শামীম আরা নীপা:
বাংলা সাহিত্যের গল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতায় নারীকে কী হিসেবে চিত্রিত করেছেন কবি সাহিত্যিকরা? এই গল্প/সাহিত্য পড়ে আপনার/আমার মস্তিষ্কে কী ধরনের চিত্র-কল্পনা তৈরি হয়- এটি একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
আমাদের বিজ্ঞাপনে, নাটক, টেলিফিল্ম, ছায়াছবি, শিল্পকলা একাডেমি, চারুকলা, ললিতকলা, মিডিয়ায় নারীকে ভোগ-বিলাসের সামগ্রী অথবা ভোগ্যপণ্য, কামনার প্রতিমা রূপে উপস্থাপন করে- সেখান থেকে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠার কোনরুপ আশা কি করা যায়?
আমাদের রোমান্টিকতার ধারণা তৈরি হয়েছে অনিচ্ছুক নারীর পেছনে পুরুষের জোরপূর্বক অনুসরণের দৃশ্যসহ ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’–জাতীয় গানের মাধ্যমে এবং লুঙ্গির কমার্শিয়ালে বাথটবে শায়িত নারী শরীরের মাধ্যমে। এভাবেই কি নারীকে মহিমান্বিত করছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ?
ধর্ষণের শিকার নারীর পরিচয় প্রকাশ না করলেও পত্রিকায় দেখা যায় ষোড়শী, যুবতী, কিশোরী ইত্যাদি বলে তার বয়সকে বোঝানো হয়, এবং আশেপাশের জায়গার নাম বলে তার ঠিকানা প্রায় বলেই দেয়া হয় কোন সম্মানের খাতিরে?
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ধর্ষণের দৃশ্য বাণিজ্যিক ও উপভোগ্য। চলচ্চিত্রে ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্ষণের শিকার নারীকে দিয়ে স্বীকার করায় যে সে কতোটা অচ্ছুৎ এবং তার আত্মহত্যা বা হত্যা দেখানোর মাধ্যমে সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীকে অবাঞ্ছিত প্রতিপন্ন করে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায়কে গোপন করে, বরং সেই নারীকে উদ্ধারের জন্য পুরুষকেই মহানুভবতার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। নারীকে মর্ষকামী প্রমাণ করতে পারলে পুরুষের ধর্ষণকে জায়েজ করে তোলা যায়। সাহিত্যের পাতা থেকে শুরু করে সিনেমার পর্দা পর্যন্ত সেই চেষ্টার কমতি নাই কোথাও।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, চলচ্চিত্রে নারীকে ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে ধর্ষণ করার উৎসাহ যোগান, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, ১৮ প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন, যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবার বহুল প্রসার ইত্যাদি কারণে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই ইন্টারনেটের যুগে পর্নোগ্রাফি ও যৌনবৃত্তি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতের মুঠোয়। পর্নোগ্রাফিতে পুরো জগত ছেয়ে গেছে। যৌনবৃত্তি যৌনতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। পর্নোগ্রাফি ও যৌনবৃত্তি- দুটোই যৌনতা নিয়ে ব্যবসা করে। পুরুষই প্রধানত পর্নোগ্রাফি ও যৌনবৃত্তির ক্রেতা ও ভোক্তা। পর্নোগ্রাফি ও যৌনবৃত্তির কাজে নারীকেই ব্যবহার করা হয় নারী শরীর উপস্থাপনের মাধ্যমে। নারীর যৌনপেশা গ্রহণের মূল কারণ দারিদ্র্য এবং ধর্ষণের মতো মর্মান্তিক ঘটনাগুলো। যৌনবৃত্তি বাংলাদেশে পেশা হিসেবেও স্বীকৃত নয়, যার জন্য নারীকে এক্ষেত্রেও নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর মধ্য দিয়ে নারী পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, নির্যাতন, অবদমন, শোষণের শিকার হয়।
