একজন রুচিশীল সংস্কৃতিবোদ্ধার নিপীড়ক এবং ধর্ষকরূপী চেহারা-৩

সুমু হক:

ডমেস্টিক এবিউজ বা পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, সেটা হলো, পরিস্থিতি যদি এতোই ভয়ংকর হয়ে থাকে তাহলে সেই সহিংসতার শিকার নারীটি তাঁর সন্তানদের নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন না কেন?
বাইরে থেকে কথাটা বলে দেয়া যতখানি সহজ, বাস্তবে হয়তো সেখানে এমন অনেকগুলো জটিল বিষয় কাজ করে যা আমরা বাইরে থেকে ভাবতেও পারি না।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার অভাব, আইনি জটিলতা, লোকলজ্জার ভয়ের মতো বিষয়গুলো রয়েইছে, তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ভিন্নরকম গবেষণালব্ধ তথ্যে একথা আজ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে যেকোনো পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় সবচেয়ে বিপদজনক মুহূর্তটি আসে তখন, যখন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিটি বাড়ি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

আর মঞ্জুরুল আজিম পলাশের সহিংসতার শিকার কেবল তার স্ত্রী রোকসানা নন, তার সন্তানেরাও হয়েছিলেন। আর সেই সহিংসতা এতোটাই ভয়ংকর ছিল যে সেসময় নিজের এবং তাঁর সন্তানদের নিরাপত্তার জন্যে আতংকিত হওয়া রোকসানার পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
বিশেষ করে যখন তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন, সেই সময়টাতে তারা অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন পলাশের ওপর। যেটা বুঝে পলাশও তার অত্যাচারের মাত্রাটি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আপনাদের ভেতর যারা কোনরকম রিফ্যুজিদের নিয়ে কাজ করেছেন, তারা জানবেন যে এসাইলাম সংক্রান্ত জটিলতা আর নিরাপত্তাহীনতা এসাইলামের জন্যে আবেদন করে থাকা নারীদের জন্যে কখনও কখনও বাড়তি অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

পলাশ এবং রোকসানার মেয়ে লুম্বিনী আজিমের বয়স এখন ২৬।
তিনি একটি লিখিত স্টেটমেন্টে আমাদের সাথে তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতার কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের লুম্বিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা প্রচার মাধ্যমের সাথে সবরকম সংযোগ এড়িয়ে চলতে চাইলেও তাঁর মায়ের সাথে দাম্পত্য জীবনের সময়টুকু নিয়ে পলাশের সাম্প্রতিক মিথ্যাচার তাঁকে এই কথাগুলো লিখতে বাধ্য করেছে বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন।
“আমার ৫ বছর বয়স থেকেই সে আমার ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে। না, দেশি বাবা-মায়েরা যেমন বাচ্চাদের শাসন করতে দু’চারটে চড়-থাপ্পড় দিয়েই থাকে, তেমনটা নয়, সেটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা বিষয়। এই নিয়মিত ঘটনাগুলো ছিল পলাশের অযৌক্তিক, অনিয়ন্ত্রিত, জানোয়ারের মতো মেজাজের প্রকাশ। সে আমাকে একটা বেডরুমে টেনে নিয়ে যেত, দরজাটা বন্ধ করে দিতো যাতে বাইরে থেকে কেউ আমাকে বাঁচাতে আসতে না পারে এবং তারপর যা ইচ্ছা তাই করতো – লাথি, ঘুষি, থাপ্পড়, এমনকি হাতের কাছে যা পেতো, তাই দিয়ে মারা। এই মার্ চলতো একটানা কয়েক মিনিট পর্যন্ত ; পলাশ তখনই কেবল থামতো যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়তো, আমি কী অবস্থায় আছি, আমার হাজার কাকুতি-মিনতি, চিৎকার, কান্নাকাটি, কোনকিছুই তাকে থামাতে পারতো না। কল্পনা করুন, ৫ বছর বয়সের আমি, আর আমার মুখোমুখি ছয় ফুট উচ্চতার একজন পুরুষ। বাঁচার কোন পথ ছিল না, আর নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা ছিল অর্থহীন”, লিখেছেন লুম্বিনী।

