কাজী তামান্না কেয়া:
(লেখাটিতে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসঙ্গ আছে। কারও আপত্তি থাকলে দয়া করে পড়বেন না)
সারা পৃথিবীতেই রাজনীতিবিদ এবং সেলেব্রেটিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে বা অংশগ্রহণ করে এবং আপনিও সম্প্রতি কলকাতার একটি পূজামণ্ডপের পাশে আরেকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যদিও পত্রিকাগুলো বলছে আপনি পূজামণ্ডপে উপস্থিত ছিলেন। সে যাই হোক, মণ্ডপে উপস্থিত থাকেন কিংবা মণ্ডপের পাশে, সেলিব্রেটি হিসেবে তো বটেই, আমি মনে করি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবেও আপনি ভুল কিছু করেননি। ভুল বা অপরাধ না করেও একজন উগ্র মৌলবাদীর কাছে আপনি নতি স্বীকার করবেন, এটা আমরা আশা করিনি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে আপনি ঝামেলা এড়াতে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু জনাব সাকিব আল হাসান, অতীত ইতিহাস থেকে আমরা জানি, মৌলবাদের কাছে হার মানলে মৌলবাদ কমে না, বরং বাড়ে।
জনাব সাকিব, আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলা হয়। বাংলাদেশের এই একটি মেলাকে আমরা বলি, ‘আমাদের প্রাণের মেলা’ । আপনি কি জানেন প্রাণের মেলায় নারীদের সাথে প্রায়শই কি হয়? সেখানে ওঁত পেতে থাকা অসংখ্য পুরুষের এবং ধর্মীয় লেবাসধারী হাত আমাদের শরীর খামচে ধরতে চায়। একথা আপনি তসলিমা নাসরিনের লেখা থেকে জানতে পারবেন, এবং আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি বেশ কয়েক বার। সন্ধ্যা নামলে বা ভীড় বাড়লে বই দেখার উছিলায় যারা পিছনে এসে শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়েছি। অনেকের চেহারা, পোশাকেই ধর্মটা লেখা ছিল, এবং কেউ কেউ সাধারণ পোশাকেও ছিল।
শুধু বইমেলায় না, রাস্তাঘাটেও এইসব মানুষের নোংরা মন্তব্যের বা বাজে স্পর্শের শিকার নারীরা হরহামেশাই হয়। আপনি যদি বইমেলায় বা রাস্তাঘাটে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া এই নোংরা ঘটনাটি না জানেন, তবে ঐ মৌলবাদী সুরতের লোকদের আপনি মেলার সাধারণ দর্শণার্থী বলে ভুল করবেন। যারা নারীদের সাথে এই কাজটি করে, তাদের আসলে কোন বিশেষ পোশাকের দরকার না পড়লেও অনেকের পরনেই দেখা যায়। এই যেমন আপনাকে হুমকি দেওয়া লোকটাও হালকা ছাঁটের দাড়ি মুখে এবং টুপি পরা ছিল। যদিও সে মূল হুমকি এবং গালিগালাজের সময় টুপিটা খুলেই নিয়েছিল।
একটা বিষয় ক্লিয়ার করে বলতে চাই, দাঁড়ি টুপিতে সমস্যা নেই। সমস্যা এই পোশাক পরে উগ্রতায়, জোর করায়, বাধ্য করায়, হুমকিতে, অত্যাচারে এবং হত্যায়।
গত বিশ-ত্রিশ বছরে বইমেলায় ধর্মীয় মৌলবাদীদের এই আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কয়েক বছর আগে মেলার পরিসর একটু বড় করা হয়, মেলার অবকাঠামো যেমন আলোর ব্যবস্থা, ওয়াইফাই.. এইসব সুবিধা বাড়ানো হয়। এসব কারণে মৌলাবাদীদের উপদ্রব একটু কমে হয়তো উনিশ-বিশ হয়েছে। সেটা সুযোগের অভাবে সৎ হওয়ার মতন ব্যাপার। কিন্তু নারী শরীরে অযাচিত স্পর্শ বন্ধ হয় নাই। ২০০৭-২০০৮ এর দিকে মেলার গেইটে পুলিশি পাহারা শুরু হয়। বিশাল লম্বা লাইন ধরে, হাত ব্যাগ চেক করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে তবেই ঢোকা যেত ভেতরে। তবে সেই পুলিশি পাহারা ছিল জঙ্গি হামলা ঠেকাতে, নারীদের উত্যক্তকারীদের দমন করতে নয়। অর্থাৎ সর্বক্ষণ পুলিশের পাহারা থাকা সত্ত্বেও নারী নিপীড়কদের হাত থেকে নারীদের রেহাই পাওয়া সম্ভব হতো না, কারণ এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় না করলে এই সমস্যাটি কখনও কমে না, বরং বাড়ে।
