সঙ্গীতা ইয়াসমিন:
বেগমগঞ্জের ঘটনার কোনো ভিডিও দেখিনি আমি, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার দমকা হাওয়া এসে আমারও গায়ে লেগেছে। গত তিনদিন কিছু লেখার মতো মনের অবস্থাই ছিল না। আজ মনের সাথে যুদ্ধ করেই লিখতে বসেছি। কিন্তু এও তো সত্য, আমার মতো এক অতি সাধারণ মেয়ের লেখায় কার কী বা এসে যাবে? তাহলে কথা বলেই বা কী লাভ?
দেশে ধর্ষণের মহামারী শুরু হয়েছে গেলো দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, কেবল বিচারহীনতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, ক্ষমতার প্রভাব, আর সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থার কারণে। একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ষণের মত একটি জঘন্য, ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধকে কীভাবে প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন পালন করে বিশাল মহীরূহে পরিণত করা যায় আজকের বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রিয় পাঠক, ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করুন, কিছু প্রকাশিত গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতেই এই কথার সহজতর প্রমাণ মিলবে।
শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী (রিপোর্টেড কেস) ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি, এতে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রতি লাখে ধর্ষণের হার ছিল ২.৪৫ জন। শুধু পরিসংখ্যান বিবেচনায় আনলে ২০১৮ এর তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের হার বেড়েছে প্রতি লাখে ১.৩৫ জন বা এক-তৃতীয়াংশ (বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ওয়েবসাইট, ২০১৯)। পাঠক নিশ্চয়ই অবগত আছেন আমাদের সমাজে ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনার শতকরা মাত্র ১৪ ভাগ রিপোর্ট হয়। বাকী ৮৬ ভাগ ভয়ে, লজ্জায়, গোপনে থাকে, কিংবা গ্রাম্য শালিশি, দেনদরবার করে মিটমাট করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের চেয়ে গত বছর শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের গত ১৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রিপোর্টেড ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান যারা সেই সংখ্যাকে বেইস ধরলে ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রিপোর্টেড ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, শেষমেশ সাজা হয়েছে ১০১ জন ধর্ষকের। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ২২১টি ধর্ষণের পর ১ জনের সাজা নিশ্চিত হয়। সংখ্যাটা ০.৪৫%। ধর্ষণের এই জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধি দেখে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবু টনক নড়েনি রাষ্ট্রের, গলেনি প্রশাসনের মন। বদলেনি আইন, দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা যখন অতি জরুরী হয়ে উঠেছে তখন রাষ্ট্র রয়েছে এই বিষয়ে চির নিশ্চুপ এবং নির্বিকার।
যে সমাজে আইনের শাসন নেই, ধর্ষণের মতো অপরাধ করে দিনের আলোয় বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায় ধর্ষক, যে সমাজে নারীকেই আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় ধর্ষিতা হবার দায়, সেই সমাজ তো ধর্ষক পয়দা করবেই সানন্দে। সেই সমাজ শুধু যোনীখোর! কেউ প্রকাশ্যে, দিবালোকে, কেউ মশারীর তলায়, অফিস ঘরের বন্ধ দরোজায়, কিংবা মাদ্রাসার নিভৃত কক্ষে সব চোখ শুধু ওই ত্রিকোণ শরীরে। সুতরাং, নির্যাতিতার পরিবার ছাড়া ধর্ষণের বিচার চাইবার মতোও যথেষ্ট জোরালো বক্তব্য আজও সামাজিক দায় হিসেবে এই জনপদে প্রতিষ্ঠা পায়নি। না কোনো মিডিয়া, না সামাজিক কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে জোরালো বক্তব্য নিয়ে।
প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধাও। গৃহের অভ্যন্তরে, অফিসে, স্কুল-কলেজে, বাসে-ট্রামে, রাস্তায়-দোকানে, ভীড়ের মাঝে-একলা, দিনে কিংবা রাতে, আজ এদেশের কন্যারা, বোনেরা, মায়েরা ভয়াবহরকম অনিরাপদ। চারিদিকে শ্বাপদের হিংস্র থাবা ওৎ পেতে আছে। কান পাতলেই ধর্ষিতার গোঙানি শুনি, চোখ মুদলেই ধর্ষিতার রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত বীভৎস চেহারা দেখি। অথচ, যাদের শোনার কথা, যাদের দেখার কথা তাঁদের কানে তালা, তাঁদের চোখে ঠুলি। তাই বলছি, মেয়েরা আর কান্নাকাটির দিন নয়, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠো, মুছে ফেল চোখের জল। এবার থেকে, নাগিনী হও, বিষ ঢেলে দাও। করো প্রতিবাদ।
একটা কথা আজ জোরেশোরে বলতে চাই, কেউ জোর করে কারো শরীরের উপর হিংস্র কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খুবলে খেলে তার দায় কোনো নারীর নয়! এতে নারীর সম্ভ্রমহানী হয় না, নারীর নিজেকেই লজ্জা পাওয়ার এই সংস্কৃতি ভুলতে হবে। লজ্জা পাবে সেই নপুংশক, সেই পিচাশ। নারী মাথা উঁচু করে বাঁচবে তুমি। তুমি নির্দোষ। বিচার না পেলেও তুমি সজোরে চিৎকার করবে, জানান দিতেই থাকবে-
চিৎকার কর মেয়ে তোর যতদূর গলা যায়,
আমাদের শুধু গলাবাজী করে নীরব থাকার দায়,
প্রশাসন শুধু দূর থেকে দেখে হাততালি দিয়ে যায়
শ্বাপদে ঘেরা এই জনপদে জন্মেছি কেনো হায়
ধর্ষিতা হয়ে আমরা কেনো মেটাবো জন্মের দায়?
কানে তুলো দিয়ে রাষ্ট্র কেবলই পিঠ চাপড়িয়ে যায়।
ফেসবুকে বসে আমাদের বুঝি লিখিয়ে হবার দায়।
পুড়ে ছারখার জান জেরবার
তবু কেনো আজ নিতে হবে শুধু ধর্ষিতা হবার দায়?
চিৎকার কর মেয়ে দেখি কতদুর গলা যায়,
গণভবনে বসেও যদি তোর গলাটা শোনা যায়।
দিন শেষে তাই ভরসা রাখতে চাই, বিচার যদি কিছু হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জ্বী, আপনাকেই বলছি- শুনেছি, এই দেশে সব কাজেই আপনাকেই হুকুম দিতে হয়। সকলের দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হয় বলেই আপনি হয়তো সবকিছু দেখতে পারেন না একথা সত্য। তাই আপনার কানে ধর্ষিতার চীৎকার পৌঁছায় না! আমরা বড় দুর্ভাগা মা জননী! আপনিও তো নারী! আপনি কি কখনো নারীর জীবনে হেটেছেন? ধর্ষিতা নারীর ট্রমা অনুভব করতে পারেন? শুধু একবার প্রধানমন্ত্রীত্ব ভুলে মা হতে পারেন? একবার নারী হতে পারেন? যদি পারেন, সেদিনই আপনার হাতে ত্রিশূল উঠবে! সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা
{তথ্যসূত্রঃ পুলিশ হেডকোয়ার্টার ওয়েবসাইট-২০১৯, বার্ষিক প্রতিবেদন, আসক-২০১৯, বার্ষিক প্রতিবেদন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম-২০১৯, প্রথম আলো- গবেষণা প্রতিবেদন, জহিরুল ইসলাম, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০}