সুমু হক:
পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া নারীরা যে শুধু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন তা নয়, বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলা সহিংসতা একসময় তাদের মানসিক সুস্থতাকেও কেড়ে নেয়, একটু একটু করে তাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙেচুরে তাদের সমস্ত অস্তিত্বটাকেই এলোমেলো করে রেখে দেয়, যেন সে আর কোনদিন প্রতিবাদ করতে না জানে, যেন সে আর মাথা তুলতে না জানে।
এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসে, এইসব মানসিক আর শারীরিক অত্যাচারের ভেতর দিনের পর দিন, প্রতিটি মুহূর্ত পার করেও সেই অত্যাচারী স্বামীর মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানো, তার হাজারও মানসিক অত্যাচার, নিগ্রহ আর অপমান সত্ত্বেও নিজের আত্মবিশ্বাস বজায় রেখে, ঠাণ্ডা মাথায় নিজের এবং নিজের সন্তানদের জন্যে একটি নিরাপদ এবং সফল ভবিষ্যৎ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হলেও, রোকসানা এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন তাঁর অতুলনীয় মানসিক শক্তির কারণে। রোকসানা বরাবরই ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্রী এবং কঠোর পরিশ্রমী।
যুক্তরাজ্যে এসাইলামের এপ্লিকেশনের অনিশ্চয়তা আর পলাশের অমানবিক অত্যাচারের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে অবশেষে খানিকটা স্বস্তি এলো ২০০৭ সালে, যখন তারা এসাইলাম পেলেন।
এসাইলামের প্রক্রিয়া চলাকালেই বিভিন্ন জায়গায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছিলেন রোকসানা, তাই এসাইলাম পাবার পর একটি কোর্স করে কাজ পেয়ে যেতে কোন সমস্যাই হলো না তাঁর!
পশ্চিমি ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থার আরামে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে পলাশ কিন্তু তখন কিছুতেই চাকরি করতে চাইলেন না, তিনি বেঁকে বসলেন যে তিনি সরকারি সাহায্যের জন্যে আবেদন করবেন। রোকসানা যেহেতু সুষ্ঠু স্বাভাবিক কর্মঠ হয়েও তাঁর এই সরকারি সাহায্য নেবার বিষয়টি মেনে না নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন, এবার পলাশের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো রোকসানার কাজের জায়গায় তাঁর সাফল্য।

“এতোকিছু সত্ত্বেও সে তখনও আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ ছিল, এবং আমাদেরকে মানসিক এবং অর্থনীতিকভাবে শোষণ করা ছিল আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের আরেকটি দিক। তার মিড্-লাইফ ক্রাইসিস শুরু হওয়া মাত্রই পলাশ সুস্পষ্টভাবেই আমাদের পারিবারিক জীবনের দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে নেয় ; বাংলাদেশে থাকতে সমাজে তার যে অবস্থান ছিল, ইংল্যান্ডের সমাজে তার সেই একই অবস্থান নেই, এই হতাশা থেকে সে কাজ করা ছেড়ে দেয়। মা তখন কাজে ওভারটাইম করতে শুরু করেন এবং আমরা প্রায় তাঁকে দেখতেই পেতাম না, কারণ তিনি খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক রাতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন। তারপর কেমন করে যেন তিনি ঠিকই বাসা পরিষ্কার করে পরেরদিনের জন্য আমাদের সবার খাবারও রান্না করে রাখতেন,” লিখছেন তাদের মেয়ে লুম্বিনী।
