের জন্য আমরা কী করতে পারি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ডা. মো. তাজুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, ‘আপনার সন্তানকে স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত রাখুন, তবে সব বিষয়ে অবাধ স্বাধীনতা বা প্রশ্রয় দেবেন না। প্রকাশ্যে প্রশংসা করুন, সবার সামনে অপমানিত করবেন না।’ নিজের সন্তানকে শত্রু ভেবে দূরে ঠেলে দিলে সন্তান বা আমাদের কারোরই লাভ হবে না। জানবেন, ওরা ফুলের মতো নিষ্পাপ। প্রশংসার কাঙাল। কিন্তু আমাদের ঘৃণায় ওরা নিজেদের হীন ভাবতে ভাবতে একসময় দুর্বিনীত হয়ে পড়ে। আসুন, গোলাপকে সুন্দর বলি। দেখবেন শুধু সৌন্দর্যেই নয়, সুগন্ধেও তারা আমাদের কেমন আমোদিত করে!

(লেখাটি প্রথম আলো থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.