২০০২ সালে পলাশ তার স্ত্রী রোকসানা আক্তার ঝর্ণা আর মেয়ে লুম্বিনীকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান, পলিটিক্যাল এসাইলামের জন্যে এপ্লাই করেন। যেহেতু পলাশই ছিলেন মূল এপ্লিকেন্ট, এইসময়টুকুতে রোকসানার অবস্থা হয়ে পড়ে আরও নাজুক। পলাশের অত্যাচার তো ছিলোই , এর সাথে যুক্ত হয় কথায় কথায় দেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি।
সে সময় ইংল্যান্ডের সরকারের কাছ থেকে যে তাদের সামান্য অর্থটুকু তারা পেতেন, তাতে হয়তো তাদের একটু কষ্ট করে হলেও চলে যেতো, কিন্তু সেটা সম্ভব হতো না কেবল পলাশের জন্যে। এমনকি রোকসানার ভাই যে মাঝে মাঝে তার হাতে যে টাকা দিয়ে যেতেন, সেই টাকাও পলাশ ছিনিয়ে নিয়ে যেতেন।

“সরকার ৬০০ পাউন্ড দিতো আমাদের চলার জন্যে আর বাচ্চাদের জন্যে আলাদা পয়সা দিতো, ঐটা আমাকে দেখাতো না। আমাকে শুধু ৬০০ পাউন্ড দেখাতো। ৬০০ পাউন্ডের মধ্যে ভাড়া দিতে হতো, তারপর আমাদের খাওয়া, এর মধ্যে থেকে প্রতি শনিবারে গিয়ে ৫টা, ৬টা করে ভিডিও ক্যাসেট কিনতো। এখন আমরা খাবো কী! কী যে কষ্ট গেছে! মেয়ে লুম্বিনী বলতো, “আম্মু, আমি না একটা আইসক্রিম খাবো,”, আমি বলতাম, “পলাশ, একটা পাউন্ড দাও না, লুম্বিনী আইসক্রিম খাবে”, বলে, “না! এগুলো খাওয়া যাবে না! এতো পয়সা নাই!”
তারপর যখন নির্বাণ হলো, ও খেতে চাইতো না, এখানে কত খাবার বাচ্চাদের, আমি বলতাম, বাচ্চাদের খাবার কিনি, বলে “না, খিচুড়ি বানায়া খাওয়াও। বাচ্চাদের এতো পয়সা নাই,” বলে থামলেন রোকসানা। তার কণ্ঠের প্রাণশক্তি তখন কান্নার ভারে অবনত।
বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে গেলেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে দিতেন না। কখনো যদিও বা সেলে পেয়ে বাচ্চাদের জন্যে কোন খাবার যেমন জুস্ বা কুকিস এইসব কিনে আনতেন রোকসানা, সেইসব খাবার নিয়ে গিয়ে পলাশ গাড়িতে লুকিয়ে রাখতেন নিজে খাবেন বলে। লুম্বিনীও জানিয়েছেন এমনটাই।
“পলাশ নিজের জন্যে ডিজাইনার ঘড়ি, স্যুট এবং কাপড় কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতো, কিন্তু আমি স্কুল, ইউনিভার্সিটির জন্যে কিছু চাইলেই অথবা বন্ধুদের সাথে বাইরে খাবার খেতে যাইতে চাইলেই সে বলতো তার কাছে কোন টাকা নেই, আমি যেন মায়ের কাছে চাই।“
লুম্বিনীর ওপর পলাশের শারীরিক অত্যাচার বন্ধ হয় তখন, যখন বিষয়টাতে লন্ডন পুলিশ হস্তক্ষেপ করে।

