রোকসানা বিন্তী:
কয়েকজন সহকর্মী সাজেক ঘুরতে গিয়েছিলেন, তাদের মাঝে একজন দুই সন্তানের মা! একজনের বয়স নয়, আরেকজনের সাত! বাচ্চারা তাদের বাবার সাথে ছিলো তিনদিন এবং বেশ ভালোই ছিলো! তিনি সংসার, অফিস, সন্তান সবকিছু সামলেই দুদিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন, তাতে বাচ্চাদের বাবার কিংবা পরিবারের কোনো অসুবিধা ছিল না! কিন্তু দুই সন্তান রেখে বেড়াতে গিয়েছিলেন শুনে অন্য এক সহকর্মী মন্তব্য করলেন -“এ কেমন ডাইনী মা রে বাবা! বাচ্চা রেখে ঘুরতে যাওয়ার এতো শখ!” যেখানে বাচ্চার আপত্তি নেই, বাচ্চার বাবার আপত্তি নেই, পরিবারের আপত্তি নেই সেখানে সহকর্মীর চোখে মা হয়ে গেলেন ডাইনী মা!
আরেক সহকর্মী তার দশ বছরের বাচ্চাকে নিজের মায়ের কাছে রেখে সাজেক ঘুরে এসেছেন! তা শুনে আরেক সহকর্মীর মন্তব্য -“বাচ্চা জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না! সত্যিকারের মা হলে কখনোই বাচ্চাকে ফেলে রেখে ঘুরাঘুরি করা যায় না!”
বাচ্চা রেখে ঘুরতে গেলেই কি মা ডাইনী হয়ে যায়?
কিংবা সত্যিকারের মা হতে পারে না?
তাহলে মায়ের সংজ্ঞা কী?
একজন মানুষ মা হলে কি সব ইচ্ছা, আনন্দ,শখ সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে?
এই প্রশ্ন করাটা আসলে বাতুলতা, কারণ বাংলাদেশে সবাই এটাই আশা করে!
বাচ্চা হলো, মানে তুমি শেষ!
তোমার আর কোনো স্বাধীনতা নেই!
তোমার আর কোনো শখ নেই!
তোমার কোনো জীবন নেই!
কোনো জগৎ নেই!
বন্ধু-বান্ধব নেই!
নিজের জন্য কোনো সময় নেই!
ফিটনেস নেই!
ঘুম নেই!
আড্ডা, ঘোরাঘুরি, শপিং, এগুলো কিচ্ছু নেই!
বাংলাদেশে বাচ্চার মা হওয়া মানে অনেকটা এরকম যে সে বাচ্চা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারবে না! বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব মায়ের এবং শুধুমাত্র মায়েরই! এবং বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চার সিংহভাগ দায়িত্ব মা একাই পালন করেন! বাবার সাহায্য যদি মা পেয়ে থাকেন তবে সেটা তার জন্য বোনাস কারণ অনেকেরই এই সাহায্যটুকু পাওয়ার সৌভাগ্য হয় না! আর বাচ্চার জন্য সবকিছু বাদ দিয়ে, খেয়ে না খেয়ে, দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতে করতে সন্তানের প্রতি মায়েদের একধরনের অবসেসন তৈরি হয়! তখন মায়েরা সন্তানদের নিজস্ব এবং একান্ত নিজস্ব ভাবতে শুরূ করেন! বাচ্চা যখন ছোটো থাকে তখন তেমন একটা সমস্যা হয় না, কারণ তখনও বাচ্চার পৃথিবী কেবল তার মা আর পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ! কিন্তু বাচ্চা যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে তখনই মায়ের একাকিত্ব শুরু হতে থাকে, কারণ বাচ্চার নিজস্ব জগত তৈরি হচ্ছে! সে স্কুল, কলেজ, বন্ধু, খেলাধূলা, আড্ডা, মোবাইল ফোন, টিভি, আউটিং এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে! তখন দেখা যায় মা সন্তানের প্রতি এতোটাই ডেডিকেডেট ছিল যে তার নিজস্ব জগৎটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।
ফলে সে আরও বেশি করে সন্তানকে আঁকড়ে ধরতে চায়! সে একধরনের অনিরাপত্তায় ভোগে! এই সমস্যার সবচেয়ে চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন সন্তানের বিয়ে হয়! এতোদিন যে ছিল মায়ের নিজস্ব, এখন অন্য একজন এসে সেখানে ভাগ বসাবে এটা অনেক মা-ই মেনে নিতে পারে না! ফলে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি!
অথচ খুব সহজেই এর সমাধান করে ফেলা সম্ভব! আর তা হলো, বাচ্চা হবার পর মাকে একটু তার নিজস্ব সময় দেয়া! তাকে একটু সাপোর্ট দেয়া! মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া, তার যা যা করতে ভালো লাগতো সেগুলো একটু করতে দেয়া! মোদ্দাকথা, বাচ্চার দায়িত্ব থেকে একটু সময়ের জন্য অব্যহতি দেয়া!
ব্যস!
তাতেই মায়ের একটা নিজের জগত তৈরি হবে যেখানে সে দুদণ্ড শ্বাস ফেলতে পারবে!
সমাজ হয়তো তাকে ডাইনী মা বলবে!
কিংবা তার মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে!
হাজারটা অভিযোগের আংগুল তুলে জবাবদিহিতা চাইবে!
কিন্তু আজকের ডাইনী মা-ই হয়তো ভবিষ্যতে সন্তানের সাথে মিলেমিশে সুখে থাকতে পারবেন!