সুমাইয়া শরাফ বিদিশা:
বিনোদিনীরা সবসময়ই সমাজে নিগৃহীত। শুরুটা সেই রবি ঠাকুরের সময়, না তারও অনেক আগে। কারণ তা না হলে তিনি হয়তো সমাজের এমন অবস্থা তুলে ধরতে পারতেন না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে হাল রবীন্দ্রের বিনোদিনীর ছিল, সে হাল যে সুনীলের বহ্নিশিখার হয়নি, তা কিন্তু না।
পুরো এক শতাব্দী ঘুরেও সমাজের বিশেষ কিছু পরিবর্তন সুনীল কিংবা রবীন্দ্র অথবা তাদের পূর্বপুরুষ রামমোহন কেউই তেমন সাধন করতে পারেননি।
আমি বিধবা বিবাহ কিংবা মুসলিম-অমুসলিম কোন বিবাহের কথাই বলছি না। কারণ এদের কারো চরিত্রই বিয়ে, প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে যতটা না ঝক্কি সহ্য করেছে, বরং তার চেয়ে বেশি ঝামেলা পোহানো লেগেছে শিক্ষা নিয়ে।
অতি শিক্ষিত নারী ধ্বংসের কারণ, তা সে বিধবা হোক, সধবা, ডিভোর্সি কিংবা অবিবাহিত। আর হবেই বা না কেন বলুন? ঘরে থেকে কি সমাজকে দেখা যায়? দর্পণে শুধু নিজের মুখটাই দেখলাম, চোখে কাজল আঁকলাম, কিন্তু আমার চার দেয়ালের বাইরে কে কোন কারণে অন্যের মুখে কালি লেপে দিচ্ছে, তা জানলাম না, সেই দর্পণ দেখার সুযোগ পেলাম না, তবে এই সাজ-সজ্জা করে কী বা লাভ?
লাভ একটা আছে, এক মহলের মানুষের সন্তুষ্টি। তবে নিজের সন্তুষ্টি, আত্মার পরিতৃপ্তি?
উত্তরের অভাব হবে না। নারীদের আত্মার পরিতৃপ্তি সকলের সেবায়, সন্তান জন্মদানে। জ্ঞান আহরণের মতো কাজ সে তো পুরুষকেই মানায়। নারীর সৌন্দর্য বেশ-ভূষায়, কেশ ঢাকায়।
তবে এই উত্তর কি শুধু পুরুষের? ছি: ছি:! বারবার বুঝি এই প্যাট্রিয়ার্কাল পার্টিকে দোষ দিবো? এই উত্তর নারীরও, যিনি কেবল কাজল এঁকেছেন চোখে, ভুলেও বোঝেননি কেউ বুঝি তার চোখ দুটিতে যুগ যুগ ধরে কালি লেপে দিয়েছে।
বিনোদিনী, হৈমন্তী, বিলাসী কিংবা বহ্নিশিখা কেউই সুখী হতে পারেনি, কেন জানেন? ঐ যে শিক্ষা, সমাজকে বুঝতে পারা, সমাজের বোঝা ভেঙে নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়তে চাওয়া, এই ছিল তাদের অপরাধ।
সমাজে হৈমন্তীর বাবার মতো অনেক বাবা এখনও আছেন, যিনি কন্যাকে শাস্ত্র না মুখস্ত করিয়ে জীবনের দীক্ষা দিতে চান, বিহারীবাবুর মতো নারীকে সম্মান করতে চাওয়া পুরুষ এখনও আছেন। কিন্তু তাদের পরাহস্ত করবে এমন লোকই বেশি আর খুঁজে পাওয়াও বড্ড দুস্কর। কেই বা চায় শত বছরের শিকড় কেটে ফেলতে?
কারণ? নারীর আবার শিক্ষা কী? সে ঘর গুছাবে, চাবির গাচ্ছি কোমরে বাঁধবে, আর যে নারী শিকল পড়তে না করছে, তার নামে কুৎসা গাইবে।
নারী পড়তে শিখলে সমাজের ভার বাড়বে, কারণ তাতে যে অকর্মন্য পুরুষের কর্মসংস্থান কমবে।
কোন এক জায়গায় যেন এক মহাজ্ঞানীকে বলতে শুনেছিলাম, ‘নারী পড়তে গেলে অর্থ উপার্জন করতে চায়, তাতে সে স্নো-পাউডার কিনে পুরুষের মশকরা করে, পুরুষ অর্থ উপার্জন করলে তাতে সংসার চলে!’
আচ্ছা শিক্ষাই নারীর শত্রু মেনে নিলাম, তাহলে সেই মূর্খ নারীরা যারা আমার আপনার বাড়িতে সাহায্য করে বেড়ায় তাদের বাড়ির পুরুষেরা কিছু করে না কেন বলতে পারেন? কেন মাস শেষে বউ/মা/বোনের টাকার দিকে হাড়-হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকে?
ঐ যে বললাম না, সব দোষ শিক্ষার!
নারী শিক্ষিত বলে তার আত্মবিশ্বাস বেশি, ভালো-মন্দের কথা সে বোঝে, নিজের পরিবারের কথা ভাবে, তাই তো মিথ্যে কাঁচের দর্পণ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না।
যাক গে, একই গল্প আর কত? রবি ঠাকুর কিংবা সুনীল যখন পারেননি শিক্ষিত নারীর সুখী পরিণতি দেখাতে, তবে আমি-আপনি কী আর? নিছক ছিটকে পড়া মানুষ, এর বেশি কিছু তো নয়!