আপনি যদি এই লিখাটি পড়ে থাকেন, তবে হয়তো ভাবছেন, বইমেলার সাথে কিংবা নারীদের উত্যক্ত করার সাথে আপনাকে হুমকি দেওয়ার সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে জনাব! মৌলবাদ কখনও নারীদের ছাড় দেয় না! আপনার স্ত্রী শিশিরকে, এমনকি আপনার মেয়েকেও দেয় না। দিনে দিনেই ওরা বেড়েছে। তাই মৌলবাদের প্রসংগ এলে সেখানে নারীদের কথা এসেই যায়।
২০১৩ সাল শাহবাগ আন্দোলনের পরপরই মৌলাবাদীরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে এবং তাদের টার্গেট হয় লেখালিখি জগতের মানুষ। তারা ধরে ধরে লেখক-প্রকাশক ব্লগারদের হত্যা করতে শুরু করে। মৌলবাদীদের অত্যাচারে লেখক প্রকাশক তো বটেই, যারা একটিভিস্ট এবং ফেইসবুকে দু এক কথা লিখতো, মৌলবাদীরা তাদেরকেও নিয়মিত বিরতিতে হুমকি দিতে থাকে এবং হত্যা করতে শুরু করে। শুনতে হয়তো খারাপ লাগছে, তবে নির্মম সত্য হলো ধর্মীয় মৌলবাদ অত্যন্ত নিষ্ঠুর।
মৌলবাদীদের হাতে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়ে যায় ২০১৫ সালে। আমরা হারাই মুক্তচিন্তার বাতিঘর ডক্টর অভিজিৎ রায়কে। মেলা প্রাঙ্গণেই মৌলবাদীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে রেখে যায়। হত্যাকারীরা কোন পোশাকে ছিল সেটা বড় নয়, কারণ মৌলবাদ ছিল তাদের মগজে এবং অন্তরে। এর পরপরই জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপনকে হত্যা, শুদ্ধস্বরের টুটুল এবং আরও দুজনকে মৌলবাদীরা কুপিয়ে রেখে যায়। এছাড়া নিলয় নীল, আশিকুর বাবু, জুলহাজ মান্নানসহ আরো কয়েকজন ব্লগার এবং এক্টিভিস্টকে কুপিয়ে হত্যা করে। অথচ এই ব্লগার একটিভিস্টরাও কিন্তু আপনার মতx কোন অপরাধ করেনি। তারা শুধু তাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার চর্চা করেছিল। আপনি যেমন স্বাধীনভাবে চলাচল করার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করে মৌলবাদীদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন, তারাও একই একই গোষ্ঠির নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে গিয়ে। এই দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দুর্ভাগ্য কি জানেন? তাদের জীবনের মূল্যেও মৌলবাদের কালো থাবা সমাজ থেকে এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে। কেন কমেনি সেই কারণটা বলছি বইমেলার ব্যাপারে মৌলবাদীদের আচরণের আরও কিছু অন্ধকার দিকের কথা প্রকাশ করে।
বইমেলা এবং লেখালেখির উপর মৌলাবাদীদের দ্বারা আক্রোশ অভিজিৎ রায়কে খুন করার পরেও থামেনি। বরং সেই একই অন্ধকারের শক্তি ঠিক করে দিতে শুরু করলো কোন বই বিক্রি করা যাবে আর কোন বই যাবে না, কোন স্টল বইমেলায় থাকবে আর কোন স্টল থাকবে না। এই তালিকায় প্রথমেই উঠে এলো অভিজিৎ রায়ের লেখা প্রকাশ হতো এমন সব প্রগতিশীল প্রকাশনী। রোদেলা প্রকাশনী, জাগৃতি প্রকাশনীসহ কমপক্ষে তিনটি প্রকাশনীর স্টলকে বইমেলা থেকে উঠিয়ে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা ঠিক সেখানেও থেমে থাকলো না। অভিজিৎ রায়ের বই অনলাইনে বিক্রি করা যাবে না, সেই মর্মে ভয় দেখানো