ধর্ষক নির্মাণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-১

শামীম আরা নীপা:

বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষ মূলত তিনটি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত, ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। ‘ইড’এর কোনও মানবিক দিক বা বিকাশ নেই। এর পুরোটাই মানুষ কিংবা পশুর লোভ-লালসা আর কাম চিন্তায় ভরপুর। ‘ইড’ মানুষের ভিতরের এক প্রকার সুপ্ত পশু, যার প্ররোচনায় মানুষ যেকোনো অসামাজিক, অনৈতিক, অপরাধ থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের মতন বর্বর কর্মকাণ্ড করতেও দ্বিধাবোধ করে না। ‘ইগো’র কাজ হচ্ছে ‘ইড’ এর কাজগুলোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাস্তবায়ন করা, সেদিকে মানুষকে প্ররোচিত করা। ‘সুপার ইগো’ হচ্ছে মানুষের বিবেক। ‘সুপার ইগো’ মানুষকে সবসময় মানবিক হতে সাহায্য করে, ভালো কাজ করতে উদ্দীপ্ত করে। যদিও সুপার ইগোর প্রতি অবিচল থাকা নির্ভর করে ব্যক্তির নৈতিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের উপর।

ধর্ষণকারীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেক দিন গবেষণা করছেন ডেভিড লিজাক। ২০০৩-এ মার্কিন বিমান বাহিনীর মধ্যে একটা যৌন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকে মার্কিন এয়ারফোর্স একাডেমিতে পরামর্শদাতা হিসেবে আছেন। তিনি তার কেস-স্টাডিতে বলছেন, যৌন নির্যাতনের ঘটনার পিছনে ক্ষমতা জাহির করার পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার কাজ করে- রাগ। ধর্ষণকারী কোনও ভয়ানক অন্ধ, উৎকট রাগের উত্তেজনায় কিছু একটা ঘটিয়ে ফেললো, এমন যে হয় না, তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই রাগটা আসে অন্যান্য জায়গা থেকে।

ক্ষমতা, আধিপত্য বিস্তার, রাগ, বিপন্নতা, হঠাৎ যৌন উত্তেজনা কিংবা ‘জাস্ট মাস্তি’ ধর্ষকের মগজে যে কারণটাই থাকুক, ডেভিড লিজাকের বিশ্বাস, যে লোকটা বা লোকগুলো ধর্ষণ করে, তারা আসলে মেয়েদের ঘৃণা করে- চিড়বিড়ে, ধ্বংসাত্মক, আগ্রাসী সেই ঘৃণা। এই ঘৃণার জন্ম শৈশবে নিজ পরিবারের মাধ্যমে। বাবার হাতে মায়ের রোজ মার খাওয়া, পুরুষ আত্মীয়স্বজনের হুঙ্কারে, তোড়জোরে তাদের নারীদের ভয় পেয়ে নিজেদের গুটিয়ে রাখা, পাড়ার বড়ভাইদের দেখে মেয়েদের উত্যক্ত করতে, মেয়েদের যৌনসামগ্রীর মতো ভাবতে দেখা, স্কুলের বন্ধুরা মিলে গোবেচারা কোন মেয়ে বন্ধুকে উত্যক্ত করে কাঁদায় – এসব দেখে দেখে শৈশব থেকেই একটা ছেলে শিশু পুরুষতন্ত্রের অভিশাপের শিকার হয়ে নারীর প্রতি একটা তাচ্ছিল্য ভরা ঘৃণার মনোভাব নিয়ে বড় হয়।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলতে বোঝায় যেখানে পরিবারের দায়িত্ব থাকে একজন নারীর উপর এবং বংশের ধারাও নির্ধারিত হয় নারীর দিক থেকে৷ মোটের উপর সম্পদের দায়িত্বও মা থেকে মেয়ের উপর বর্তায় এবং বিয়ের পর পুরুষ নারীর ঘরে চলে যান৷ তবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থাকে পুরুষের কাঁধে৷ আর তারা এটাকে বিবেচনা করে ক্ষমতার সুষম বণ্টন হিসেবে৷

মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণের ধারণাই অনুপস্থিত। ধর্ষণমুক্ত সেই সমাজের বৈশিষ্ট্য:
নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী,
অর্থনৈতিক সাম্য বিদ্যমান,
সামাজিক স্থিরতা বিরাজমান,
পুরুষের দৈহিক শক্তিকে অপরিহার্য মনে করার মিথ প্রচলিত নয়,
সেখানে নারীরাও প্রভাবশালী সদস্য,
সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে নারী পুরুষের মতোই সমানভাবে অংশ নেয়,
সেই সমাজের কোনো মানুষই কারো উপর প্রভুত্ব করে না, এমনকি জঙ্গলের উপরেও না;
নারীর সন্তানধারণ ও লালন করার ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয় সেই সমাজে।
আমাদের দেশে গারো ভাষায় ধর্ষণ শব্দটি নাই, তাদের সম্প্রদায়ের ভেতর নারী-পুরুষ বৈষম্যও নাই।

শামীম আরা নীপা

পিতৃতন্ত্র এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে পুরুষেরা প্রাথমিক ক্ষমতা ধারণ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক সুবিধা ও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপন করে, পরিবারের ক্ষেত্রে পিতা ও পিতৃতুল্যগণ নারী ও শিশুর উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। কিছু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তি ও পদবী পুরুষের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হয় (পিতৃগোত্রজ)। ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরে সামাজিক, আইনগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখা গেছে। যদিও সংবিধান ও আইনসমূহে পুরুষের মাধ্যমে বংশ পরম্পরা চলার কথা লেখা থাকে না কিন্তু প্রথানুসারে বেশিরভাগ সমসাময়িক সমাজই পিতৃগোত্রজ হয়ে থাকে।