পর্নোগ্রাফি পুরুষতন্ত্রের আরেক আধিপত্যবাদ। পুরুষের যৌন কামনার বিকৃত প্রকাশ হিসেবেই পশ্চিমা বুর্জোয়া রাষ্ট্রে পর্নোগ্রাফির আবির্ভাব ঘটে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে যৌনসামগ্রী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না বলেই নারীকে নিরুপায় করে অর্থের লালসা দিয়ে এ পথে টেনে আনে। পর্নোগ্রাফি ও যৌনবৃত্তি এই দুই-ই যৌনতার সাথে যুক্ত, উভয়ের উৎস আমাদের বর্তমান এই সমাজ কাঠামো।
এরপর আসি মাদকের কথায়। বাংলাদেশ ছেয়ে গেছে মাদকের নেশায়। মাদক এতো সহজলভ্য যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই মাদকের কবলে পরে সকল মূল্যবোধ ও হিতাহিত জ্ঞান হারাচ্ছে। মাদক সাময়িক যৌন উত্তেজনা ঘটায়, আচরণে পরিবর্তন আনে। তখন মানুষ নরপশু হয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়। মাদকাসক্তরা একপর্যায়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়, যার ফলে অনেকে যৌন সম্পর্কের পর নারীকে গলাটিপে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলতে পারে।
আবার মানবিকবোধ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে সুবিধাবাদীরা। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে অবরুদ্ধ হয়ে যায় বিবেক, যার ফলে মাদকাসক্ত ব্যক্তির দ্বারা যেকোনো ধরনের অপরাধ মুহূর্তের মধ্যেই সংঘটিত হয়ে যায় কোন অনুশোচনা ছাড়াই। কন্যা ঐশী কর্তৃক পুলিশ দম্পতি হত্যা, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড, বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ধর্ষণসহ সারাদেশে বহু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আসামীরাও মাদকাসক্ত ছিলেন মর্মে প্রকাশিত সংবাদ ও পুলিশের মাধ্যমে জানা যায়। শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণই নয়, চুরি, ছিনতাই, পারিবারিক অশান্তিসহ বহু অপরাধের মূলে এই মাদক।
তাহলে ধর্ষণের পিছনে মূল কারণ কী কী পাচ্ছি আমরা? ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, নারীকে হীন করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, নারীর প্রতি আমাদের গতানুগতিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা, নারীর জন্য তৈরি হওয়া নীতিমালা, পর্নোগ্রাফি, মাদক ইত্যাদি।
অপরাধবিজ্ঞানের একাডেমিক আলোচনায় ট্রাভিস হারসি সোশ্যাল বন্ডিং তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন, পরিবারে বাবা-মায়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়া, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো, পড়াশোনার পাশপাশি সহ শিক্ষা পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সমাজ এবং রাষ্ট্রের রীতি-নীতি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের যে কোন ধরনের প্রথা ও নীতি বিরুদ্ধ কাজকর্ম থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে থাকে।
ধর্ষণের পেছনে কিছু কৌশল থাকে, পরিবেশ- পরিস্থিতি- সময়- স্থান থাকে যা প্রায় পুরুষের মনেই একান্তভাবে কাজ করে। এই কৌশল তৈরি হয় পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত জিন ও চর্চার মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত বিকৃতি ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। ধর্ষণের কৌশল ধর্ষকের মানসিকতার উপর নির্ভর করে অনেকটা, যেমন-
