একজন রুচিশীল সংস্কৃতিবোদ্ধার নিপীড়ক এবং ধর্ষকরূপী চেহারা – ৫

সুমু হক:

এ পর্যন্ত এই সাক্ষাৎকারটার যে ক’টা পর্ব আমরা প্রকাশ করেছি, তার প্রত্যেকটি প্রকাশিত হবার পর পরই একটি প্রশ্ন বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে, সেটি হলো, রোকসানার (রোকসানা আক্তার ঝর্ণা) মতো একজন আত্মমর্যাদাপূর্ণ, আধুনিক, একজন নারী কী করে পলাশের মোট একজন নির্যাতকের সাথে এতোগুলো বছর থেকে গেলেন, কেন তিনি অনেক আগেই সেই সংসার ছেড়ে বের হয়ে এলেন না।

এই প্রশ্নগুলো আমিও করেছিলাম তাঁকে।

প্রথমদিকে পলাশের (মনজুরুল আজিম পলাশ) প্রতি ভালোবাসা এবং পরিবারের সামনে নিজের এবং নিজের বৈবাহিক জীবনের জটিলতাকে পরিবারের সামনে এনে নিজের সম্মান এবং নিজের সিদ্ধান্তের মর্যাদা বজায় রাখবার একটা জেদ রোকসানার ভেতর কাজ করেছিল।

তারপর সেই স্থানটা দখল করে নেয় সারভাইভাল ইনস্টিংকট। প্রথম প্রবাস জীবনে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবার সময় প্রধান দরখাস্তকারী ছিলেন পলাশ, তাই সেই কারণে কিস্তির সমাধান হওয়া পর্যন্ত রোকসানার পক্ষে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। সেটা করলে তাঁকে তাঁর সন্তানদেরসহ ডিপোর্টেড করা হতো, দেশে ফিরে তাঁর সন্তানদের নিয়ে একটি অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হবার মতো সাহস তিনি করতে পারেননি। তবে যে মুহূর্ত থেকে তাঁদের এসাইলাম নিশ্চিত হয়ে যায়, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গেছেন শুধুমাত্র একটি কথা মাথায় রেখে, তাঁর সন্তানদের জন্যে একটি নিরাপদ, সুন্দর এবং সফল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

“আমার বাচ্চারা তখন স্কুলে, আমি নিজে তো তখন এই কাজ করি, তখন যদি আমি কিছু একটা করি, বের হয়ে যাই, তাইলে ওদের ওপর একটা মানসিক চাপ পড়বে, পড়ালেখার ক্ষতি হবে ওদের,” বলেন রোকসানা।
ইতিমধ্যেই একটি কোর্স করে নিয়ে তার পাশাপাশি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন রোকসানা।

রোকসানা

কাজে দক্ষতার জন্যে দ্রুত কাজে উন্নতিও হচ্ছিলো রোকসানার। এমনকি ২০১০ এ তাকে বলা হলো, যে তিনি চাইলে সরাসরি, সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করবার জন্যে প্রয়োজনীয় কোয়ালিফায়েড সোশ্যাল ওয়ার্কারের ডিগ্রিটি নিতে ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি হবার সুযোগ পাবেন, এবং সেজন্যে প্রয়োজনীয় লোনও পাবেন, শর্ত একটাই, তাঁর সন্তানদের দেখাশোনা করবার জন্যে তাঁর স্বামী যে বাড়িতে থাকছেন, এর নিশ্চিত প্রমাণ তাঁকে সাবমিট করতে হবে।
একথা শুনেই ক্ষেপে উঠলেন পলাশ! যতরকমভাবে সম্ভব তাঁকে অসহযোগিতা করতে লাগলেন এবং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় এলে পলাশ দেশে চলে গেলেন, যাতে করে রোকসানা ডিগ্রিটি নিতে না পারেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র পলাশের ঈর্ষার কাছে বলি হলো রোকসানার এম্বিশন, কোয়ালিফায়েড সোশ্যাল ওয়ার্কারের ডিগ্রিটি করা আর হলো না তাঁর।

