রোকসানা বিন্তী:
আজ থেকে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে আমরা পাশের বাসার আংকেলের কোলে করে স্কুলে যেতে পারতাম! এর মধ্যে যে অস্বাভাবিক কিছু আছে তা কারো মনেও আসতো না! নির্দ্বিধায় আমরা অন্য বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা খেলতাম! দুপুরে ক্ষিধে পেলে আন্টি খাইয়ে দিত! খেয়েদেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে যেতাম! বিকেলে আম্মু নিয়ে আসতো! এতে যে টেনশনের কিছু থাকতে পারে তা কারো চিন্তাতেও মনে হয় আসতো না!
আজ থেকে সাতাশ-আটাশ বছর আগে, স্কুলের টিচাররা আমাদের কোলে করে লিখতে শিখিয়েছেন বোর্ড নাগাল পেতাম না বলে! জীবনের প্রথম স্কুল বলে আমরা যখন অনেকেই কান্না করতাম, টিচাররা তখন আমাদের চকলেট কিনে দিতেন! আমরা হাসিমুখে চকলেট খেতে খেতে বাসায় ফিরতাম!
আজ থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর আগে বাবার সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় যদি বাসে সিট না থাকতো তখন আমরা টুপ করে সিটে বসা কোনো এক আংকেলের কোলে বসে যেতাম! খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য ছিলো এটা!
আজ থেকে বিশ-বাইশ বছর আগে বাসায় অচেনা কেউ এলেও আমরা নির্ভয়ে দরজা খুলে দিয়ে ঘরে এনে বসাতাম! পানি খেতে চাইলে পিরিচে করে বিস্কুট আর গ্লাসে পানি এনে দিতাম! আমাদের মায়েরা শিখিয়েছিলেন, কেউ পানি চাইলে শুধু পানি দিতে নেই, কিছু একটা খাবারও দিতে হয়, নইলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়!
আজ থেকে সাতাশ-আটাশ বছর আগে দৈনিক পত্রিকায় মাসে একটাও ধর্ষণের খবর থাকতো কিনা সন্দেহ!
মাত্র বিশ-বাইশ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশটা বদলে গিয়েছে! এখন আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না! আমার মেয়েকে আমি অনেক চেনা মানুষের কোলেও দিবো না! অচেনা কারো কোলে তো প্রশ্নই আসে না! দুপুরবেলা কেউ নক করলে আমি নিজেই নিশ্চিত না হয়ে দরজা খুলি না! আর প্রতিবেশীর বাসায় বাচ্চাকে একা খেলতে পাঠানো – একথা তো চিন্তায় আনাও ভয়ংকর!
কেন হলো এমনটা?
কীভাবে বদলে গেলো আমার দেশ, আমার দেশের মানুষগুলো?
সে সময় ইয়াবা নামক কোনো বস্তু ছিলো না! সহজলভ্য ছিলো না অন্যান্য মাদকদ্রব্যও! কেউ মদ বা গাঁজায় আসক্ত থাকে, তাকে তো বটেই, তার পরিবারকেও সামাজিকভাবে হেনস্থা হতে হতো! যে কারণে সহজে কেউ নিজের উপর কন্ট্রোল হারাতো না!
উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দেশ ডিজিটাল হয়েছে, কিন্তু সেইসাথে সব বয়সের সবার হাতে হাতে তুলে দিয়েছে পর্নোগ্রাফি, ন্যুডোগ্রাফি! বেগম রোকেয়া কিংবা সুফিয়া কামালের চাইতে সানি লিওন, মিয়া খলিফা অনেক বেশি জনপ্রিয় এখনকার দিনে! সারারাত নীলছবি দেখার পর দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের ভাগ্নি-ভাতিজিকেও যে কেবল শরীর হিসেবে চিন্তা করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক!
সে সময় জি বাংলা, স্টার জলসা ছিলো না! ছিলো না সনি আট, ক্রাইম পেট্রোল! তাই খুন করে লাশ গুম করে ফেলার শতেক পদ্ধতি কিংবা ধর্ষণ করে পালিয়ে যাওয়ার উপায়সমূহ জানা সহজ ছিলো না! হোক না টিভির পর্দায়, খুন দেখতে দেখতে একদিন খুন করে ফেলা খুবই সম্ভব!
ধর্ম ছিলো, ধার্মিক ছিলো, কিন্তু ছিলো না ধর্মীয় গোঁড়ামি! আমরা অনেকটা বড় হয়েও পা বের করে স্কার্ট পরতাম, আমার মায়ের স্লিভলেস ব্লাউজ পরা ছবি বাসার এলবামে জ্বলজ্বল করছে। অথচ এখন বাচ্চাদের শৈশব যেতে না যেতেই কালো কাপড়ে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে! যে কাপড়ের বেষ্টনীর ভেতরে বাচ্চাটা হয়তো ঠিকভাবে দৌড়ঝাঁপও করতে পারে না, কিন্তু তারপরও বাঁচতে পারে না সমাজের তথা পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে! একদিক দিয়ে বেড়েছে ধর্মান্ধতা, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নারীর প্রতি নির্যাতন, অমানবিকতা!
বছর বছর বদলে দেয়া খিচুড়ি শিক্ষাব্যবস্থা তখন ছিলো না!
কেবল নিজেকে নিয়েই সুখী থাকবো – এরকম স্বার্থপর জনগোষ্ঠী ছিলো না!
পর্দা করে না মানেই বেশ্যা – এমন চিন্তা করা বিশিষ্ট চিন্তাবিদেরা ছিলো না!
আজ থেকে ষাট বছর আগে কক্সবাজারে বিকিনি পরে বিদেশি নারীরা সূর্যস্নান করতেন!
আজ থেকে দশ বছর আগে আমি সেই একই কক্সবাজারে জিন্সের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে পানিতে নেমেছিলাম বলে অচেনা এক দর্শণার্থী আমাকে বলেছিলেন, “মাইয়া মাইনষের এতোখানি পাও বাইর করন ভালা না!”
যে দেশের পুরুষ সমুদ্র দেখতে গিয়ে “মাইয়া মাইনষের পা” দেখে বেড়ায়, সে দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুমেয়!
আজ থেকে বিশ বছর পর কী হবে দেশের অবস্থা, নারীদের অবস্থা, ভাবতে গিয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছি!
আমার মেয়ে হয়তো আমাকে একসময় গালি দিবে তাকে এই দেশে জন্ম দেয়ার জন্য।