সুবিধাবঞ্চিত পুরুষ: যৌনলালসা মিটাতে যার কাছে ধর্ষণ একটা অবলম্বন,
বিশেষায়িত ধর্ষক: আগ্রাসী যৌনকর্মের মাধ্যমে যারা যৌন উত্তেজনা পায়,
সুযোগসন্ধানী ধর্ষক: সবদিক বিবেচনা করে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই বুঝে তারা ধর্ষণ করে,
মিলনের তীব্র চাহিদাসম্পন্ন পুরুষ: এরা কর্তৃত্বপরায়ণ এবং মনোবিকারগ্রস্ত – কুর্মিটোলায় ফুটপাত ধরে হাঁটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে টেনে হিঁচড়ে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু, ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে ফেইসবুকে সেই স্ট্যাটাস দেয়া, ধর্ষণ করে তার ভিডিও ভাইরাল করে দেয়া, মাদ্রাসায় ছেলে শিশুদের ধর্ষণ।
ক্ষমতার চর্চাকারী পুরুষ: এরা ভেবে নেয় ক্ষমতার জোরে যা ইচ্ছা করবে এবং কোন বিচার হবে না- বেগমগঞ্জে নারীকে যৌন নিপীড়ন করে তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়া।
পুরুষ নারীর শরীর চাইছে, কারণ সে ভাবে ওটা তার পাওনা, নারীর এতো সাহস যে পুরুষকে চাওয়ামাত্র নিজের শরীর দিচ্ছে না সেই রাগেই পুরুষ ধর্ষণের মাধ্যমে সেই শরীর ছিনিয়ে নেয়! চাওয়ামাত্র নারী শরীর দিয়ে বাধ্য থাকলো না, জোর করে কেড়ে নিতে হলো, সেই রাগেই পুরুষ নারীকে প্রহার করলো ইচ্ছামতো, তারপর হত্যা করে ফেললো, কিংবা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো!
বাধা পেয়েই শুধু রাগ হবে তা না, বরং নারী ভালো চাকরি পাচ্ছে, পুরুষ চাকরি পাচ্ছে না- এই হতাশা থেকে রেগে গিয়েও পুরুষ ধর্ষণ করে।
পুরুষ হাজার চেষ্টা করেও প্রেমিকা জুটাতে পারে না, অথচ নারী প্রেম করছে, কিংবা পুরুষ বন্ধু নিয়ে ঘুরছে দেখে পুরুষের রাগ হয়ে যায়, পুরুষ ধর্ষণ করে। নারীটিকে উত্যক্ত করে, আর তার প্রতিবাদী পুরুষ বন্ধুকে মারধোর করে।
সিনেমা কিংবা পর্নোগ্রাফিতে সুন্দরী নায়িকাদের দেখে দেখে পুরুষের মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং সে কোনো নারী-সান্নিধ্য না পাওয়ার হতাশায় রাগে ধর্ষণ করে।
পুরুষের রাগের আর একটা কারণ ‘বিপন্ন পৌরুষ’ – অনেকের মতে, নারীর সাথে যৌনতার সম্পর্ক না থাকলে তার পৌরুষই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সে ভাবে, মেয়েদের শরীর চাইলেই পাওয়া যায় যেখানে, সেখানে তার কেন কারও সাথে যৌন সম্পর্ক নাই! সুতরাং পৌরুষ ও পুরুষাঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য পুরুষ ধর্ষণ করে।
(চলবে)
বিঃদ্রঃ এই লেখাটা তৈরি করতে গিয়ে আমি প্রায় ৩৫ টার মতো নিউজ লিঙ্ক পড়েছি, কিছু পিডিএফ, কিছু বই আগেই পড়া ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে এই লেখাটা দাঁড়িয়েছে। এই লেখার ভেতর কোট না করেই আমি এমন অনেক কিছু অ্যাজ ইট ইজ যুক্ত করেছি, কারণ তার থেকে ভালো শব্দ সংযোজন আমি করতে পারিনি এবং রেফারেন্স ও ক্রেডিট দিতে পারছি না, কারণ যখন পড়েছি তখন কিছু নোট নিয়েছি। কিন্তু লেখার লিঙ্ক আর রাখিনি, লেখকের নামও মনে থাকার কথা না। তাই এই লেখা আমার একক লেখা না। আমার ইনপুটের সাথে এখানে অনেক মানুষের ইনপুটও আছে। সবার জন্য কোন স্বত্ব ছাড়াই এই লেখাটি উন্মুক্ত।
আগের পর্বটির লিংক:
https://womenchapter.com/views/36339