এমনকি এতো বছর ধরে কাজ করে রোকসানা সমস্ত খরচ এবং ট্যাক্স দিয়ে গেলেও, সরকারি কাউন্সিল থেকে একটি সাবসিডাইজড বাসার জন্যে যখন এপ্লাই করার সময় এলো, পলাশ চালাকি করে এপ্লিকেশনটা নিজের নামে সাবমিট করলেন, যাতে করে বাড়িটা পেলেও যেকোনো মুহূর্তে ইচ্ছে করলেই তিনি রোকসানা এবং বাচ্চাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেন।

শুধু তাই নয়, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে চাইল্ড সাপোর্টের জন্যে যে ৭০০ পাউন্ড করে তারা প্রতি মাসে পেয়েছেন, সেই টাকার সবটুকুও এসে জমা হতো পলাশের একাউন্টে, তার কারণ তিনি একাউন্ট ইনফরমেশন দেবার সময় রোকসানার একাউন্ট ইনফরমেশন না দিয়ে তার নিজেরটাই দেন। সেই প্রায় ৪২০০০ পাউন্ডের মধ্যে পাঁচ বছরে মাত্র ১২ হাজার পাউন্ড সংসারের কাজে খরচ করে বাকি ৩০ হাজার পাউন্ড পলাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন এবং এই অর্থ তাদের সন্তান লুম্বিনী এবং নির্বাণের পড়াশোনার জন্যে সঞ্চিত থাকার কথা থাকলেও, তার থেকে কোন অর্থই তিনি রোকসানা বা তাঁর সন্তানদের আজ অবধি ফেরত দেননি। এর কিছুটা পলাশ তার পৈতৃক জমিতে একটি বাড়ি তৈরিতে কাজে লাগান আর বাকি অঙ্কটা নিজের নামে ব্যাংকে জমা রাখেন।

শুধু তাই নয়, ২০১২ সালে ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে পলাশ দুটো ব্যাংক থেকে আরও ২৫ হাজার পাউন্ড তুলে নিয়ে সেই অর্থ ফেরত না দিয়েই বাংলাদেশে চলে যান। পলাশের বর্তমান প্রেমিকা রুমা চৌধুরী রোকসানাকে জানিয়েছেন যে পলাশ তার একাউন্টে থাকা টাকার কিছুটা দিয়ে ৩০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন এবং পলাশ আর রোকসানার সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যে সঞ্চিত সেই অর্থ চুরি করে কেনা সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা তিনি নিয়মিত তোলেন এবং খরচ করে থাকেন।

(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পলাশের সাথে রুমার সম্পর্কে ছিল ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত, তারপর পলাশের হাতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিগৃহীত হয়ে তিনি আমেরিকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন, যদিও এখন কোন কারণে তিনি আবার পলাশের কাছে ফিরে যেতে চলেছেন)

সেই ভোরে একটুখানি চা আর হালকা কিছু নাস্তা খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়তেন রোকসানা। এমনকি দুপুরবেলা তিনি যে কিছু খাবেন, সেই পয়সাটুকুও পলাশ তাঁকে দিতেন না। আর অত ভোরে উঠে সংসারের সব কাজ সেরে নিজের জন্য যে কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে যাবেন, সেই সময়টুকু তিনি পেতেন না।

সারাদিন কাজের ফাঁকে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ হতো না বলে আবার সেই গভীর রাতে বাড়ি ফিরে চারটে ভাত খাবার সুযোগ হতো।
পলাশ ইচ্ছে করেই বেশিরভাগ দিন সব খাবার শেষ করে রাখতো যাতে করে অত রাতে আসায় ফিরেও রোকসানা খাবার না পান।
“একদিন রাতে ভাতের কন্টেইনারের ঢাকনাটা খুলে দেখি, একটুকুও ভাত নাই, সবটা ও শেষ করে রাখসে! সেইদিন আমি যে কী ক্লান্ত, মানে আমার তখন আর এনার্জি ছিল না আবার রান্না করে খাওয়ার! আমি আর পারি নাই, ওইখানে কিচেনে বসেই কেঁদে ফেলসি। আমার ছেলেটা মনে হয়, বুঝছে, কেমন করে যেন দেখে ফেলছে। তারপর থেকে আর কোনদিন ও একা খেতে চায় না, মানে খাওয়ার আগে সবসময় চেক করে, বলে যে “বাবা, আম্মুর জন্য ভাত আছে তো?” আমার জন্য খাবার আছে সেইটা দেখে তারপর সে খেতো, নাহলে আর খেতে চাইতো না,” বলেন রোকসানা।