হলো রকমারী ডট কমের মালিককে। তুলে নেয়া হলো অভিজিতের বই রকমারী ডট কম থেকে। এভাবে বইমেলার উপর মৌলবাদীদের অত্যাচার ক্রমে বাড়তে লাগলো এবং তাদের একের পর এক আবদারের মুখে বাংলা একাডেমীর বইমেলা হয়ে গেল কিতাব মেলা। প্রগতিশীল বইয়ের অভাবে সেখানে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় এক নাম্বারে নাম উঠলো প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ নামক ফ্যালাসি বা কুযুক্তিপূর্ণ একটি বই। মৌলবাদীরা নারী শরীরে হাত দেওয়ার মাধ্যমে তাদের নোংরামি শুরু করেছিল, তার শেষ হতে যাচ্ছে বইমেলা ব্যাপারটাকে গিলে খাওয়ার মাধ্যমে। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে তারা বহু আগে থেকেই মূর্তিপুজা বা বিদআত বলে, এখন যদি তারা বইমেলাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানায়, আমি এতোটুকু অবাক হবো না। কারণ এটাই ধর্মীয় মৌলবাদের প্রকৃত রুপ।
মৌলাবাদের আস্ফালন শুধু বইমেলা কেন্দ্রিক নয়। বরং সৃষ্টিশীল যে কোন লেখাতেই তাদের আপত্তি। আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি লেখালেখি করার অপরাধে (!) হুমায়ূন আজাদকে কোপানো হয়েছিল এবং তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। সরকার কিন্তু মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লেখিকাকে নিরাপত্তা দেয়নি, বরং আপনার মতোই তাদের দাবির কাছে নতজানু হয়েছিল। সেই থেকে সরকারকে বারবার নতজানু হতেই হচ্ছে মোল্লাদের কাছে।
মৌলবাদীরা আজ খোদ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নদীতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। এর শুরুটা হয়েছিল ঢাকা এয়ারপোর্টের সামনে লালন ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে এবং হাইকোর্টের সামনে জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য অপসারণের দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ একটার পর একটা দাবি পূরণ করেও মৌলাবাদীদের চাহিদা মেটানো যায়নি, দিনকে দিন তা কেবল জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। অন্ধকারের এই অশুভ শক্তি বাংলার মাটিতে বারবার জন্ম নিয়েছে, কারণ এই শিকড় উৎপাটন করতে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং আপনার মতো বড় মাপের ব্যক্তিরা বারবার এই অপশক্তির কাছে মাথা নত করেছে।
জনাব সাকিব, মৌলবাদীদের শিকার আজ বা এই প্রথম আপনি হননি। আপনার স্ত্রীকে পর্দা করার উপদেশ, পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের মতো মাঠে সিজদা দেওয়ার উপদেশ ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আপনাকে অনেকদিন ধরেই দিয়ে আসছে। আপনি আজ বহুদিন ধরে উগ্রবাদীদের সেসব উপদেশকে গোনায় না ধরে স্বাকীয়তা বজায় রেখে খেলে গেছেন এবং ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনতার চর্চা করেছেন। আপনার সাহস এবং স্বকীয়তাকে আমরা প্রশংসা করি। শুধু অলরাউন্ডার সাকিবের কাছে ভালো খেলার প্রত্যাশা নয়, ব্যক্তি সাকিবের কাছেও একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ নির্মাণে অংশগ্রহণ করার প্রত্যাশা আমরা রাখি। আপনার কাছে তাই আমার অনুরোধ, আপনি প্লিজ আর কখনও মৌলবাদের কাছে নতজানু হবেন না, কারণ আপনি হেরে গেলে হেরে যায় বাংলাদেশ। আপনি হেরে গেলে জিতে যায় অন্ধকারের শক্তি!