ফাহমিদা খানম:
নষ্ট রাজনীতির ভ্রুণে বেড়ে উঠেছে যে পাশবিকতা সেখানে কারও উপরে দোষ দেওয়ার প্রবণতাই প্রমাণ করে কতোটা অন্ধ আমরা? অন্যায়কারীরা এতোটা বেড়ে উঠার সাহসই পেতো না যদি অংকুরেই তাদের কঠিন শাস্তি হতো, দেশে ধর্ষণের সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছে কারণ যারা করছে তাদের পিছনের খুঁটি তাদেরকে এতোটা প্রশ্রয়দান করেছে যে এদের ভেতরের বোধ, বিবেক বলে কোনো জিনিসই আর নাই। ক্ষমতা কি কিছু মানুষের ভেতরে পাশবিকতার অথবা নির্মমতার জন্ম দিচ্ছে না? দুদিন পর পর পত্রিকার সংবাদ হবার পরেও অন্যের দিকে আংগুল তোলার পর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে, কোথায় গেছে বোধোদয় আর বিবেকের দরজা? একটা ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই আরেকটা সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু আর কতো? একজন খুনী দুপুরে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে আদালতে গেছেন রায় শুনতে, এটা যখন পত্রিকার সংবাদে আসে, হা করে তাকিয়ে থাকি, আমি মাথামোটা মানুষ তাই হয়তো বুঝতে পারি না পাবলিককে কী খাওয়াইলে কাটতি বাড়ে! আমার কানে আর্তনাদ বাজতেই থাকে, “আব্বা গো আপনাদের দোহাই লাগি”।
স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন হয়, অসহায় সেই নারীর জায়গায় নিজের কাছের মানুষদের কল্পনা করলে মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ে – দেশের হাজারো নারীদের একই সমস্যা হয়, যাদের হয় না তারা আসলে পুরুষতন্ত্রের বাহক তাই তাদের নিয়ে আমি ভাবিও না।
নষ্ট, নোংরা রাজনীতির কবলে পড়ে যারা পাশবিকতা করে বেড়ান তারা কতটা শক্তিশালী যে নির্যাতিতার পরিবার ৩১ দিনেও মামলা করার সাহসই করতে পারেনি!
কথা হলো সাধারণ মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে? প্রশাসন কাদের জন্যে? সেখানে কি একটা মানুষ ছিলো না? যে নষ্ট রাজনীতির নির্মম বলি হচ্ছে আমাদের দেশের মেয়েরা, সেখানে বলির পাঁঠা নারীরাই। আমরা ৭১ দেখিনি, কিন্তু সেই পাশবিকতার কথা পড়েছি, সেই পথ ধরে এখন আবারও কারা হাঁটতে চায়? কাদের প্রশ্রয়ে অপরাধ করেও উল্টো নির্যাতিতার পরিবারকে জিম্মি করে রাখার দুঃসাহস পায়? এই যে সাধারণ মানুষকে বুলি আওড়ানো হয় – আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না, সেটা কি শুধুই আমাদের মতো আমজনতার জন্যে? আমরা কি দেশের আমজনতা হয়ে অপরাধ করেছি? দেয়ালে পিঠ ঠেকলে আমরা কি জান বাঁচাতে খুনী হবো না? বিচারের আশা কেন হারিয়েছে মানুষ? কারণ প্রথম থেকেই দেখছি অন্যের দিকে আংগুল তোলার অভ্যাসের রাজনীতি দেশের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের। কিছু বলবো? সেটার পথ আইন করে সিলগালা করে দেওয়া, কার কাছে যাবো? কে শুনবে আমাদের কথা? কেউ কি আদৌ আছেন?
আমি একজন নারী, একজন মা – এসব রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না– আমি চাই নিরাপত্তা, আমি চাই নিশ্চিন্তের ঘুম, রাষ্ট্রের দেওয়া সকল নিয়ম মেনে চলার পরেও নিজ দেশে ভয়ে আতংকে কেন থাকতে হয়? মহামারির এমন ভয়াবহ দুর্যোগেও পূর্বের সব রেকর্ড ভেংগে সংখ্যাটা যখন সীমা ছাড়ায় তখন ভয়ে কুঁকড়ে যাই, কারণ আমিও নারী, যাদের সাথে হয় তারাও আমার স্বজাতীয়া।
যে নারীর গর্ভেই বেড়ে উঠে সন্তান, তারা কীভাবে মায়ের ভাষাকে উপেক্ষা করার সাহস পায়? পাকিরা না হয় বাংলা ভাষা বুঝতো না, কিন্তু নিজ দেশে নিজ ভাষায় আর্তনাদ, ফরিয়াদ কাদের ভেতরে সামান্য মানবিকতা জাগায় না? কখন কাতরতার চাইতেও পাশবিকতা বড় হয়?