এমনি করেই চলছিল তাঁদের জীবন।

দু’হাজার বারোর কথা।
“এই সময়টায় এসে ওর অত্যাচারের মাত্রাটা হঠাৎ ভয়ংকর রকম বেড়ে গেলো।
সবরকমভাবেই! মানে মারধর, গালাগালি তো আছেই। বিছানাতেও ও কেমন যেনা পশুর মতো হয়ে গেলো।
ও তো তখন, মানে ওরকম জঘন্য আচরণ করতো বলে আমি আর ওর কাছে যেতে চাইতাম না, ওর বিছানায় ঘুমাতে চাইতাম না, যে ও যদি আবার এসে কিছু করে।
কিন্তু তবুও ও আমাকে ধরে, মানে…উফফ,” বলে হাঁপিয়ে উঠে থামলেন রোকসানা।

মেসেঞ্জারের এইদিক থেকে আমি শুনছি তাঁর দ্রুত নিঃশ্বাসের ওঠানামা, আর ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ঠিক আছেন কিনা।
“আমরা নাহয় আরেকদিন কথা বলি?” আমি বললাম।
“তুমি আমাকে একটু শুধু দুইটা মিনিট একটু সময় দাও,” বললেন তিনি।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলতে শুরু করলেন।
“প্রায় রাতেই ও আমাকে ধরে বিছানায় উন্মত্ত হয়ে উঠত।
শুধু যে আমার অসম্মতি সত্ত্বেও ও আমাকে ধর্ষণ করতো তাই নয়, ও এমন করে পশুর মতো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতো, মনে হতো যেন আমাকে ছিঁড়েই ফেলবে, কিংবা একেক দিন মনে হতো যে আমাকে মেরেই ফেলবে।

ও আগেও আমাকে নির্যাতন করেছে, কিন্তু এই সময়টায় এটা এতো বেড়ে গেলো যে আমি আর নিতে পারছিলাম না। ভাবতাম যে ওকি আমাকে চায় যে আমি মরেই যাই! এমনকি আমি সুইসাইড করার কোথাও ভেবেছি বহুবার, শুধু আমার বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে আমি সেটা করতে পারিনি।
তখন অনেক ভেবেও বুঝতে পারিনি হঠাৎ করে ওই সময় ওর অত্যাচারটা কেন হঠাৎ এত বেড়ে গেলো!
সেটা বুঝলাম মাত্র কাল রাতে,” বললেন রোকসানা।

এই ইন্টারভিউয়ের আগের রাতে, অর্থাৎ গত ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ এ, পলাশের প্রেমিকা রুমা চৌধুরী রোকসানাকে ২০১২ তে পলাশ এবং জুঁই খান নামে একজন নারীর মাঝে মেসেঞ্জারে চলা কিছু কথোপকথনের স্ক্রিনশট পাঠান। অর্থাৎ সেই সময় এই সম্পর্কটিতে জড়ানোর কারণেই পলাশ রোকসানার ওপর তার অত্যাচার ভীষণরকম বাড়িয়ে দেন।

“ও বোধহয় চাচ্ছিলোই যে হয় আমি বাড়ির থেকে বের হয়ে যাই, আর নয়তো সুইসাইড -টুইসাইড কিছু একটা করে ফেলি”, বলেন রোকসানা।
পলাশের কাছে অত্যাচারিত হতে হতে এই সময়টাতে এসে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলেন রোকসানা।

যেমন করেই হোক, তাঁকে তাঁর সন্তানদের মানুষ করতে হবে, আর তাঁর নিজেকেও খুব দ্রুতই পায়ের নিচের মাটি খুঁজে পেতে হবে।

আগের পর্বগুলোর লিংক:

https://womenchapter.com/views/36164

https://womenchapter.com/views/36041

https://womenchapter.com/views/35909

https://womenchapter.com/views/35830

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.