লুম্বিনীর বয়স তখন ১২ বছর।
“সে আমার ওপর অত্যাচার করা বন্ধ করেছিল তার কারণ স্কুলে আমার এক বন্ধু আমার ফেটে যাওয়া রক্তাক্ত ঠোঁট আর নাক দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ অফিসারেরা আমাদের বাড়িতে আসে, আমার ছবি তোলে এবং ডোমেস্টিক এবিউজ আর চাইল্ড এবিউজের অভিযোগে তাকে এরেস্ট করে। সে এক রাত জেলে কাটায়। এবারকার ঘটনার কারণটা ছিল এই – পরদিন আমার একটা স্কুল ট্রিপ ছিলো যার জন্যে আমার একটা প্যাকড লাঞ্চের প্রয়োজন ছিল, যেটা আমি আগে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। যার অর্থ হলো, তাকে তখন দোকানে গিয়ে আমার জন্যে একটা স্যান্ডউইচ কিনে আনতে হতো। কোন সুস্থবুদ্ধির মানুষ কি এই সামান্য কারণে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারে? দেখতেই পাচ্ছেন, কত সহজেই সে একটা জানোয়ারে পরিণত হয়, যে কোন একটা অজুহাত পেলেই হলো। বলাই বাহুল্য যে, পরের দিন স্কুল ট্রিপে যাওয়া আমার ভাগ্যে জোটেনি।“
দুর্ভাগ্যবশত: রোকসানা এতোটা ভাগ্যবান ছিলেন না। তাঁর ওপর পলাশের শারীরিক অত্যাচার, ধর্ষণ এইসব চলতে থাকে তাদের সম্পর্কের শেষ পর্যন্ত।

প্রেগনেন্সির সময়গুলোতে পলাশ তাঁকে যে ধর্ষণ করতেন একথা আমরা আগেই লিখেছি, তাঁর রেহাই মিল্টন সিজারিয়ান ডেলিভারির পরও।
তাঁর ছেলে নির্বাণ হবার পর যেদিন তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন (তখনও তাঁর সেলাই কাটা হয়নি) সেদিনই আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী খান মামুনকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে এলেন পলাশ। রোকসানার ওপর হুকুম হলো, হাঁস রান্না করে খাওয়াতে হবে মামুনকে। পেটে সিজারিয়ানের সেলাই নিয়ে মেঝেতে বসে বটিতে হাঁস কেটে সব রান্না করেছিলেন সেদিন রোকসানা।

লুম্বিনী বলেছেন,
“দুর্ভাগ্যবশত আমার মায়ের ওপর তার শারীরিক অত্যাচার ক্রমাগতভাবে চলেছে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না তাদের ডিভোর্স হয়। এমন অজস্র ঘটনা আমার স্মৃতিতে রয়েছে, এটাই ছিল আমাদের তখনকার প্রাত্যহিক জীবন। আমি কেবল এটুকুই বলবো যে সে আমার মাকে এমনকি তখনও একটুও রেহাই দেয়নি যখন আমার মা আমার ভাইকে নিয়ে প্রেগনেন্ট; সে অর্থহীনভাবে মায়ের ওপর অত্যাচার চালিয়ে গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে মা যখন আমার ভাইয়ের জন্ম দেবার পর সিজারিয়ান ডেলিভারির স্টিচ নিয়ে সদ্য বাসায় এসেছেন, – তখন সে তার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে নিয়ে এসেছিলো, আমার মনে আছে আমার মা ব্যথায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেই দাওয়াতের রান্না করছিলেন।”

প্রতিদিন তার অত্যাচারে যুক্ত হতো নতুন মাত্রা। নির্বাণকে নিয়ে প্রেগনেন্ট থাকা অবস্থায় কিলঘুষি থাপ্পড় এইসব খাওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো রোকসানার জন্যে।
“লুম্বিনী খালি ভয়ে চিৎকার করতো, “বাবা, বাবা, আম্মুকে মাইরো না, বাবা, ও বাবা, প্লিজ, আম্মুকে মাইরো না বাবা, প্লিজ,” বলেন রোকসানা।
এইরকম অমানবিক অবস্থায় কাটছিলো রোকসানার এসাইলামের দিনগুলো।
ক্রমশ:

আগের লিংকগুলো:

https://womenchapter.com/views/35830

https://womenchapter.com/views/35909

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.