প্রতিটি নারীর আর্তনাদ বুকের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরে – নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো একই বাজনা শুনতে শুনতে চোখ, কান, মন প্রচণ্ড ক্লান্ত। যেখানে যে নারী নির্যাতিতা হয় – সে কোন ধর্মের, কোন বর্ণের, সেসব নিয়ে ভাবি না, চিন্তা করি এই কন্যা বা নারীর জায়গায় আমার আপন কেউ একজনই ছিলো। একটা ঘটনার রেশ শেষ হবার আগেই আরেকটা এসে উপস্থিত হয়, কিন্তু কথা হলো আর কতো? আমরা আর এসব নিতে পারছি না।
এদেশে জন্ম নিয়েছি বলে আমার এখন আর গর্ব হয় না, হাত-পা, মুখ সবই বাঁধা আমাদের – বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়ের, নির্বাক, নিশ্চল হয়ে বেঁচে থাকাটা কোনো গৌরব বা সম্মানের নাহ। একজন মানুষ হিসেবে সকল মানুষের নিরাপত্তা চাই, কারণ আমি বিশ্বজিৎ এর মা, তনুর মা, আবরারের মা নুসরাতের মা, আমি মেজর সিনহার মা, এমসি কলেজে নির্যাতনের শিকার মেয়েটি আমার মেয়ে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এ বিবস্ত্র করা নারী আমার বোন। কেউ আঙ্গুল তুলে বলতেই পারেন নোংরা হাতের মায়ের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি কেনো? কারণ তাদের ভেতরে লোভ, ক্ষমতার অহংকার আমি ঢুকাইনি। এই নষ্ট রাজনীতির মুলো ঝুলিয়ে তাদেরকে নষ্ট পথের সন্ধান দিয়েছে রাজনীতি, আমি এর দায়ভার কেনো নেবো? আমি তো সুস্থ সন্তানের জন্মই দিয়েছিলাম। ক্ষমতার লোভ, অতি অল্প সময়ে ধনী হবার লোভ তাদের ভেতরে জন্মই দিয়েছে রাজনীতি, তারা সেই লোভের চক্করে পড়েছে তারপর বোধ, বিবেক হারিয়ে মনুষ্যত্ব বোধ পর্যন্ত হারিয়েছে, সেই দায় আমাদের কেনো হবে?
পুকুর বা জলাশয়ে কচুরিপানা পরিষ্কার না করলে সেটাই এক সময় গ্রাস করে নেয় পুরো জায়গাটা, সুযোগ আপনাদের হাতে কিন্তু ছিলো, অল্প থাকতেই পরিষ্কার করলে আজকে এতোটা ঘিরে ফেলতে পারতো না, কিন্তু আপনারা স্বজনপ্রীতি আর অন্ধ হয়ে কেবলই এর মাঝে অন্যকিছু খুঁজেছেন আর অন্যায়গুলো গ্রাস করেছে পুরোপুরিভাবেই। চোখের সামনে এতো অন্যায় মেনে মুখ বুঁজে আর সহ্য করতে পারছি না। প্রতিটি ঘটনার পর আরেকটা ঘটনা এসে আগেরটি ছাড়িয়ে যায়, খুন আর ধর্ষণের দেশে বেঁচে থাকার আগ্রহ পাই না। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ কিন্তু মরিয়া হয়ে উঠতে পারে, ক্ষমতার অধিকারীরা হয়তো ভুলে গেছেন সেটা। অনেকেই এসব ঘটনার পর পশুদের সাথে এদেরকে তুলনা করে পশুদেরকে অপমানিত করেন, প্রাণীরা খিদে পেলেই শিকার করে মাত্র! মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা লোভে পড়ে বিবেকের চাইতেও নিজের পাশবিকতাকে নিয়েও লজ্জিত হয় না, আর এদেশে এফবির কল্যাণেই জন্ম নিয়েছে অনেক ধর্ষকামী তরুণ — যাদের কাছে এ-সব অপরাধ বলেই মনে হয় না।
দেশ আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে — ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের উপর চলছে উৎসব — ধর্ষণের।
এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখনই সময় রুখে দাঁড়ানোর, এখনই সময় সব শুদ্ধ করে নেবার।