নাদিয়া অনি:
ছোটবেলা রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি কবিতাটা পড়ে মনে হয়েছিলো কৃষ্ণকলিরা বুঝি অসম্ভব রূপবতী হয়। তখন রূপবতী মানেই বুঝতাম ফর্সা। কৃষ্ণ মানে যে কালো সেটা জেনেছি অনেক পরে।
সেই যুগের টেলিভিশনের প্রধান এডগুলাই ছিলো সৌন্দর্য নিয়ে এবং এডগুলোর মূলমন্ত্র ছিলো সুন্দর মানেই ফর্সা, কালো মেয়েদের কোন মূল্য নেই, হতে হবে ধবধবে ফর্সা।
কালো বলে বিয়ে হচ্ছে না, চাকরি হচ্ছে না, প্রেম হচ্ছে না, বন্ধু হচ্ছে না, স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না, এমনকি বাবা মা ভাই বোনও পরিচয়ও দিতে পাচ্ছে না। তাই সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে ফর্সা হতে হবে। যখন ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে ফর্সা হচ্ছে তখনই সব শখ, আহ্লাদ, স্বপ্ন, সুখ হাতেই মুঠোয় চলে আসেছে।
এই এডগুলো এই দেশের মানুষের মনকে যে কতটা কলুষিত করেছে তা টের পাওয়া যায় এখন এসে। এই দেশের মানুষের মন মানসিকতা যে আহামরি উন্নত ছিলো তা কিন্তু না। সেই অনুন্নত মনকে আরও বিষিয়ে দিয়েছিলো। এই এডগুলো মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে কালো বলে তুমি ভালো চাকরি পাবে না, ভালো বর পাবে না, ঘর পাবে না।
এই বিষয়গুলোতে ছেলেদের থেকে মেয়েরা আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে।
সেই যুগেও কয়েক বছর পর মেরিল কোম্পানি তাদের সাবানের একটা এড তৈরি করেছিলো। এডের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ফর্সা নয়, ফ্রেশ মানেই সুন্দর।এই যে মেরিল একটা ট্রেন্ড ভেঙেছে, আস্তে আস্তে অনেকেই এই ধরনের কুৎসিত বিজ্ঞাপন থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আসছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক।
কিন্তু মানুষের মনমানসিকতা খুব বেশি উন্নত হচ্ছে না। ছেলের বউকে ফর্সা হতে হবে যাতে নাতি-নাতনী ফর্সা হয়। মেয়েকে ফর্সা করার জন্য মায়ের সে কী তোড়জোড়! কারণ মেয়ের যাতে একটা ভালো বিয়ে হয়।
আমার অনলাইন একটা পেইজ আছে। ত্বকের যত্নের প্রসাধনী নিয়ে। আমার কাছে পঞ্চাশ পারসেন্টের বেশি ক্রেতা আসে ফর্সা হওয়ার ক্রিম বা প্রসাধনীর জন্য। ত্রিশ পার্সেন্ট ক্রেতা আসে ফর্সা হওয়া প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে ত্বক বাজে ভাবে ড্যামেজ হয়ে গেছে, সেই ড্যামেজ স্কিন রিপেয়ার করার জন্য।
না ফর্সা হতে চাওয়া দোষের বা অন্যায় নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটা দেশে যে দেশে ফর্সা হওয়াকে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসাবে মনে করা হয়। যে দেশে মেয়ে সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়াই হতাশার, সে দেশে কালো মেয়ে হিসাবে জন্ম নেওয়া তো রীতিমতো অপরাধ।
এই দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন কালো মেয়ে প্রতিটি জায়গায় শুধু মাত্র কালো হওয়ার কারণে যেভাবে অপমান, অপদস্থ হতে হয় তাতে মেয়েদের ফর্সা হতে চাওয়ার যে আকুলতা সেটাকে আসলে দোষ দেওয়া যায় না।
গায়ের রঙ ফর্সা হবে না কালো হবে সেটা পরিবেশ, আবহাওয়া এবং জিনের উপর নির্ভর করে। গায়ের রঙ আচার, ব্যবহার, বুদ্ধি বা শিক্ষার উপর প্রভাব ফেলে না। ফর্সা হলেই কেউ ভালো মানুষ হয় না, ফর্সা হওয়া মানেই সুন্দর না। ফর্সা যদি সৌন্দর্যের মাপকাঠি হতো তাহলে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কখনও আফ্রিকান কালো মেয়েরা সুযোগ পেতো না।
সৌন্দর্য গায়ের কালারে থাকে না। সৌন্দর্য থাকে মানুষের শিক্ষায়, আচরণে, ব্যক্তিত্ববোধে, মানুষের মনুষ্যত্বে। সৌন্দর্য থাকে বিনয়ে, অপরের প্রতি শ্রদ্ধায়, মানুষের প্রতি ভালোবাসায়।
সৌন্দর্য থাকে মানুষের মননে এবং প্রজ্ঞায়।তাই ভিতরের সত্তাটাকে সুন্দর রাখুন,বাহিরের ত্বকটাকে পরিস্কার এবং ফ্রেশ রাখুন।