ধর্ষণপ্রবণ সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো:
সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া,
শৈশব থেকেই পুরুষকে উগ্র ও প্রতিযোগী হতে শেখানো,
জনপরিসরে বা ধর্মীয় বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা,
নারীর বাস্তব-বুদ্ধি বিষয়ে পুরুষের প্রকাশ্য উপহাস,
নারীর কাজকে অবমূল্যায়ন করা,
যৌন সম্পর্কে সম্মত না হলে জোর করাকেও পৌরুষ হিসেবে মহিমান্বিত করা।

ধর্ষণ পুরুষ প্রকৃতির অনিবার্যতা নয়, তবে পুরুষ প্রকৃতির যে চিত্র সমাজে নির্মিত হয়েছে তার ফলাফল। নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য করার প্রচলন প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাকাঠামো।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষণ জৈবিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রশ্রয়ে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত পুরুষতান্ত্রিক সহিংস অপরাধ। ১৯৬৯ সালে ১৫৬টি সমাজে ধর্ষণপ্রবণতার উপর গবেষণা করে নৃতাত্ত্বিক প্যাগি স্যান্ডি দেখান যে ধর্ষণ কোনো অবশ্যম্ভাবী বিষয় নয়, বরং তাঁর গবেষণাধীন ৪৭ শতাংশ সমাজে ধর্ষণ নেই। সেসব সমাজ মাতৃতান্ত্রিক কিংবা আদিবাসী সমাজ।

অনেকে মনে করে, মানব সভ্যতার শুরুটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এটি পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠে। আর তখন থেকেই বেশিরভাগ পুরুষ মনে করে, মেয়ে মানুষ হচ্ছে তাদের ভোগ্যপণ্য সম্পত্তি। সেখান থেকেই নারীকে মনমতো ভোগ-বিলাস করার প্রবণতা সৃষ্টি হয় পুরুষের মগজে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে এটি স্বাভাবিক হয়ে উঠে। তখন নারীকে তারা ব্যবহার করতে শুরু করে। শত্রুর প্রতি প্রতিশোধ নিতে তাদের মা-বোনদেরকে ধর্ষণ করা হয় আর এই ধর্ষণ ও হত্যার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের বিপক্ষে নিজেদের জয় ঘোষণা করা হতো। মানুষের মন ও মগজে ধর্ষণের উপস্থিতি কেন হয় খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ধর্ষণ করার প্রবণতায় শিশু কিংবা বৃদ্ধা নারীকেও বাদ দিচ্ছে না ধর্ষক, এই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। কখনো প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে, কখনো সুযোগ পেয়ে যৌন লালসায় আবার কখনো নারীকে অবদমনের কৌশল হিসেবে, কখনো বিকৃতির বশে, কখনো ক্ষমতার অপচর্চা করে ধর্ষণের মত বর্বরতা করে থাকে পুরুষ।

পরিবার থেকে আমরা কী শিখি? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো আমাদের কী ধরনের মুল্যবোধ শেখাচ্ছে? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে-
নারীর উপর পুরুষের মানসিক ও দৈহিক নির্যাতনের অজস্র দৃষ্টান্ত দেখে বড় হয় সন্তানেরা…
অশ্লীল ভাষায় গালাগালি সহ শারীরিক প্রহার নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা অনেক পরিবারে…
স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রী’র বেহেশত, নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নারীরা কম বুঝে, নারী পুরুষের সেবাদাসী –এসবই শেখানো হয় পুরুষতান্ত্রিক পরিবারগুলোতে…
স্ত্রী থাকার পরেও অন্য নারীর সাথে পরকীয়া, একটা বৌ গেলে দশটা আসবে, পুরুষের জন্যেই নারী জন্ম, পুরুষ চাইলেই দশটা বিয়ে করতে পারে-এই ধরনের পারিবারিক কথোপকথন ও কলহের ভেতর দিয়ে যেসব ছেলেমেয়ে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে যুবা হয়, তখন তাদের ভেতর নারীর প্রতি কতটা সম্মানবোধ গড়ে উঠে?

(চলবে)

বিঃদ্রঃ এই লেখাটা তৈরি করতে গিয়ে আমি প্রায় ৩৫ টার মতো নিউজ লিঙ্ক পড়েছি, কিছু পিডিএফ, কিছু বই আগেই পড়া ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে এই লেখাটা দাঁড়িয়েছে। এই লেখার ভেতর কোট না করেই আমি এমন অনেক কিছু অ্যাজ ইট ইজ যুক্ত করেছি, কারণ তার থেকে ভালো শব্দ সংযোজন আমি করতে পারিনি এবং রেফারেন্স ও ক্রেডিট দিতে পারছি না, কারণ যখন পড়েছি তখন কিছু নোট নিয়েছি। কিন্তু লেখার লিঙ্ক আর রাখিনি, লেখকের নামও মনে থাকার কথা না। তাই এই লেখা আমার একক লেখা না। আমার ইনপুটের সাথে এখানে অনেক মানুষের ইনপুটও আছে। সবার জন্য কোন স্বত্ব ছাড়াই এই লেখাটি উন্মুক্ত।

শেয়ার করুন: