ইমতিয়াজ মাহমুদ:
আজ থেকে প্রায় শ খানেক বছর আগের কথা। ব্রিটিশ আমল। রাজশাহী জেলার পবা থানার দশমারি গ্রামে কেরামত মণ্ডল আর বিলাত আলী মণ্ডল নামে দুইজনের বিরুদ্ধে বিচার হচ্ছে। দুইজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১৯২৪ সনের ৩১শে মে রাতে বিনোদিনী নামের এক নারীকে জোর করে বা প্রতারণা করে দশমারি গ্রামের বাইরে একটা মাঠে নিয়ে গিয়ে দুইজন মিলে ধর্ষণ করেছে। তারপর সেখান থেকে বিলাত আলী বিনোদিনীকে নিয়ে আরেকটা জায়গায় যা,য় আর সেখানে তাকে আরেকবার ধর্ষণ করে। বিচারে সকল ঘটনা প্রমাণিত হয়, কেরামত আলী আর বিলাত আলী দুইজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয় ধর্ষণের জন্য, আর বিলার আলীর একটা বাড়তি সাজা হয় ধর্ষণের উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে। যথারীতি কেরামত মণ্ডল আর বিলাত আলী আপীল করেছে। কলকাতা হাইকোর্টে আপীল শুনানি হচ্ছে- দুই বেঞ্চের জজ, একজন ইংরেজ জজ, আরেকজন বাঙালি জজ। ওরা দুই পক্ষের কথাই শুনলেন গভীর মনোযোগ দিয়ে, শুনে দিলেন আপীল মঞ্জুর করে। তার মানে হলো, কেরামত মণ্ডল আর বিলাত আলী মণ্ডলদের সাজা বাতিল। তবে হাইকোর্টের জজ সাহেবেরা দুই মণ্ডলকে একদম ছেড়ে দেয়নি- ওরা বললেন যে বিচার ঠিক হয়নি, আবার বিচার হবে।
কেন ওদের আপীল মঞ্জুর হলো? দুইটা কারণে হাইকোর্ট আপীল মঞ্জুর করেছে। অভিযোগ গঠন করা নিয়ে টেকনিক্যাল ভুল ছিল একটা সেই কারণ, আর দ্বিতীয় কারণটা ছিল সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারা। মামলার বিচারের সময় নিম্ন আদালতের বিচারক বলেছিলেন যে ধর্ষণের অপরাধের জন্যে ভিক্টিমের ব্যক্তিগত চরিত্র অপ্রাসঙ্গিক এবং ভিক্টিম যদি যৌনকর্মীও হয় তবুও তাঁর বিরোধ ধর্ষণের অপরাধ হতে পারে। কলকাতা হাইকোর্ট বললেন যে, নিচের কোর্টের জজ সাহেব ভুল বলেননি। ১৫৫(৪) ধারায় বাদীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার এবং এই সংক্রান্ত সাক্ষ্য ইত্যাদি উপস্থাপনের যে সুযোগ আছে সেই সুযোগও তিনি দিয়েছেন। কিন্তু ঐ যে তিনি বলেছেন যে ভিক্টিমের চরিত্র ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, এই কথাটা একটু বিভ্রান্তিকর হয়েছে, সুতরাং আবার বিচার হবে, মামলা নিচের আদালতে ফেরত। এই ধর্ষণ মামলাটার পুনঃবিচার পরে হয়েছিল কিনা, হলেও সেখানে কী রায় হয়েছিল বা মামলার চূড়ান্ত পরিণতি কী হয়েছিল, বিনোদিনী বেচারা ধর্ষণের বিচার শেষ পর্যন্ত পেয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ১৫৫(৪) ধারার প্রয়োগের নজির হয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায়টা এখনো ল রিপোর্টগুলিতে রয়ে গেছে।
এই ১৫৫(৪) ধারাটা কী? কেন আমরা সকলেই এইটা নিয়ে এতো কথা বলি?
সাক্ষ্য আইন হচ্ছে মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণাদি গ্রহণ, প্রাসঙ্গিকতা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে ১৮৭২ সালে প্রণীত একটা আইন। এই আইনের একটা অধ্যায় হচ্ছে জেরা বা ইংরেজিতে আমরা যেটাকে বলি ক্রস এক্সামিনেশন সেইটা নিয়ে। এই অধ্যায়ের একটা ধারা হচ্ছে ১৫৫ ধারা, যেটার বিষয় হচ্ছে একজন সাক্ষীর বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্যে কী কী বিষয় নিয়ে জেরা করা যাবে, সেইসব। এই ১৫৫ ধারারই ৪ নং উপধারায় বলা আছে যে একজন পুরুষের বিরুদ্ধে যখন ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার মামলার বিচার হয়, তখন আসামী পক্ষে দেখাতে পারবে যে বাদিনীর চরিত্র সাধারণভাবে অনৈতিক ছিল। এর মানে হচ্ছে যে ধর্ষণের শিকার নারীটি যখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিয়ে ধর্ষণের ঘটনাটা বলবে, তারপর জেরার সময় আসামী পক্ষ চাইলে বাদিনী যে অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, সেটা প্রমাণ করার জন্যে বাদিনীর চরিত্র নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে পারবে। এটার ফলে কী হয়? এটার ফলে প্রতিটা ধর্ষণ মামলায় দেখা যায় যে আসামী পক্ষ ধর্ষণের শিকার নারীটিকে এমন সব প্রশ্ন করতে থাকে যে সুস্থ স্বাভাবিক কোনো নারীর পক্ষে আদালতের কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে লোকজনের সামনে ঠাণ্ডা মাথায় এইসবের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
এই যে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা, এটার উদ্দেশ্য যদিও বাদিনীর কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করা, আসামী পক্ষের উকিল সাহেবেরা এইটার সুযোগে সেই নারীটির ব্যক্তিগত জীবন, তার যৌন জীবন থেকে শুরু করে হেন কোন বিব্রতকর বিষয় নাই যেটা নিয়ে প্রশ্ন করেন না। ঐ যে উদাহরণ দিয়েছি উপরে সেই ঘটনায় বিনোদিনীর কথা কল্পনা করেন। বেচারিকে ধর্ষণ করেছে দুইজন মিলে একাধিকবার। তাকে পুলিশের সামনে এইসব কথা বলতে হয়েছে একাধিকবার, আদালতে একবার বর্ণনা করতে হয়েছে বিস্তারিতভাবে, এরপর আসামী পক্ষের উকিলরা এসে প্রশ্ন শুরু করেছে তাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করার জন্যে। এইসব ক্ষেত্রে আসামী পক্ষের উকিলেরা এমন সব প্রশ্ন করতে থাকে, সেগুলি বর্ণনা করতেও আমি দ্বিধা করছি। আপনারা এইরকম দৃশ্য অনেকসময় সিনেমায় দেখেছেন- ধর্ষণ মামলায় বাস্তবের কোর্টরুম দৃশ্য সিনেমার ঐসব দৃশ্যের চেয়ে অনেক ভয়াবহ। প্রকৃত শুনানির সময় আসামী পক্ষের উকিলেরা এমনসব প্রশ্ন করেন যেগুলি ওরা সিনেমায়ও দেখাতে সাহস পায় না।
এইসব ক্ষেত্রে এসে ধর্ষণের শিকার নারীটি সবসময় ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না, অবমাননাকর এইসব প্রশ্ন করে নারীকে বিপর্যস্ত করে ফেলে আসামী পক্ষ অনেক সময়ই মামলা থেকে খালাস পেয়ে যায়। মনে রাখবেন ফৌজদারি মামলায় আসামী পক্ষের জন্যে সামান্য একটু সন্দেহ সৃষ্টি করাটাই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। আসামী সম্পূর্ণ নির্দোষ এইটা প্রমাণ করার দরকার নাই- হয়তো সে এই কাজটা করেনি, এইরকম একটা সন্দেহ থাকলেই জজ সাহেবের দায়িত্ব হচ্ছে আসামীকে খালাস দিয়ে দেওয়া।
সাক্ষ্য আইনের এই বিধানটার ফলে যেটা হয়েছে, আসামী পক্ষের জন্যে একটা লাইসেন্স হয়ে গেছে যে প্রকাশ্য আদালতে আসামীর উকিলরা ধর্ষণের শিকার নারীটিকে বেশ্যা বা দুশ্চরিত্রা বলে গালি দেওয়া যায়। প্রকাশ্য আদালতে আসামী পক্ষের উকিলরা বলতে পারেন যে এই নারীটি একজন খারাপ নারী, সে এমনিই পুরুষের সাথে শোয়ার সুযোগের জন্য ঘুরে বেড়ায় বা সে একজন দুশ্চরিত্রা নারী, যার তার সাথে শুয়ে বেড়ায় এইরকম যা ইচ্ছা তাই। আইনের এই ধারাতেই আমরা সুযোগ রেখেছি, উকিল সাহেবরা এইসব কথা যুক্তিতর্কের সময় তো বলতে পারবেনই, তার আগে ধর্ষণের শিকার নারীটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাকে এইসব কথা বলতে পারবে। এবং কোন মামলায় যদি মনে হয় যে না, জজ সাহেব এইসব প্রশ্ন করার জন্যে আসামীর উকিলকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেননি, তাইলে উচ্চ আদালত সেই মামলার রায় বাতিলও করে দিতে পারেন- বিনোদিনীর মামলার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল।
আজকে যখন দেশে ধর্ষণের এইরকম বিস্তার ঘটেছে, আজকে যখন সরকারও গণদাবির মুখে বাধ্য হয়ে দেশের আইন বদলানোর পদক্ষেপ নিয়েছে, আজকে তো সময় এসেছে যে আমরা আরেকবার ভেবে দেখি যে সাক্ষ্য আইনের এই ধারাটা রাখার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা! পৃথিবীর অনেক দেশেই কিন্তু এই আইনটি ছিল। বিশেষ করে যেসব দেশ একসময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল সেইসব দেশে তো একইরকম বিধান আছেই। তবে এখন প্রায় সব দেশেই এইরকম বিধান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, অনেকেই এইসব বিধান পাল্টে ফেলছেন, অনেক দেশ পাল্টানোর পথে আছে। উদাহরণ দিই, ভারতে ১৫৫(৪) ধারা বাতিল করে হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু এই বিধান বাতিল করার পরও ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রতি ঐসব প্রশ্ন করে ওদেরকে কাবু করে ফেলার প্রবণতা বন্ধ হয়নি, পরে ওরা সাক্ষ্য আইনের ক্যারেক্টার এভিডেন্স সংক্রান্ত অন্যান্য কিছু বিধান পরিবর্তন করেছে। তাতেও কাজ হয়নি। পরে ২০১৩ সালে এসে এইরকম প্রশ্ন করা একদম আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দেখেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে কী ঘটনা প্রমাণ করতে হয়? প্রমাণ করতে হয় শুধু দুইটা জিনিস, প্রথমত আসামী ও বাদিনীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা বা প্রবিষ্ট হয়েছিল কিনা। দ্বিতীয়ত, এটাতে বাদিনীর সম্মতি ছিল কিনা। বাদিনীর যদি সম্মতি থাকে তাইলে ধর্ষণ হয়নি, যদি না থাকে তাইলে ধর্ষণ হয়েছে। বাদিনীর চরিত্র ভাল কি মন্দ, বাদিনী এর আগে অন্য কারো সাথে বা এই স্বামীর সাথেই শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিল কিনা এইসব প্রশ্ন তো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। তাইলে বাদিনীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ রাখবেন কেন? বাদিনীকে এইরকম বিব্রত করার সুযোগ রাখবেন কেন?
একটা সময় ছিল যখন নারীর ‘না’কে হ্যাঁ বিবেচনা করা হতো। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হলেই ধরে নেওয়া হতো যে নারীর সম্মতি আছে। সুঁই সুতার উদাহরণ দেওয়া হতো- বলা হতো যে নারীটি যদি নাই চাইবে তাইলে হলো কী করে, ইত্যাদি। সেইসব ধাপ তো আমরা পার হয়ে এসেছি, সভ্যতা তো খানিকটা হলেও অগ্রসর হয়েছে। এখন তো আমরা সকলেই মানি যে নারীর ‘না’ মানে ‘না’ই, হ্যাঁ নয়।
এখন এই সময়ে এসে ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে এইসব বিধান রাখার যুক্তি কী আছে? তাছাড়া এর ফলাফলটা চিন্তা করেন। এইরকম বিধানের সুযোগে অসংখ্য ধর্ষণের আসামী হাসতে হাসতে মামলা থেকে খালাস পেয়ে বেরিয়ে যায়। আপনি যদি পরিসংখ্যান দেখেন যে প্রতি একশটা ধর্ষণ মামলায় কয়টা মামলাতে আসামীদের সাজা হয়? খুবই কম- হাতে গোনা কয়েকটা। বেশিরভাগ মামলাতেই আসামীরা খালাস পেয়ে যায়। আর আসামীকে যদি দোষী প্রমাণিত করা না যায়, তাইলে সাজা হিসাবে আপনি মৃত্যুদণ্ড রাখলেন, নাকি ক্রুশে বিদ্ধ করার বিধান রাখলেন তাতে কী আসে যায়! আগে তো দোষী প্রমাণিত হতে হবে- এইসব বিধানের কারণেই সেইটাই তো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।