তিনি আরও জানান, “পলাশ তখন অর্থনৈতিকভাবে তাঁর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল, অথচ তারপরও কাজে তাঁর উন্নতি হওয়াতে সারাক্ষণ অসন্তুষ্ট থাকতো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ না থেকে বরং নানাভাবে তাঁর ওপর অত্যাচার চালিয়ে যেত। পলাশ তখন পরিবারের জন্যে রোজগার না করে সারাদিন বিছানায় তার আইপ্যাড নিয়ে পড়ে থাকতো (এখন বুঝতে পারি, যে সেটা ছিল তার প্রেমিকার সাথে নানারকম অশ্লীল কথোপকথনে ব্যস্ত থাকবার জন্যে)। সে ছিল অলস, তার নিজের অর্জন বলতে কোনকিছুই ছিল না, সে তার পরিবারের কারো সাথে কথা বলতো না , কিংবা ন্যূনতম কোনকিছু করতো না, অথচ কেমন করে যেন নিজের অহংকারটুকু ঠিক বজায় রাখতে জানতো, ভাবখানা যেন পৃথিবীর এই একটুখানি জায়গাতেই এখনো সে কিছুটা হলেও আধিপত্য বজায় রেখেছে এবং প্রতি পদে তাকে তার প্রমাণ দিয়ে যেতেই হবে,” ।
সে সময় সারাদিন কাজে থাকলেও তার মাঝেও বার বার ফোন করে এবং মাঝে সামান্য একটু সময় পেলে বাসায় এসেও সন্তানদের খবর নিয়ে যেতেন রোকসানা। আর পলাশের কাজই ছিল বিভিন্নরকমভাবে তাঁর রোজকার কাজে বাধার সৃষ্টি করা। আর যে বিষয়টিতে রোকসানা সবচেয়ে সচেতন, সেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় যাতে ব্যাঘাত ঘটে তার জন্যেও ইচ্ছে করে নানারকম সমস্যা তৈরি করতেন পলাশ।
“দেখা গেলো যে সারাদিন কাজ করে বাসায় আসলাম, দেখলাম যে অনেক লোকজন নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি ঢুকলাম তো ও বললো যে এরা আসছে, এদেরকে এখন ডিনার খাওয়ায়ে দিতে হবে। সে এইভাবে হঠাৎ করে গেস্ট নিয়ে আসতো যাতে আমার ওপর ডাবল একটা প্রেশার পড়ে। তাছাড়া তখন লুম্বিনী ওপরের ক্লাসে ওঠছে, ওর আর নির্বাণের পড়াশোনা থাকে, নিচে এতো হৈচৈ আওয়াজে ওরা পড়াশোনা করতে পারে না, বাচ্চারা একটু টিভি দেখতে পারে না, ওদের কোন প্রাইভেসি নাই, তো তখন আমি পলাশকে বলাম, যে এইসব তো বন্ধ করতে হবে,” বলেন রোকসানা।
“এই কুত্তার বাচ্চা, তোর কথায় কি আমার চলতে হবে নাকি !” পলাশের উত্তর।
পলাশ তখন আরো জোরে চিৎকার করে, আরো জঘন্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিতেন , যাতে করে বাচ্চারা শুনতে পেয়ে ওপর থেকে নেমে আসে, আর মন খারাপ হয়ে গিয়ে ওদের পড়ার ব্যাঘাত ঘটে, এমনটাই মনে করেন রোকসানা। তার সাথে সাথে চলতো অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার।
“ও ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আমার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে লাত্থি দিয়ে আমাকে ফ্লোরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় নিয়ে ফেলছে। আর তারপর আমারে এতগুলা কিক করেছে। আমি মুখে হাত চেপে ধরে আছি, যাতে আমার কান্না আর চিৎকার বাইরে থেকে শোনা না যায়! তারপরও কিছুটা শব্দ বাইরে যাচ্ছিলো। চিৎকার শুনে তখন লুম্বিনী নেমে আসছে উপর থেকে। আমি তাড়াতাড়ি কিচেনের সিঙ্কটাতে গিয়ে মুখটাতে পানি দিয়ে দাঁড়াইসি। তখনও আমার মুখটা লাল হয়ে আছে. লুম্বিনী আমার মুখটা দেখে জিজ্ঞেস করেছে, “আম্মু, তোমার মুখটা এতো লাল কেন? কী হয়েছে তোমার?” আমি বললাম, “না বাবা, আমি অনেকক্ষণ হিটারের পাশে বসে ছিলাম তো, এইজন্যে মুখটা লাল হয়েছে।” পলাশ তখন একটা কুৎসিত মুখভঙ্গি করে মেয়ের দিকে ইশারা করছে আর বলছে , “বল, এখন কেমন! বল তোর মেয়েকে !” ও খুব ভালো করেই জানতো যে আমি যদি তখন মেয়েকে বলি, ওর পরীক্ষা খারাপ হবে, তাই আমি আর কিছুতেই বলতে পারবো না, ” বলে করুণভাবে হাসলেন রোকসানা।
(ক্রমশ:)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
https://womenchapter.com/views/35830
https://womenchapter.com/views/35909
https://womenchapter.com/views/36041